বুড়ো জেলে হেসে বলল– ‘‘হাকিম রায়ান ও বাদশাহ উনানের উজির-এর কিস্সা বলছি শোন’’—

অতি প্রাচীনকালে রুম দেশে যার নামে সুন্দর এক নগর ছিল। সেখানে প্রবল পরাক্রান্ত এক সুলতান
রাজত্ব করতেন। সৈন্যসামন্ত, নোকর-নোকরাণী আর ধনদৌলত কোন কিছুরই অভাব ছিল না তাঁর। কিন্তু দুঃখ তাঁর একটাই ছিল, সারা গায়ে ধগ্ধগে কুষ্ঠ। বহু হেকিম, বৈদ্য, তাবিজ, শেকড় ব্যবহার করেও নসীব ফেরাতে পারেন নি। রোগজ্বালায় দগ্ধে মরতে লাগলেন।

এক সকালে সুলতানের দরবারে এক অতি বৃদ্ধ হাজির হ'ল। রায়ান হেকিম ব’লে সবাই জানে তাকে। নানা ভাষায় তার পাণ্ডিত্য ছিল। বহুরকম বিদ্যা তার আয়ত্বে ছিল। দরবারে হাজির হয়ে
সুলতানকে কুর্নিশ করে বলল– হুজুরের দুরারোগ্য বিমারির খবর পেয়ে ছুটে আসছি। আমার বিশ্বাস, আপনার বিমারি আমি সরিয়ে তুলতে পারব। কিন্তু আপনাকে অনুরোধ করতেও ভরসা হয় না।
আপনি এ দেশের সুলতান। মস্ত বড় আদমি। আমার সঙ্গে জান পহছান নেই। আমার দেওয়া দাওয়াই কোন ভরসায়ই বা সেবন করবেন?'

সুলতান বল্‌লেন— 'না-ই থাকল জান পহছান। আমার বিমারি যদি সারিয়ে তুলতে পার বিস্তর ধনদৌলত পাবে। কেবল মাত্র তুমিই নও, তোমার বংশপরম্পরা আমার দরবার থেকে মাসোহারা পাবে। আর আমার দরবারের প্রধান পারিষদ করে রাখব তোমাকে। ‘সুলতান এবার একটা বহুমূল্য শাল হেকিম রায়ানকে উপহার দিলেন।

—‘আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন জাঁহাপনা। আমার দাওয়াই আপনার বিমারি সারিয়ে তুলবেই।'
—তবে কাল থেকেই ইলাজ শুরু কর।'

হেকিম রায়ান গাছগাছড়া নিয়ে বসে গেল দাওয়াই বানাতে। একটা দাওয়াই বানিয়ে একটা ফাঁপা বাঁশের লাঠির মধ্যে তার কিছু অংশ ঢুকিয়ে নিল। লাঠিটার মুখ বন্ধ করে দিল। অবশিষ্টটুকু অন্য
একটা বাঁশের চোঙের মধ্যে রেখে দিল। এবার একটা ফাঁপা পোলো বল তৈরি করে তার ভেতরেও কিছুটা দাওয়াই ঢুকিয়ে দিল।

হেকিম এবার লাঠি এবং পোলো বলটি নিয়ে সুলতানের দরবারে হজির হ’ল। সেগুলো সুলতানের হাতে তুলে দিয়ে বলল—
‘জাঁহাপনা, এদুটো দিয়ে আপনাকে পোলো খেলতে হবে। শরীর ঘেমে গেলে বেশী করে পানি দিয়ে গোসল করে ফেলবেন। ব্যস, আর কিছুই করতে হবে না। এটাই আপনার বিমারির ইলাজ। এতেই বিমারি সেরে যাবে।' হেকিম রায়ানের ইলাজের বিধান অনুযায়ী সুলতান উনান তাঁর সভার উজির, আমীর, ওমরাহ প্রভৃতিকে নিয়ে ময়দানে গেলেন। ঘোড়ার পিঠে চেপে শুরু করলেন পোলো খেলা। সর্বাঙ্গ ঘামে জবজবে হয়ে উঠলে খেলা বন্ধ করে প্রাসাদে ফিরে এলেন। ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ভাল করে গোসল করলেন।

রাত্রে বিছানা আশ্রয় করতেই আঁখির পাতায় নিদ জড়িয়ে এল। সকালে হেকিম রায়ান সভায় আসতেই উচ্ছ্বসিত আবেগের সঙ্গে সুলতান উনান বলেন— 'হেকিম সাহেব, তোমার দাওয়াই আমার তবিয়ত অনেকটা ভাল করে দিয়েছে। আরাম মালুম হচ্ছে।' রায়ান'কে প্রচুর উপহারে তিনি সন্তুষ্ট করলেন।

হেকিম রায়ান-এর পরামর্শ মত সুলতান উনান-এর ইলাজ চলেছে। এদিকে ক্রমে তাঁর দেহের কুষ্ঠের দাগগুলি মিলিয়ে যেতে লাগল। রোজই সকালে রায়ান দরবারে উপস্থিত হলে প্রচুর বকশিস দিয়ে সুলতান উনান তাঁকে খুশি করেন।

সামান্য এক হাকিমকে দু'হাতে বকশিস দেবার ব্যাপারটা উজিরের সহ্য হ'ল না। চোখ টাটাতে লাগল। দরবারে উজিরের খাতির সবচেয়ে বেশী ছিল এতদিন। কিন্তু আজ তাঁর জায়গায় সর্বাধিক খাতির পাচ্ছে হেকিম। অসহ্য একেবারেই অসহ্য। উজির ভেতরে ভেতরে দগ্ধে মরতে লাগলেন।

পরদিন সকালে হেকিম রায়ান দরবারে এলে সুলতান উনান মসনদ থেকে উঠে ব্যস্ত-পায়ে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে হাতে ধরে নিয়ে গিয়ে নিজের পাশে বসালেন। এরকম খাতির একমাত্র
উজিরেরই প্রাপ্য। এ দৃশ্যে উজির ছাড়াও নাজির, আমির, ওমরাহ প্রভৃতিদের অনেককেই ক্ষুব্ধ করল।

ঈর্ষান্বিত উজির রাগে-দুঃখে অপমানে ফুঁসতে লাগলেন। আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। ফ্যাকাসে-বিবর্ণ মুখে সুলতানের সামনে এসে কুর্নিশ করে বলেন— 'জাহাপনা আল্লাতাল্লার কাছে
আপনার সুখী ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি! আপনার কাছে একটা আর্জি আছে। যদি অনুমতি করেন—
-কি? কি সে-আর্জি? যা বলতে চাইছেন নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করতে পারেন।

যে ব্যক্তি শ্রদ্ধার সঙ্গে বকশিস গ্রহণ করে না, শ্রদ্ধার লেশমাত্রও যার মধ্যে নেই তাকে দান করার অর্থই হচ্ছে অযোগ্যকে ও অপাত্রে দান করা।

সুলতান উনান গর্জে উঠলেন— ধানাইপানাই রেখে যা বলতে চাইছেন, খোলসা করে বলুন। কে সে শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি? কাকে দান করে আমি ভষ্মে ঘি ঢালছি?

উজির এবার মনে সাহস অবলম্বন করে, হেকিমের দিকে, অঙ্গুলি নিদের্শ করে বলেন— 'এ-ই সেই দানের অযোগ্য ব্যক্তি।
এরকম বেঈমান তামাম দুনিয়ায় দ্বিতীয় আর একজন আছে কিনা সন্দেহ। আপনি দরাজ হাতে যেভাবে বিলোতে শুরু করেছেন, তাতে দেখা যাবে শীঘ্রই আপনার তহবিল শুন্য হয়ে গেছে।

সুলতান উনান ধমক দিয়ে উঠলেন— 'মুখ সামলে কথা বলবেন! আপনার স্পর্ধা তো কম নয়। আমার কাজের সমালোচনা করছেন!'
আর কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন তা হয়ত আপনি নিজেও জানেন না। হেকিম সাহেব আমার জান ফিরিয়ে দিয়েছেন। নইলে এতদিনে হয়ত আমার অশ্রয় হ'ত গোরস্থানের মাটির তলায়। উপকারীর ঋণ শোধ হয় না। আমার বিশ্বাস, আমার রাজ্যটা তাঁর হাতে তুলে দিলেও তাঁর প্রাপ্যের চেয়ে কমই দেওয়া হত। আসলে আপনার দিল জুড়ে রয়েছে ঈর্ষা। তাই এরকম উক্তি প্রকাশ করতে পারলেন। এক সময় আমার এক সভাসদ এরকম ঘটনাসম্বলিত বাদশাহ সিবাদের কিস্সা
আমাকে শুনিয়েছিল।

হেকিম রায়ান সুলতানের অনুমতি নিয়ে দরবার কক্ষ ত্যাগ করলেন।


কিস্সা বলতে বলতে বেগম শাহরাজাদ দেখেন, প্রাসাদের বাইরের বাগিচায় প্রভাতের আলো ফুটতে শুরু করেছে। তিনি কিস্সা বলা এবার বন্ধ করলেন।
দুনিয়াজাদ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলল— 'বহিনজী, তোমার মুখের কিস্সা যত শুনি ততই যেন শুনতে মন চায়।'

বেগম শাহরাজাদ মুচকি হেসে বল্‌লেন— 'বহিন, যদি আমার জান বাঁচে তবে আরও কত সুন্দর সুন্দর কিস্সা শোনাতে পারব!’

বাদশাহ মনে মনে বল্‌লেন — এমন সুন্দর কিস্সা শোনার লোভে অন্ততঃ একে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে হবে।'