ও আমার  দেশের মাটি, তোমার 'পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে  বিশ্বময়ীর,  তোমাতে   বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা ॥

তুমি  মিশেছ মোর দেহের সনে,
তুমি  মিলেছ মোর প্রাণে মনে,
তোমার ওই  শ্যামলবরন কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা ॥

ওগো মা,  তোমার কোলে জনম আমার, মরণ তোমার বুকে।
তোমার 'পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে।
তুমি  অন্ন মুখে তুলে দিলে,
তুমি  শীতল জলে জুড়াইলে,
তুমি যে  সকল-সহা সকল-বহা মাতার মাতা ॥

ও মা,  অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা--
তবু  জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!
আমার  জনম গেল বৃথা কাজে,
আমি  কাটানু দিন ঘরের মাঝে--
তুমি  বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা ॥



Song: O Amar Desher Mati
Singer: Imam Chakraborty
Lyrics: Rabindranath Tagore








ও অকূলের কূল ও অগতির গতি

ও অকূলের কূল, ও অগতির গতি,
ও অনাথের নাথ, ও পতিতের পতি।

ও নয়নের আলো, ও রসনার মধু,
ও রতনের হার, ও পরানের বঁধু।

ও অপরূপ রূপ, ও মনোহর কথা,
ও চরমের সুখ, ও মরমের ব্যথা।

ও ভিখারির ধন, ও অবোলার বোল--
ও জনমের দোলা, ও মরণের কোল ॥








ও জোনাকী কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ

ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ।
আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ॥

তুমি  নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র,
তোমার   তাই ব'লে কি কম আনন্দ।
তুমি  আপন জীবন পূর্ণ ক'রে আপন আলো জ্বেলেছ॥

তোমার  যা আছে তা তোমার আছে,
তুমি   নও গো ঋণী কারো কাছে,
তোমার  অন্তরে যে শক্তি আছে তারি আদেশ পেলেছ।

তুমি  আঁধার-বাঁধন ছাড়িয়ে ওঠ,
তুমি  ছোটো হয়ে নও গো ছোটো,
জগতে  যেথায় যত আলো সবায় আপন ক'রে ফেলেছ॥







ও দেখা দিয়ে যে চলে গেল

ও  দেখা দিয়ে যে চলে গেল
ও  চুপিচুপি কী বলে গেল।
যেতে যেতে গো, কাননেতে গো
ও  কত যে ফুলে দ'লে গেল॥

মনে মনে কী ভাবে কে জানে,
মেতে আছে ও যেন কী গানে,
নয়ন হানে আকাশ-পানে--
চাঁদের হিয়া গ'লে গেল॥

ও  পায়ে পায়ে যে বাজায়ে চলে
বীণার ধ্বনি তৃণের দলে।
কে জানে কারে ভালো কি বাসে,
বুঝিতে নারি কাঁদে কি হাসে,
জানি নে ও কি ফিরিয়া আসে--
জানি নে ও কি ছ'লে গেল॥





ও মঞ্জরী ও মঞ্জরী আমের মঞ্জরী

ও মঞ্জরী, ও মঞ্জরী আমের মঞ্জরী,
আজ  হৃদয় তোমার উদাস হয়ে পড়ছে কি ঝরি॥

আমার  গান যে তোমার গন্ধে মিশে  দিশে দিশে
ফিরে ফিরে ফেরে গুঞ্জরি॥

পূর্ণিমাচাঁদ তোমার শাখায় শাখায়
তোমার  গন্ধ-সাথে আপন আলো মাখায়।

ওই  দখিন-বাতাস গন্ধে পাগল  ভাঙল আগল,
ঘিরে ঘিরে ফিরে সঞ্চরি॥







ওই আসনতলের মাটির পরে লুটিয়ে রব

ওই  আসনতলের মাটির 'পরে লুটিয়ে রব।
তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব।

কেন আমায় মান দিয়ে আর দূরে রাখ,
চিরজনম এমন করে ভুলিয়ো নাকো,
অসম্মানে আনো টেনে পায়ে তব।
তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব॥

আমি তোমার যাত্রীদলের রব পিছে,
স্থান দিয়ো হে আমায় তুমি সবার নীচে।
প্রসাদ লাগি কত লোকে আসে ধেয়ে,
আমি কিছুই চাইব না তো রইব চেয়ে;
সবার শেষে বাকি যা রয় তাহাই লব।
তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব॥







ওই পোহাইল তিমিররাতি

ওই পোহাইল তিমিররাতি।
পূর্বগগনে দেখা দিল নব প্রভাতছটা,
জীবনে-যৌবনে হৃদয়ে-বাহিরে
প্রকাশিল অতি অপরূপ মধুর ভাতি ॥

কে পাঠালে এ শুভদিন নিদ্রা-মাঝে,
মহা মহোল্লাসে জাগাইলে চরাচর,
সুমঙ্গল আশীর্বাদ বরষিলে
করি প্রচার সুখবারতা--
তুমি চির সাথের সাথি ॥









ওই মরণের সাগরপারে চুপে চুপে

ওই মরণের সাগরপারে চুপে চুপে
এলে তুমি ভুবনমোহন স্বপনরূপে ॥

কান্না আমার সারা প্রহর তোমায় ডেকে
ঘুরেছিল চারি দিকের বাধায় ঠেকে,
বন্ধ ছিলেম এই জীবনের অন্ধকূপে--
আজ এসেছ ভুবনমোহন স্বপনরূপে ॥

আজ কী দেখি কালো চুলের আঁধার ঢালা,
তারি  স্তরে স্তরে সন্ধ্যাতারার মানিক জ্বালা।
আকাশ আজি গানের ব্যথায় ভরে আছে,
ঝিল্লিরবে কাঁপে তোমার পায়ের কাছে,
বন্দনা তোর পুষ্পবনের গন্ধধূপে--
আজ এসেছ ভুবনমোহন স্বপনরূপে ॥







ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে

ওই-যে ঝড়ের মেঘের কোলে
বৃষ্টি আসে মুক্তকেশে আঁচলখানি দোলে॥

ওরই গানের তালে তালে
আমে জামে শিরীষ শালে
নাচন লাগে পাতায় পাতায়
আকুল কল্লোলে॥

আমার  দুই আঁখি ওই সুরে
যায় হারিয়ে সজল ধারায়
ওই ছায়াময় দূরে।

ভিজে হাওয়ায় থেকে থেকে
কোন্‌ সাথি মোর যায় যে ডেকে,
একলা দিনের বুকের ভিতর
ব্যথার তুফান তোলে॥






ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না

ওকে  ধরিলে তো ধরা দেবে না--
ওকে  দাও ছেড়ে, দাও ছেড়ে।
মন  নাই যদি  দিল, নাই দিল,
মন  নেয় যদি নিক কেড়ে॥

এ কী খেলা মোরা খেলেছি,
শুধু  নয়নের জল ফেলেছি--
ওরই  জয় যদি হয় জয় হোক,
মোরা  হারি যদি, যাই হেরে॥

এক দিন মিছে আদরে
মনে  গরব সোহাগ না ধরে,  
শেষে  দিন না ফুরাতে ফুরাতে
সব  গরব দিয়েছে সেরে।  

ভেবেছিনু ওকে চিনেছি,
বুঝি  বিনা পণে ওকে কিনেছি--
ও যে  আমাদেরি কিনে নিয়েছে,
ও যে,  তাই আসে, তাই ফেরে॥







ওগো তোরা কে যাবি পারে

ওগো, তোরা কে যাবি পারে।
আমি  তরী নিয়ে বসে আছি নদীকিনারে॥
ও পারেতে উপবনে
কত খেলা কত জনে,
এ পারেতে ধু ধু মরু বারি বিনা রে॥

এই বেলা বেলা আছে, আয় কে যাবি।
মিছে কেন কাটে কাল কত কী ভাবি।
সূর্য পাটে যাবে নেমে,
সুবাতাস যাবে থেমে,
খেয়া বন্ধ হয়ে যাবে সন্ধ্যা-আঁধারে॥







ওগো দখিন হাওয়া ও পথিক হাওয়া

ওগো  দখিন হাওয়া, ও  পথিক হাওয়া,
দোদুল দোলায় দাও দুলিয়ে।
নূতন-পাতার-পুলক-ছাওয়া
পরশখানি দাও বুলিয়ে॥

আমি  পথের ধারের ব্যাকুল বেণু
হঠাৎ তোমার সাড়া পেনু গো--
আহা,  এস আমার শাখায় শাখায়
প্রাণের গানের ঢেউ তুলিয়ে॥

ওগো  দখিন হাওয়া,  ও  পথিক হাওয়া,
পথের ধারে আমার বাসা।
জানি তোমার আসা-যাওয়া,
শুনি তোমার পায়ের ভাষা।

আমায়  তোমার ছোঁওয়া লাগলে পরে
একটুকুতেই কাঁপন ধরে গো--
আহা,  কানে-কানে একটি কথায়
সকল কথা নেয় ভুলিয়ে॥







ওগো শেফালিবনের মনের কামনা

ওগো  শেফালিবনের মনের কামনা,
কেন  সুদূর গগনে গগনে
আছ  মিলায়ে পবনে পবনে।
কেন  কিরণে কিরণে ঝলিয়া
যাও  শিশিরে শিশিরে গলিয়া।
কেন  চপল আলোতে ছায়াতে
আছ  লুকায়ে আপন মায়াতে।
তুমি  মুরতি ধরিয়া চকিতে নামো-না,
ওগো  শেফালিবনের মনের কামনা ॥

আজি  মাঠে মাঠে চলো বিহরি,
তৃণ  উঠুক শিহরি শিহরি।
নামো  তালপল্লববীজনে,
নামো  জলে ছায়াছবিসৃজনে।
এসো  সৌরভ ভরি আঁচলে,
আঁখি  আঁকিয়া সুনীল কাজলে।
মম  চোখের সমুখে ক্ষণেক থামো-না,
ওগো  শেফালিবনের মনের কামনা ॥

ওগো  সোনার স্বপন, সাধের সাধনা,
কত  আকুল হাসি ও রোদনে,
রাতে  দিবসে স্বপনে বোধনে,
জ্বালি  জোনাকি প্রদীপমালিকা,
ভরি  নিশীথতিমিরথালিকা,
প্রাতে  কুসুমের সাজি সাজায়ে,
সাঁজে  ঝিল্লি-ঝাঁঝর বাজায়ে,
কত  করেছে তোমার স্তুতি-আরাধনা,
ওগো  সোনার স্বপন, সাধের সাধনা ॥

ওই  বসেছ শুভ্র আসনে
আজি  নিখিলের সম্‌ভাষণে।
আহা  শ্বেতচন্দনতিলকে
আজি  তোমারে সাজায়ে দিল কে।
আহা  বরিল তোমারে কে আজি
তার  দুঃখশয়ন তেয়াজি--
তুমি  ঘুচালে কাহার বিরহকাঁদনা,
ওগো  সোনার স্বপন, সাধের সাধনা ॥






ওরে ওরে  ওরে আমার মন মেতেছে

ওরে ওরে  ওরে, আমার মন মেতেছে,
তারে আজ  থামায় কে রে।
সে যে  আকাশ-পানে হাত পেতেছে,
তারে আজ   নামায় কে রে।
ওরে ওরে  ওরে, আমার মন মেতেছে,
আমারে  থামায় কে রে॥

ওরে ভাই,  নাচ্‌ রে ও ভাই, নাচ্‌ রে--
আজ  ছাড়া পেয়ে বাঁচ্‌ রে--
লাজ ভয়  ঘুচিয়ে দে রে।
তোরে আজ  থামায় কে রে॥






ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে

ওরে ভাই,  ফাগুন লেগেছে বনে বনে--
ডালে ডালে ফুলে ফুলে
পাতায় পাতায় রে,
আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে॥

রঙে রঙে রঙিল আকাশ,
গানে গানে নিখিল উদাস--
যেন চল-চঞ্চল নব পল্লবদল
মর্মরে মোর মনে মনে ॥

হেরো  হেরো অবনীর রঙ্গ,
গগনের করে তপোভঙ্গ।
হাসির আঘাতে  তার মৌন রহে না আর,
কেঁপে কেঁপে ওঠে খনে খনে।

বাতাস ছুটিছে বনময় রে,
ফুলের না জানে পরিচয় রে।
তাই বুঝি বারে বারে  কুঞ্জের দ্বারে দ্বারে
শুধায়ে ফিরিছে জনে জনে॥







ওরে ভাই মিথ্যা ভেবো না

ওরে ভাই, মিথ্যা ভেবো না ।
হবার নয় যা কোনোমতেই হবেই না সে,  হতে দেব না ।।

পড়ব না রে ধুলায় লুটে,
যাবে না রে বাঁধন টুটে— যেতে দেব না ।
মাথা যাতে নত হবে এমন বোঝা মাথায় নেব না ॥

দুঃখ আছে, দুঃখ পেতেই হবে—
যত দূরে যাবার আছে সে তো যেতেই হবে ।
উপর-পানে চেয়ে ওরে
ব্যথা নে রে বক্ষে ধ’রে— নে রে সকলে ।
নি:সহায়ের সহায় যিনি বাজবে তাঁরে তোদের বেদনা ॥






ওহে সুন্দর মরি মরি

ওহে  সুন্দর, মরি মরি,
তোমায়  কী দিয়ে বরণ করি ॥

তব  ফাল্গুন যেন আসে
আজি  মোর পরানের পাশে,
দেয়  সুধারসধারে-ধারে
মম  অঞ্জলি ভরি ভরি ॥

মধু  সমীর দিগঞ্চলে
আনে  পুলকপূজাঞ্জলি--
মম  হৃদয়ের পথতলে
যেন  চঞ্চল আসে চলি।

মম  মনের বনের শাখে
যেন  নিখিল কোকিল ডাকে,
যেন  মঞ্জরীদীপশিখা
নীল  অম্বরে রাখে ধরি ॥