দ্বিতীয় যুবকের কিস্সা শেষ হলে খচ্চরের মালিক তৃতীয় মিঞা আফ্রিদি দৈত্যকে কুর্নিশ করে বলল— মেহেরবান, আমার কিস্সা শুনলে তাক লেগে যাবে।

—‘তোমার কিস্সা? তোমারও আবার কিস্সা আছে নাকি হে? বল, শুনি কেমন তোমার কিস্সা।' আফ্রিদি দৈত্য মুচকি হেসে বলল।

এবার খচ্চরের মালিক তৃতীয় যুবক বলল— “দৈত্যশ্রেষ্ঠ, এই খচ্চরটা কিন্তু সত্যিকারের খচ্চর নয়। আমার বিবি। যাদু বলে তাকে খচ্চরের রূপ দেওয়া হয়েছে। একবার আমি ভিনদেশে গিয়েছিলাম।

বছরখানেক পরে বাড়ি ফিরেই বিবির সঙ্গে দেখা করার জন্য অন্দরমহলে গেলাম। আমার মাথাটা অকস্মাৎ চক্কর মেরে উঠল। দেখি আমার বিবি এক নিগ্রো নোকরের আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে মৌজ করে প্রোমালাপ করছে। মুখে আদিরসের জোয়ার, আর হাত দুটো তার শৃঙ্গারে লিপ্ত। কোনদিকে হুঁসমাত্রও নেই। উভয়ে যেন ভিন লোকে বিচরণ করছে। ক্রমে তাদের মধ্যে উত্তেজনা জাগছে। আমি দরজার ফুটোয় চোখ রেখে তাদের প্রেম-পীরিতি দেখতে লাগলাম।

অকস্মাৎ আমার বিবি আমাকে দেখে ফেলল। তড়াক্ করে চৌকি থেকে নেমে দেয়ালের তাক থেকে জলের বাটি মুখের কাছে তুলে নিয়ে ফিসফিস করে কি সব মন্ত্র আওড়াল। তারপর তা গন্ডুষ ভরে তুলে নিয়ে আমার গায়ে ছিটিয়ে দিল। ব্যাপারটা আমি আগে লক্ষ্য করিনি। ব্যস, মুহূর্তে আমি কুকুরের রূপ পেয়ে গেলাম। তারপর আমাকে দূর দূর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল।

মনের দুঃখে আমি নগরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। একদিন পেটের জ্বালায় এক মাংসের দোকানে গেলাম। ফেলে দেওয়া হাড়গোড় মুখে নিয়ে চিবোতে লাগলাম। আমাকে দেখে কষাইয়ের বড়ই দয়া হ’ল। সঙ্গে করে সে তার বাড়ি নিয়ে গেল। কষাইয়ের যুবতী লেড়কি আমাকে দেখেই ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে তার আব্বাজানকে বকাবকি করতে লাগল— 'তুমি একজন পরপুরুষকে কেন একেবারে অন্দর মহলে নিয়ে এলে? এটা তো সাধারণ কুকুর নয়, পুরুষ মানুষ। এক শয়তানী একে তুক্ করে কুকুরে পরিণত করে দিয়েছে। তোমার ইচ্ছা থাকলে আমি এর মানুষের রূপ ফিরিয়ে দিতে পারি।'

— ‘বেচারার কী কষ্ট, চোখে দেখা যায় না। তুমি একে মানুষে পরিণত করে দাও। এর কষ্টে আমার কলিজাটা উথাল পাথাল করছে।'
কষাইয়ের লেড়কি এক বাটি জল নিয়ে বিড়বিড় করে কি সব মন্ত্র আওড়াল। তারপর সে-জল আমার গায়ে বার বার ছিটিয়ে দিল। আমি আবার আগের সে-মানুষের রূপ ফিরে পেলাম।

আমি বললাম— ‘সুন্দরী, তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। আমার শয়তানী বিবিকে আমি খচ্চরে পরিণত করে দিতে চাই।
তোমার দ্বারা কি সম্ভব?'

কষাইয়ের লেড়কি আবার সে-বাটিটা ভরে জল নিল। আগের মতই বিড়বিড় করে কি যেন বলল। এবার বাটিটা আমার হাতে দিয়ে বলল— ‘তোমার বিবি যখন নিদ যাবে তখন এ-জল তার গায়ে দিয়ে
মনে মনে যা ভাববে সে সে-রূপই পাবে।'

এবার আফ্রিদি দৈত্যের দিকে ফিরে সে বলল— “দৈত্যশ্রেষ্ঠ এ খচ্চরটাই আমার সে বিবি। যাদুকরী বিবি!’
আফ্রিদি দৈত্যের মুখে প্রসন্নতার ছাপ ফুটে উঠল। এবার সে বলল— সওদাগর আমি তোমার সব গুনাহ মাফ করে দিলাম। তুমি মুক্ত। যেখানে খুশি যেতে পার।'


ইতিমধ্যে পূর্ব-আকাশে ভোরের আলো উঁকি মারতে শুরু করেছে। শাহরাজাদ কিস্সা শেষ করতেই দুনিয়াজাদ তার গলা জড়িয়ে বলল— 'কী সুন্দর! কী সুন্দর কিস্সা-ই না তুমি জান দিদি !’

—‘এ আর এমন কি সুন্দর কিস্সা বহিন। প্রাণে বাঁচলে দেখবি কাল আরও কত সুন্দর কিস্সা শোনাব।' বাদশাহ শাহরিয়ার ভাবলেন, একে কোতল করে এমন সুন্দর কিস্সা শোনা থেকে কিছুতেই বঞ্চিত হওয়া যায় না। বিবি শাহরাজাদ-এর কোলে মাথা রেখে তিনি নিদ্রায় অভিভূত হয়ে পড়লেন।

সারাদিন দরবারে নানা কাজে লিপ্ত থাকার পর বাদশাহ শাহরিয়ার সন্ধ্যার কিছু পরে অন্দরমহলে এলেন। রাত্রে তাড়াতাড়ি পানাহার সেরে ঢুকলেন শোবার ঘরে। দুনিয়াজাদ তার দিদির গলা জড়িয়ে ধরে আব্দারের স্বরে বলল,
‘কিস্সা শুরু কর।'----