শাহরাজাদ কিস্সা বলতে লাগল—
কোন এক সময়ে এক বুড়ো জেলে সাগরের পাড়ে কুটীর বানিয়ে তার বিবি আর লেড়কা-লেড়কী নিয়ে বসবাস করত। রোজদিন মাত্র পাঁচবার সে জাল ফেলত। এক দুপুরে জাল ফেলল। একটা গাছের গুড়ি তুলল। আবার জাল ফেলল, বুঝল ভারি কোন জিনিস জালে আটকা পড়েছে। অনেক আশা করে জাল গুটিয়েই আর্তনাদ করে উঠল— 'হায় আল্লা!’ সে দেখল, একটা মরে ফুলেফেঁপে যাওয়া গাধা জালে জড়িয়ে রয়েছে। তার দিলটা মোচড় মেরে উঠল। নিজেকে প্রবোধ দিল, খোদাতাল্লার বুঝি এটাই মর্জি। গাধাটাকে জাল থেকে বের করে আবার জালটাকে জলে ছুঁড়ল। ব্যস, এবার আরও অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটল । অস্বাভাবিক ভারি ঠেকল। কিছুতেই জাল গোটাতে পারছে না। ঘেমে নেয়ে একাকার। শেষ পর্যন্ত অনেক ধকল সহ্য করে জাল গুটিয়ে দেখে অতিকায় একটা মাটির জালা। মোহর টোহর নয়, পচা পাঁকে ভর্তি। বিষণ্নমনে জাল থেকে জালাটাকে বের করে নদীর ধারে কাৎ করে রাখল।

আল্লাহর নাম নিয়ে আবার জাল ফেললো। এবারও একই সমস্যা। ভীষণ ভারি ঠেকল। কোনরকমে কাঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে জাল গুটিয়ে দেখে এক গাদা হাড়ি-কলসি ভাঙা আর ছোট বড় কাঁচের টুকরো।
এবার আকাশের দিকে মুখ করে বলতে লাগল—খোদা, তোমার কি মর্জি জানি না! চার চারবার জাল ফেলে নসীবে কিছুই জুটল না।

এবারই শেষ। দেখি, তোমার কি মর্জি।'
কথা বলতে বলতে বুড়ো জেলেটা শেষবারের মত জালটা জলে ছুঁড়ে মারল। এবার সে বুঝল নির্ঘাৎ বিশাল একটা পাথরের টুকরো জালে আটকেছে। বার কয়েক টেনে এক আঙুলও নড়াতে পারল না। এবার অনেক চেষ্টার পর একটা তামার জালা তুলে আনল। জালাটার মুখ আটকানো। সিলমোহর ব্যবহার করা হয়েছে। দাউদের পুত্র সুলেমানের নাম তাতে খোদাই করা। বুড়ো জেলের হতাশা অনেকাংশে হ্রাস পেল। ভাবল, এর দাম নেহাৎ কম নয়। কম করে হলেও দশটা দিনার তো এর বিনিময়ে মিলবেই।

বুড়ো জেলে এবার জালাটাকে একটু নাড়িয়ে চড়িয়ে দেখার চেষ্টা করে হতাশ হ'ল। পেল্লাই ভারি। ভাবল কি, অগেকার দিনে আমির-বাদশারা ঘড়া ঘড়া মোহর মাটির তলায় পুঁতে রাখত। যদি
নসীবে সেরকমই কিছু জুটে যায়। হায় খোদা, তবে একদিনেই আমীর বনে যাব! সবই খোদার মর্জি।

কিন্তু মুখে সিলমোহর আঁটা। মুখটা না খোলা পর্যন্ত কিছুই বোঝার জো নেই। ধারাল একটা কাটারি দিয়ে বহুত খুব কায়দা-কসরৎ করে জালার মুখটা খুলতে পারল। ব্যস, মুহূর্তে ধোঁয়ার কুণ্ডলি ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল। চোখের পলকে ধোঁয়ায় চারদিক ঢেকে ফেলল। তারপর তা একটা আফ্রিদি দৈত্যের অবয়ব ধারণ করল। তার হাত-পা দুটো অতিকায়। মাথাটাও বিরাট একটা
ঝুড়ির মত। মুখটা পর্বতের গুহার মত। দাঁতগুলো শ্বেত পাথরের টুকরোর মত চকচক করছে। নাকের ছিদ্রদুটো বাঁশের চোঙার মত, চোখ দুটো গোল-আলুর মত জ্বলজ্বলে, মাথায় যেন শনের বন
গজিয়েছে।
পর্বত প্রমাণ ভয়াল দর্শন আফ্রিদি দৈত্যটাকে দেখেই বুড়ো জেলের কলিজাটা শুকিয়ে গেল। আত্মা যেন খাঁচা ছাড়া হয়ে পড়ার জোগাড়। ভাল করে চোখ পর্যন্ত খুলতে পারল না।

আফ্রিদি দৈত্য গর্জে উঠল— 'আল্লাহকে ছাড়া আমি দুনিয়ায় আর কাউকেই পরোয়া করি না। আল্লাহ-র পয়গম্বর স্বয়ং সুলেমান।
এবার করজোড়ে নিবেদন করল— ‘মেহেরবান সুলেমান, দোহাই তোমার। আমাকে মেরে ফেলো না। আমি এক মুহূর্তের জন্যও তোমার মতের বিরুদ্ধে যাব না। তোমার কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
জানাব না।'

বুড়ো জেলে এবার মনে সাহস অবলম্বন করে বলল— দৈত্যশ্রেষ্ট আফ্রিদি, বাদশাহ সুলেমানের ভয়ে তুমি এমন কুঁকড়ে যাচ্ছ! সুলেমান তো আঠার শ' বছর আগেই দুনিয়া ছেড়ে বেহেস্তে চলে গেছেন
তোমার গোস্তাকীই বা কি ছিল যার জন্য বাদশাহ সুলেমান তোমাকে জালাটার মধ্যে পুরে রেখেছিল?'

বুড়ো জেলের কথায় আফ্রিদি দৈত্যের কলিজাটা যেন ভিজে গিয়ে কিছু স্বাভাবিকতা ফিরে পেল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল— ‘খোদাতাল্লা ছাড়া আর করো ওপরেই আমার তিলমাত্র আস্থাও নেই। তাঁর কাছ থেকে তোমার জন্য খুব সুন্দর একটা খবর নিয়ে এসেছি।'

জেলে অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে বল্ল – কি? কি সে চমৎকার খবর? মেহেরবানি করে বল, কি খবর নিয়ে এসেছ?'

মৃত্যু... তোমার মৃত্যুর খবর। আর সে মৃত্যু হবে এক ভয়ঙ্কর উপায়ে!

মৃত্যুর কথায় জেলের কলজেটা যেন আচমকা ডিগবাজি খেয়ে উঠল। মুখটা শুকিয়ে একেবারে আমসি হয়ে গেল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় কোনরকমে বলল— 'আমার কসুর কি, যার জন্য তুমি আমার জান খতম করতে চাইছ? দীর্ঘকাল জালাটার মধ্যে বন্দী ছিলে। কষ্ট পাচ্ছিলে আমি তোমায় বন্দীশালা থেকে মুক্তি দিয়েছি। এটাই যদি
আমার কসুর আর এরই জন্য যদি আমাকে জান দিতে হয় তবে আর আমার কিছুই বলার নেই।'

আফ্রিদি দৈত্য যেন জেলের কথা শুনতেই পায় নি এমন ভাব করে বলল— 'তুমি নিজেই বল, কিভাবে তুমি মরতে চাইছ।’

জেলে এবার করজোড়ে বলল- ‘আমার গোস্তাকি কি তা তো বলবে? কেন আমাকে তোমার হাতে জান দিতে হবে?'

আফ্রিদি দৈত্য এবার বলল– তোমাকে তবে একটা কিস্সা শোনাচ্ছি তাতেই তোমার সওয়ালের জবাব পেয়ে যাবে। —
তুমি হয়ত জেনে থাকবে, আমি সক্-হর-অল্ জিনি। বাদশাহ সুলেমানের এক বিদ্রোহী নফর ছিলাম। আমাকে ঢিট করার জন্য সুলেমান একবার উজির আশাফ-ইবন বারাখ্যাকে পাঠান। আমি গায়ে অসুরের শক্তি ধরি। তবু সে আমাকে কব্জা করে ফেলে। বন্দী করে সুলেমানের দরবারে হাজির করল। সুলেমান মিষ্টি মুখেই আমাকে বলল— ‘তোমার গোস্তাকী আমি মাফ করে দিতে পারি যদি আমার বিশ্বস্ত নোকর হয়ে থাকতে রাজী হও।

আমি তাঁর কথায় সম্মত হলাম না। প্রতিবাদে মুখর
হয়ে উঠলাম। এবার অতিকায় একটা তামার জ্বালায় আমাকে পুরে তার মুখ বন্ধ করে দিল। তারপর বদশাহ সুলেমানের মোহর খোদাই করে দিল জালাটার মুখে। এবার সাগরে ফেলে দিল আমাকেসহ জালাটাকে।

পানির তলায় জালাবন্দী হয়ে মনের দুঃখে দিন গুজরাণ করতে লাগলাম। তখন শপথ করলাম, এক’শ বছরের মধ্যে কেউ আমাকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি দিলে তার জীবনকে সুখ-সাচ্ছন্দে ভরিয়ে
তুলব। কিন্তু আমার নসীব খারাপ। কারো দয়া হ’ল না!

দ্বিতীয় শতকে শপথ নিলাম, কেউ আমাকে মুক্তি দিলে তার ঘর তামাম দুনিয়ার হীরে-জহরৎ আর ধন-দৌলতে ভরে দেব। এবারও কারো দয়া হ’ল না। এভাবে চার শ' বছর পানির তলায় জালাবন্দী হয়ে কষ্ট পেতে লাগলাম।

তারপর আমি আবারও এক শপথ করলাম, যে আমাকে উদ্ধার করবে আমি তাকে তিনটি বর দেব। যা সে চাইবে, তা-ই পাবে। কিন্তু কারো দেখা পেলাম না। এবার আমি আর শান্ত থাকতে পারলাম না। রীতিমত ক্ষেপে গেলাম। রাগে-দুঃখে-অপমানে ফেটে পড়ার যোগাড় হলো।

এবার প্রতিজ্ঞা করলাম, আমাকে যে মুক্ত করবে সে-হতচ্ছাড়াকে আমি কোতল করব। আমার বন্দী- জীবন অব্যাহতই রইল।

নসীবের ফেরে তুমি এসে এবার হাজির হলে। আমাকে মুক্তি দিলে। কিন্তু আমি যে শপথ করে রেখেছি। শপথ রক্ষা আমাকে করতেই হবে। তোমাকে সুযোগ দিচ্ছি, তুমি নিজেই বেছে নাও কি
ভাবে মরতে চাও আফ্রিদি দৈত্যের কথায় বুড়ো জেলের তো কলিজা পর্যন্ত শুকিয়ে একেবারে কাঠ। সে করজোড়ে বার বার প্রাণ ভিক্ষা করতে লাগল।

আফ্রিদি দৈত্য কোন কিছুতেই ভুলবার নয়। বার বারই বলতে লাগল— 'তোমার খুশিমত পথ বেছে নাও, কিভাবে তুমি মৃত্যু বরণ করতে আগ্রহী।'

বুড়ো জেলে কেঁদে কেটে বলতে লাগল— ‘কেন আমাকে জান দিতে হবে? আমি তো জীন্দেগীতে কোন গুনাহ করিনি যে, আমার অপমৃত্যু ঘটতে পারে।'

আফ্রিদি দৈত্যর মুখে সেই একই কথা— ‘দেরী কোরো না। কিভাবে জান দিতে চাও তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেল।'

এবার বুড়ো জেলের মাথায় সুন্দর একটা মতলব এল। সে চোখ মুছতে মুছতে বলল— তুমি তো আমাকে খুন করবেই। কিন্তু আমার গুনাহ কি, না-ই বা বললে। পানি থেকে আমি এ-তামার জালাটা তুলেছি। জালার মুখ খুলেছি, মিথ্যা তো নয়। কিন্তু আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, তোমার এ-অতিকায় দেহটা এ-জালাটার
মধ্যে কি করে ছিল? আমি কেন, এরকম একটা গাঁজাখুরি কথা কেউ কি বিশ্বাস করবে? অবশ্যই না।'

বুড়ো জেলের কথায় আফ্রিদি দৈত্য ক্ষোভে—অপমানে রীতিমত ফুঁসতে লাগল। জেলের গলাটিপে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল— “ঠিক আছে, আগে তোমার সন্দেহ দূর করছি।' কথা বলতে বলতে জালাটার মধ্যে নিজের অতিকায় দেহটাকে দিল ঢুকিয়ে। ব্যস, জেলে সঙ্গে সঙ্গে জালাটার মুখ দিল বন্ধ করে।'

কিস্সার এ অংশ পর্যন্ত বলে বেগম শাহরাজাদ থামলেন। ...

চতুর্থ রাত্রে বাদশাহ আবার এলেন।
শাহরাজাদ কিস্সা ফাঁদলেন— 'জেলে বুড়ো সে তামার জালাটার মুখ বন্ধ করে আপন মনে হাসতে লাগল। তারপর গলা ছেড়ে বলল— ‘হতচ্ছাড়া আফ্রিদি, তোকে আবার সাগরের পানিতে ডুবিয়ে
দেব। আর নিজে সাগরের ধারে কুটীর বেঁধে বাস করব। অন্য কোন হতভাগা যাতে এখানে জাল ফেলে আর নিজের মৃত্যু ডেকে না আনে। আর ঢোল পিটিয়ে চারদিকের গ্রামবাসীকেও ব্যাপারটা
জানিয়ে দেব। দেখব, কে তোকে অথৈ পানি থেকে উদ্ধার করে।'

তামার জালাটা ভাঙার ক্ষমতা দৈত্যর নেই। ফলে অসহায়ভাবে জালার মধ্যে হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে আর্তনাদ জুড়ে দিল অনেকভাবে অনুরোধ করতে লাগলো- ‘তোমার কোন ক্ষতিই করবো না। তামাম দুনিয়ার হীরে-জহরত ধন-দৌলতে তোমার ঘর ভরে দিবো।’