পঞ্চমরাত্রে বাদশাহ শাহরিয়ার-এর আগ্রহে বেগম শাহরাজাদ আবার কিস্সা ফাঁদলেন—
জাঁহাপনা, সেই সুলতান উনান তাঁর উজিরকে নানা ভাষায় তিরস্কার করতে লাগলেন। বাদশাহ সিনবাদ যেমন তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় বাজপাখিটাকে হত্যা করে অনুশোচনায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়েছিলেন আপনি চান আমিও তেমনি জ্বলে পুড়ে মরি?’

সুলতান বল্‌লেন— বলছি তবে শুনুন,— কোন এক সময়ে কার নগরে এক বাদশাহ রাজত্ব করতেন। তাঁর নাম ছিল বাদশাহ সিনবাদ।
ঘোড়ায় চড়া, মাছ ধরা, শিকার আর খেলকুদ প্রভৃতিতে তিনি খুবই উৎসাহী ও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর একটা পোষা বাজপাখি ছিল। প্রাণাধিক ভালবাসতেন তাকে। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা সেটাকে কাছে কাছে রাখতেন। এমন কি শিকারে যাওয়ার সময়ও পাখিটা তাঁর সঙ্গে থাকত। পানি খাওয়ার জন্য একটা সোনার বাটি, সোনার শিকল দিয়ে তার গলায় বেঁধে রাখা হত।

বাজপাখিটার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক একদিন দরবারে বাদশাহকে এসে বলল— 'হুজুর, আজকের রাত্রিটা শিকারের পক্ষে বিশেষ উপযোগী। মন চাইলে চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।'

লোকলস্কর, অস্ত্রশস্ত্র আর বিশ্রামের জন্য তাঁবু প্রভৃতি গুছিয়ে ইয়ার দোস্তদের নিয়ে বাদশাহ সিনবাদ শিকারের উদ্দেশে যাত্রা করলেন।

এক পাহাড়ের গায়ে প্রশস্ত এবং প্রায় সমতল এক জায়গা দেখে তাঁবু ফেলা হ’ল। শিকারের জন্য জাল পাতা হ’ল। কিন্তু কার্যত একটা বুনো-ছাগল ছাড়া জালে কিছুই আটকালো না।

বাদশাহ সিনবাদ সবাইকে সতর্ক করে দিলেন—'বুনো-ছাগলটাকে যেন পালাতে দেওয়া না হয়। যার কাছ থেকে ওটা পালাবে তার গর্দান নিয়ে ছাড়ব।'
খুবই সতর্কতার সঙ্গে জাল গুটিয়ে বুনো-ছাগলটাকে বাদশাহের কাছাকাছি নিয়ে আসা হ’ল। সেটা পিছনের পা দুটোতে ভর দিয়ে প্রায় সোজা হয়ে বিচিত্র এক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর সামনের পা দুটো জোড়া করে বাদশাহের দিকে তুলে ধরল। ব্যাপারটা এমন, সে
যেন তাকে সালাম জানাচ্ছে। এতে বাদশাহসহ সবাই সরবে করতালি দিয়ে উঠল। তাদের অন্যমনস্কতার সুযোগের সদ্ব্যবহার করল বুনো-
ছাগলটা। আচমকা এক লাফ দিয়ে বাদশাহকে ডিঙিয়ে একেবারে লম্বা লাফ দিল। দ্রুতগতিতে গভীর জঙ্গলের দিকে ছুটছিল। মুহূর্তে বাদশাহ
নিজেকে সামলে নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে বুনো ছাগলটার পিছু নিলেন।
তাঁর একটামাত্র টুকরো কথা শোনা গেল– ‘আমার হাত থেকে পালিয়ে কেউ-ই রেহাই পায় নি। যে করেই হোক তোকে আমি ধরবই ধরবই।'

বেশ কিছুক্ষণ পর গভীর জঙ্গলে বুনো-ছাগলটার হদিস মিলল বটে কিন্তু কিছুতেই তাকে নাগালের মধ্যে পেলেন না। কাজ হাসিল করল তাঁর জিগরি দোস্ত বাজপাখিটা। সে বাতাসের বেগে উড়ে গিয়ে
সুতীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে বুনো ছাগলটার চোখের মণি দুটো গেলে দিল। বিকট আর্তনাদ করে সেটা হুমড়ি খেয়ে ঝোপের মধ্যে পড়ে গেল। ব্যস, খেল্ খতম!

বাদশাহ সিনবাদ বহুকষ্ট করে বুনো-ছাগলটার গা থেকে চামড়া ছাড়িয়ে ঘোড়ার জিনের তলায় লটকে দিলেন। এবার তাঁবুর দিকে যাত্রা করলেন। কিছুদূর এসে তিনি এবং তাঁর বাহন তাগড়াই
ঘোড়াটা— উভয়েই পিয়াসে পাগল। পানি বিনা জান রাখা দায়।

কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর তিনি একটা ঝাঁকড়া গাছের নিচে ছোট্ট একটা তলাও দেখতে পেলেন। কাছে যেতেই তিনি অবাক মানলেন।
তলাওটার পানি যেন খুবই ঘন মনে হ’ল—থকথকে। আটাগোলা সিন্নির মত।

বাদশাহ সিনবাদ তার জিগরি দোস্ত বাজপাখির গলা থেকে সোনার বাটিটা খুলে ওই থকথকে পানি নিয়ে এলেন। বাজপাখিটার সামনে ধরলেন পানিভর্তি বাটিটাকে। সে পানি তো পান করলই না, উপরস্তু ঠোঁট দিয়ে সজোরে এক ধাক্কা দিয়ে বাটিটাকে দূরে ফেলে দিল।

সিনবাদ তার আচরণে খুব বিরক্ত হলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার গিয়ে একবাটি পানি নিয়ে এলেন। এবার ঘোড়াটার মুখের সামনে ধরামাত্র বাজপাখিটা উড়ে গিয়ে ডানা দিয়ে ধাক্কা মেরে
বাটিটাকে ফেলে দিল। রাগে গসগস্ করতে করতে বাদশাহ কটিদেশ থেকে তরবারি টেনে নিয়ে দিলেন সজোরে এক কোপ বসিয়ে। ব্যস, চোখের পলকে তার একটা ডানা কেটে গেল। ফিন্‌কি দিয়ে খুন
বেরিয়ে এল। বাদশাহ আপন মনে ব’লে উঠলেন—‘এর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। নিজে তো খেলই না, অন্য কাউকেও পানি খেতে দেবে না! বাঃ চমৎকার মতলব! বাজপাখিটার কিন্তু নিজের যন্ত্রণাকাতর দেহের দিকে কিছুমাত্রও নজর নেই। ঘাড় তুলে সে
মাথার ওপরের গাছটাকে দেখতে লাগল। বাদশাহ সিনবাদ এবার ঘাড় ঘুরিয়ে গাছটার দিকে চোখ ফেরাতেই চমকে উঠলেন। দেখলেন, গাছের ডালে অসংখ্য ময়াল সাপ ঝুলছে। তাদের মুখ থেকে হরদম লালা জাতীয় তরল পদার্থ বেরিয়ে তলাও-এ পড়ছে। কৃতকর্মের জন্য তিনি অনুশোচনায় জ্বলে পুড়ে খাঁক হতে লাগলেন।

বিষণ্ণ মনে বাদশাহ সিনবাদ প্রাসাদে ফিরে এলেন। ছালছাড়ানো বুনো ছাগলটাকে রান্না করার জন্য রসুইকরকে নির্দেশ দিলেন। আহত বাজপাখিটা এতক্ষণ জীবিত ছিল। এবার মাথা কাৎ করে পড়ে গেল। ব্যস, খতম।

বাদশাহ সিনবাদ আর্তনাদ করে উঠলেন—'আমার জিগরি দোস্তকে আমি নিজেহাতে খতম করেছি!'

কিস্সা শেষ করে বাদশাহ উনান এবার থামলেন।

বৃদ্ধ উজির এবার সবিস্ময়ে বলেন—
'হুজুর, আপনার এ কিস্সার সঙ্গে আমার বক্তব্যের সম্পর্ক কি, বুঝতে পারলাম না তো!
আপনি হয়তো বলতে চাইছেন, বাদশাহ সিনবাদ তাঁর জান, তাঁর জিগরি দোস্ত বাজপাখিকে নিজের হাতে খুন করার জন্য অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছিলেন, ঠিক কিনা? কিন্তু হেকিম রায়ান কি আপনার সত্যিকারের জিগরি দোস্ত? অবশ্যই না। লোকটা ধান্দাবাজ, জাহাপনা, আপনি এখন বুড়ো হেকিমের মোহে অন্ধ। তার দোষ-গুণ সম্বন্ধে বিচার করার মত বিবেচনাবোধ আপনার লোপ পেয়েছে।
আপনি কি সেই উজির আর বাদশাহের লেড়কার কিস্সা জানেন?
বাদশাহের লেড়কাকে খতম করতে গিয়ে উজির নিজেই জান দিয়েছিলেন। আপনি নিজের কবর নিজেই খুড়তে চলেছেন।'


বাদশাহ রায়ান জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে উজিরের দিকে তাকালেন। উজির তাঁর কিস্সা শুরু করলেন—

কোন এক দেশে এক বাদশাহ রাজত্ব করতেন। তাঁর একটা লেড়কা ছিল। শিকার আর ঘোড়ায় চড়ার দিকে তার ছিল খুব ঝোঁক। এক উজিরের ওপর লেড়কার দেখভালের দায়িত্ব বর্তাল। এ-কাজকে উজির মোটেই সুনজরে দেখলেন না। তার সম্মান এতে নাকি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ থেকে তিনি রেহাই পাওয়ার পথ খুঁজতে লাগলেন। দরবারে বসতে না পারলে উজিরের সম্মান থাকে নাকি ছাই।

এক সকালে উজির বাদশাহের লেড়কাকে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে শিকারে বেরোলেন। পথে তাদের সামনে বিচিত্র দর্শন এক জন্তুকে দেখতে পেলেন তাঁরা। হতচ্ছাড়াটা পথ আগলে দাঁড়িয়ে।
বাদশাহের লেড়কা জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল জন্তুটাকে ধরার জন্য। কিন্তু পারল না। সেটা চোখের পলকে কোথায় গা-ঢাকা দিল। কিন্তু ফায়দা! যেটুকু তা হ’ল সে পথ হারিয়ে ফেলল। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অচেনা পথে কাঁদতে কাঁদতে সে পথ চলতে লাগল ।

কিছুদূর যেতেই পথের ধারে এক লেড়কিকে সে দেখতে পেল। ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। খুবসুরৎ দেখতে। সে লেড়কিটাকে জিজ্ঞাসা করল— কে গা তুমি? এমন করে কাঁদছ কেন?’

লেড়কিটা বলল— ‘আমি হিন্দের শাহজাদী। আমার দলের লোকদের হারিয়ে ফেলেছি। বড়ই অসহায় হয়ে পড়েছি।'

বাদশাহের লেড়কা হিন্দের শাহজাদীকে নিজের ঘোড়ার পিঠে তুলে নিল। কিছুদূর গিয়ে পথে একটা ভাঙাচোরা পোড়ো বাড়ি দেখতে পেল।

শাহজাদী ঘোড়া থামাতে বলল। সে একবারটি ‘ছোট-বাথরুম’- এ যাবে। সে বাড়িটার ভেতরে ঢুকে গেল। বদশাহের লেড়কা ঘোড়া নিয়ে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও শাহজাদী ফিরছে না দেখে তার কৌতূহল হ’ল। ঘোড়াটাকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে পোড়ো বাড়িটার ভেতরে ঢুকে গেল।
আড়াল থেকে দেখতে পেল, শাহজাদী এক রাক্ষসীর অবয়ব ধারণ করেছে। ঘরের ভেতরে আরো দুটো রাক্ষসী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বুড়ো
আর বুড়ি রাক্ষসী। মেয়েটা বলল– আজ তোমাদের জন্য একটা মোটাসোটা মানুষ ধরে এনেছি। জিভ দুটোকে বেশ একটু ঝালিয়ে
নিতে পারবে।'

বুড়ি-রাক্ষসী বলল—‘তাই বুঝি? কোথায় রেখেছিস বেটি? নিয়ে আয়। তার গোস্তে উপোষ ভঙ্গ করি।'
কথাগুলো কানে যেতেই বাদশাহের লেড়কার কলিজা শুকিয়ে গেল। কোনরকমে সে জান নিয়ে ভাগতে চেষ্টা করল। পারল না।

এরই মধ্যে রাক্ষসী-মেয়েটা আগের সে রূপবতীর চেহারা নিয়ে দরজার বাইরে চলে এসেছে।বাদশাহের লেড়কাকে বলল- কি ব্যাপার তোমার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ, কাঁপছ, ব্যাপার কি?

—বোধ হয় আমি শত্রুর ডেরায় এসে পড়েছি।'
—শত্রুর ডেরায়? তুমিই তো বলেছিলে তুমি নাকি বাদশাহের লেড়কা। তবে ধনদৌলত নিয়ে তাদের বশীভূত করে ফেলছ না কেন? শত্রুকে বশ করতে আবার দেরী হয় নাকি?'
—এরা ধনদৌলতে ভুলবার নয়। আমার গায়ের নরম গোস্তের দিকে এদের নজর।'

এদের নজর। মেয়েটা চমকে উঠল। ভাবল, তবে কি আমার ফন্দি ফিকিরের কথা জানতে পেরে গেছে? তবে তো একে ভুলিয়ে ভালিয়ে বাড়ির
ভেতরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এবার বাদশাহের লেড়কাকে লক্ষ্য করে বলল— "তবে এক কাজ করো, আল্লাতাল্লার নাম করো। একমাত্র তিনিই যদি পারেন রক্ষা করতে।'

বাদশাহের লেড়কা এবার হাঁটুগেড়ে বসে আল্লাতাল্লার নাম করতে লাগল। কয়েক মুহূর্ত পরে আঁখি খুলে দেখে মেয়েটা এরই মধ্যে ভেগেছে।

বাদশাহের লেড়কা সুযোগ বুঝে সেখান থেকে চম্পট দিল। প্রাসাদে ফিরে সে তার বাবার কাছে ঘটনার বিবরণ দিল। সব শুনে বাদশাহ তো রেগে একেবারে কাঁই। উজির নিজের কাজে গাফিলতি
করার জন্যই তাঁর লেড়কা বিপদে পড়েছিল। এমনও হতে পারে এর সঙ্গে তাঁরও সাঁট রয়েছে। ঘাতক ডেকে তাঁর গদান নেবার আদেশ দিলেন।

কিস্সা শেষ করে উজির বাদশাহ উনানকে বললেন—
‘জাঁহাপনা, আমার মনে যদি এরকম কোন কুমতলব রয়েছ প্রমাণ হয় তবে আপনি আমাকে যে শাস্তি দেবেন হাসিমুখে তা বরণ করে নেব।
এরপরও আমি বলছি, যাকে আপনি দরাজ হাতে পুরস্কার দিয়ে তার মন ভরতে প্রয়াসী হচ্ছেন, সে আপনার শত্রু ছাড়া মিত্র অবশ্যই নয়।

আপনি শুনে রাখুন, সে ভিদেশের গুপ্তচর। সে আপনার জান খতম করার ফিকির খুঁজছে। এমনকি আমার জান যাওয়াও কিছুমাত্র বিচিত্র
নয়।

বাদশাহ বল্‌লেন— তবে আমার এখন কর্তব্য কি?
দরবারে আপনার সামনে তাকে হাজির হতে বলুন হুজুর। যত শীঘ্র সম্ভব তার গর্দান নেবার ব্যবস্থা করুন। আপনার গায়ে কাঁটার আঁচড় দেওয়ার আগেই তার জান নিয়ে নিন।

বাদশাহের নির্দেশে এবার হেকিম রায়ান-এর খোঁজে দূত ছুটল। রায়ান খবর পেয়ে নিজেই ব্যস্ত হয়ে দরবারে ছুটে এলেন। হতভাগ্য তো জানেনও না মৃত্যু তাঁর চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেবল হাত
বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরার সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।

বাদশাহ উনান গম্ভীর স্বরে বলেন— 'আপনি কি জানেন হেকিম সাহেব, কোতল করব বলে আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি?’

– কিন্তু আমার অপরাধ কি তা তো অবশ্যই বলবেন, আশা করি।'
—আমার সভাসদরা আমাকে ফুঁসলাচ্ছে, আপনি নাকি গুপ্তচর বৃত্তি নিয়ে আমার সভায় অবস্থান করছেন? আমাকে গোপনে খুন করার চক্রান্ত নাকি আপনার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ? তাই আমার জান বাঁচাতে হলে আপনাকে আগেভাগেই কোতল করতে হবে।' কথা বলতে বলতে বাদশাহ করতালি দিয়ে ঘাতককে ডাকলেন।

ঘাতক এসে কুর্ণিশ করে বাদশাহের সামনে দাঁড়ালো।

বাদশাহ উনান বলেন— ‘এ বিশ্বাসঘাতককে কোতল করতে হবে। নিয়ে যাও।’

হেকিম রায়ান সবিস্ময়ে বল্‌লেন— 'জাঁহাপনা, আমি আপনাকে দুরারোগ্য ব্যাধিমুক্ত করেছি। তার প্রতিদান দিচ্ছেন আমার গর্দান নিয়ে? চমৎকার আপনার বিবেক, চমৎকার আপনার মানবিকতা!’

—‘আমার সাফ কথা শুনুন হেকিম সাহেব, আপনার ওপর থেকে আমার বিশ্বাস উবে গেছে। সামান্য একটা লাঠির সাহায্যে ইলাজ করে আপনি যখন আমার এমন কঠিন বিমারি সারিয়ে তুলতে পেরেছেন। তখন আপনার অসাধ্য কোন কাজই নেই। তাই আপনার গর্দান নেবার মাধ্যমেই আমি আমার জীবনের নিরাপত্তা আনতে চাই। ফুলের গন্ধ বা অন্য কোন কিছুর গন্ধ শুকিয়েও আমাকে হত্যা করা আপনার পক্ষে অসাধ্য নয়।'

—জাঁহাপনা, আপনার বিচারে এ-পুরস্কার কি আমার কাজের উপযুক্ত প্রাপ্য বলে মনে করব?'

–মৃত্যু—হ্যাঁ, মৃত্যুই আপনার একমাত্র প্রাপ্য।

হেকিম রায়ান নিঃসন্দেহ হলেন, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। নিশ্চিন্ত মৃত্যুর চিন্তায়, তাঁর দু' চোখের কোণ বেয়ে পানির ধারা নেমে এল।

কর্মফল কৃতকর্মের ফল। উপযাচক হয়ে উপকার করতে এসে নিজের জান দিতে হচ্ছে। একেই বলে চরমতম দুর্গতি। গ্রহের ফের ছাড়া আর কি-ই বা একে ভাবা যেতে পারে? চমৎকার বিচার। নসীবের
ফের।

ঘাতক হেকিম রায়ানকে আর কিছু বলার বা ভাববার সুযোগ না দিয়ে আচমকা একটি কালো কাপড় দিয়ে তাঁর চোখ দুটো বেঁধে ফেলল। তারপর কোমর থেকে এক ঝটকায় তরবারি খুলে নিয়ে
তাঁকে আঘাত করতে উদ্যত হ'ল।

হেকিম রায়ান আর্তনাদ করে বললেন— ‘এ আপনি করছেন কি জাঁহাপনা ! মৃত্যুদণ্ডাদেশ তুলে নিন! আমাকে মুক্তি দিন। নইলে খোদা আপনাকে ক্ষমা করবেন না। আপনার সর্বনাশ অবধারিত!

—‘বাদশাহ উনান একবার যে হুকুম দেয় তা কি করে প্রত্যাহার করতে হয় তার জানা নেই।'

—‘হায় আল্লাহ! এ-ই কি তোমার বিচার! এ যে সেই কুমীরের শয়তানীর মত কাণ্ড ঘটতে চলেছে!’

—'কুমীরের কিস্সা কি বলুন তো শুনি।'

—'না জাঁহাপনা, জান দেবার পূর্ব মুহূর্তে আপনাকে সে-কাহিনী আর না-ই বা শোনালাম, আমাকে জান বাঁচিয়ে দিন, খোদা আপনার মঙ্গল করবেন।'


হেকিম রায়ান যখন মৃত্যুর জন্য নিজের মনকে তৈরি করছেন, ঠিক তখনই পারিষদদের মধ্য থেকে কয়েকজন বাদশাহের কাজের প্রবল আপত্তি তুললেন। তারা করজোড়ে প্রার্থনা করলে— ‘জাঁহাপনা, যে লোকটি আপনাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে নবজীবন দান করলেন আপনি কিনা তাঁরই জান নেবার জন্য কবুল করেছেন। মেহেরবানি করে ওকে মুক্তি দিন।'

বাদশাহ উনান গর্জে উঠলেন— 'অসম্ভব! আপনারা জানেন লোকটি অমিত ক্ষমতার অধিকারী। যে লোক সামান্য উপায়ে আমার বিমারির ইলাজ করে সারিয়ে তুলেছে সে অতি সহজেই আমার জানও নিয়ে নিতে পারে। তাঁকে জিইয়ে রেখে আমি আমার নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে উৎসাহী নই। তাকে খতম করে দেওয়া ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই।'

কাঁদতে কাঁদতে হেকিম এবার বল্লেন—‘জাঁহাপনা, জান যখন এবার দিতেই হবে তখন কিছু সময়ের জন্য আমাকে একবারটি আমার বাসায় যাবার অনুমতি দিন। ঘরদোর অগোছাল রেখেই আমি
আপনার তলব পেয়ে ছুটে এসেছি। সেগুলো সব গোছগাছ করে বন্ধু ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে আপনার দরবারে আবার ফিরে আসব, কবুল করছি।'

বাদশাহ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিমেলে হেকিমের দিকে তাকালেন। হেকিম বলে চল্‌লেন--'জাঁহাপনা, আমার ঘরে কতকগুলো হেকিমী কিতাব রয়েছে। সেগুলো নিয়ে এসে মৃত্যুর আগে আপনার
হাতে তুলে দিতে চাই। সেগুলোতে বিমারির কথা আর তাদের ইলাজের পরামর্শও দেওয়া রয়েছে।'

—“কিতাব? কেমন কিতাব সে-সব?'
—'বিমারি আর ইলাজ দু’–ই পাবেন। আমার মুণ্ডুটি যখন ধড় থেকে নামিয়ে ফেলবেন তখন কিতাবের তিন নম্বর পাতা খুলে তৃতীয় ছত্রটির দিকে চোখ রাখলে দেখবেন আমার কাটা মুণ্ডুটি কথা বলবে।'

—সে কী কথা! এ যে অবিশ্বাস্য কাণ্ড। মুণ্ডুটি ধড় থেকে নামিয়ে দিলে সেটি কথা বলবে! এ কী ভূতুড়ে কাণ্ডরে বাবা!

—হ্যাঁ। আমি সারাজীবনে যেসব অলৌকিক বিদ্যা অর্জন করেছি এটি তাদেরই একটি বিশেষ বিদ্যা।

বাদশাহ উনান-এর কৌতূহল হল। প্রহরীকে নির্দেশ দিলেন, কড়া প্রহরায় হেকিম রায়ানকে তার বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। হেকিম রায়ানকে তাঁর বাসা থেকে ঘুরিয়ে প্রহরীরা কড়া প্রহরায় দরবারে নিয়ে এল। তাঁর এক হাতে প্রাচীন পুঁথির পাণ্ডুলিপি আর
অন্য হাতে দাওয়াইয়ের বাক্স। কিছু ধূলো জাতীয় ওষুধ রয়েছে বাক্সটিতে। এবার বাক্সটি থেকে সামান্য মিহি গুঁড়ো ওষুধ একটি রেকাবিতে ঢেলে বাদশাহকে বল্‌লেন— 'হুজুর, ধড় থেকে আমার
মুণ্ডুটি নামিয়ে দেবার পর খুন বন্ধ করার জন্য মুণ্ডুটিতে সামান্য দাওয়াই লাগিয়ে দেবেন। আর এ-ই সেই কিতাব। তবে, আমার মুণ্ডুচ্ছেদ না করা পর্যন্ত এ কিতাব ভুলেও খুলবেন না যেন। মুণ্ডুটির খুন বন্ধ হয়ে যাবার পর কিতাব খুলে কিতাবের পাতাটি বের করবেন।

বাদশাহ উনান-এর শিরায় শিরায় তখন উত্তেজনা মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠল। হেকিমের কথা ভাল করে শোনাও সম্ভব হ’ল না। দাওয়াইয়ের কিতাবটি হাতে পেয়েই তাঁর নির্দিষ্ট পাতাটি খুলে ফেল্লেন। পর পর দুটো পাতা উল্টে দেখেন কিতাবটিতে কিছুই
লেখা নেই। বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন তিনি— ‘হেকিম, এ কী রকম ধোঁকাবাজি কারবার! আপনার কিতাবে যে কিছুই লেখাঝোকা
নেই!'

ম্লান হেসে হেকিম বলেন—‘আছে জাঁহাপনা। নিশ্চয়ই লেখা আছে। পাতা উল্টে যান। দেখবেন লেখা ঠিকই পাবেন।'
হেকিমের কথায় বাদশাহ, আরও পাতা ওল্টাতে চেষ্টা করেন। ব্যস, খেল শুরু হয়ে গেল। তাঁর সর্বাঙ্গ ক্রমেই কেমন অবশ হয়ে আসতে লাগল ৷ চোখ-মুখ ক্রমেই লাল হয়ে এল। মুখ দিয়ে গেঁজলা
বেরোতে লাগল। পর মুহূর্তে মাথায় চক্কর মারতে লাগল। টাল সামলাতে না পেরে ধপাস্ করে মাটিতে বসে পড়লেন। মুখে কোন কথা নেই। কেবল অস্ফুট স্বরে গোঙাতে লাগলেন—'বিষ!
শক্তিশালী বিষ! বিষের জ্বালা সর্বাঙ্গে। বিষ! বিষ! ব্যস, কণ্ঠরোধ হয়ে এল। সব খতম।


এবার দৈত্যের দিকে ফিরে বল্‌লেন— দৈত্যশ্রেষ্ঠ, বল তো এ- কিস্সা থেকে তুমি কোন শিক্ষা লাভ করলে? যে আদমি অন্যায় কাজে ব্রতী হয় না খোদাতাল্লা সর্বদা তাকে রক্ষা করেন। তুমি বিনা
কসুরে আমার জান নিতে চেয়েছিলে। তিনি তোমাকে উচিত শিক্ষাই দান করলেন।”


শাহরাজাদ কিস্সা শেষ করলে তাঁর ছোটবোন দুনিয়াজাদ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলে উঠল— চমৎকার! তুমি এমন মনলোভা সব কিস্সা ফাঁদতে পার যা হাজার বছর ধরে শুনলেও সাধ মেটেনা
বহিনজী!’
বেগম শাহরাজাদ বল্লেন— 'বহিন, এর চেয়েও সুন্দর ভুরিভুরি কিস্সা আমার মাথায় রয়েছে। যদি জান বাঁচে তবে এর চেয়েও ঢের ভাল ভাল সব কিস্সা তোমাকে শোনাতে পারব।

বাদশাহ শাহরিয়ার বিবি শাহরাজাদ-এর কোলে মাথা রেখে, ভোরের হিমেল হাওয়া পেয়ে অকাতরে ঘুমোতে লাগলেন।

পরদিন ষষ্ঠ রজনী। রাত্রে আবার বাদশাহ শাহরিয়ার অন্দরমহলে, বেগম শাহরাজাদ-এর কাছে এলেন।
শাহরাজাদ কোনরকম ভূমিকা না করেই কিস্সা ফাঁদলেন—'এবার সে-জেলে আফ্রিদি দৈত্যকে বলল– ‘এক সময় আমি তোমার ফাঁদে আটকা পড়েছিলাম। এবার কিন্তু তোমাকে পুরোপুরি আমার হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছি। কৌশলে তোমাকে আবার তোমার জালাটার মধ্যে আবদ্ধ করেছি। ব্যস, আবার তোমাকে জালাসহ সাগরের
পানিতে ডুবিয়ে দেব। দেখি, তুমি কি করে—
জেলের মুখের কথা শেষ হবার আগেই আফ্রিদি দৈত্য করুণ স্বরে আর্তনাদ করে উঠল—

'না, আমাকে সাগরের পানিতে আবার ফেলো না। খোদার দোহাই ! আমাকে জালাটি থেকে বের করে দাও। মেহেরবানি করে আমাকে মুক্তি দাও। বাঁচাও আমাকে। তোমার প্রতি যে আচরণ করতে উদ্যত হয়েছিলাম তার জন্য আমি মর্মাহত, দুঃখিত,
লজ্জিত ! এমন নিষ্ঠুর হোয়ো না। কথায় আছে—– কৃতকর্মের জন্য যদি কোন অধম অনুশোচনায় দগ্ধ হয় তবে তাকে মাফ করে দিতে হয়।
আমাকে মুক্তি দিলে তোমাকে আমি আতিকাহ্র আর উমান-এর কিস্সা শোনাব, কথা দিচ্ছি। আমাকে একবার জালা তেকে মুক্তি দাও, যত কিস্সা তুমি শুনতে চাও প্রাণভরে তোমাকে শোনাব।'

বিদ্রুপের হাসি মুখে ফুটিয়ে তুলে জেলে বলল– ‘আর বোকামি করি কখনও! তোমাকে মুক্তি দিলে তুমি আমার জান না নিয়ে ছাড়বে
নাকি?'