দ্বিতীয় কান্দার ফর্মের তার জীবনের ঘটনাবলী পেশ করার মাধ্যমে তার বাঁ চোখ হারানো এবং দাড়ি-গোঁফ কামানোর কারণ বর্ণনা করল।

এবার বড় মেয়েটার নির্দেশে তৃতীয় কালান্দার ফকির তার জীবনের ঘটনাবলীর কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বললো-
শুনুন আমার বিড়ম্বিত জীবনের কিস্সা। প্রথম আর দ্বিতীয় কালন্দার ফকিরের কিস্সা যেমন রহস্য আর রোমাঞ্চে ভরপুর আমার জীবনে
তেমনি কোন চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেনি যা শুনিয়ে আপনাদের তৃপ্ত করতে পারব। কিন্তু আমি যা কিছু বলব তার একশ ভাগই সত্য, তিলমাত্র খাদ তার মধ্যে নেই।

প্রথমে আমার বাঁ’চাখ হারানোর কথা আপনাদের শোনাচ্ছি। আমি কিন্তু সম্পূর্ণ নিজের দোষেই তা হারিয়েছিলাম। আমার আব্বাজী ছিলেন এক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বাদশাহ পরবর্তীকালে আমি উত্তরাধিকার সূত্রে আব্বাজীর মসনদে বলেছিলাম। আমার কাছ থেকে সুবিচার পেয়ে প্রজারা সুখেই দিনাতিপাত করতো।

বাল্য ও কৈশোরের যে দূরন্তপনার দিনগুলো থেকেই আমার সমূদ্র যাবার প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল। এর কারণ হয়ত এ-ই ছিল যে আমাদের রাজ্যের রাজধনী - নগরটা ছিল সমূদ্রের লাগোয়া।
সমুদ্রের অভ্যন্তরাস্থ নিকট ও দূরবর্তী দ্বীপগুলো আমাদের অধিকারভুক্ত ছিল। আমি মাঝে-মধ্যেই যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে মাসখানেক ধরে চক্কর মেরে বেড়াতাম সমুদ্রের বুকে, দ্বীপে দ্বীপে।
আমি একবার জাহাজ নিয়ে আমাদের অধিকৃত দ্বীপগুলো পরিদর্শনে বেরিয়ে ভয়ঙ্কর সমুদ্র ঝড়ের মুখোমুখি হলাম। সারাদিন, সারারাত্রি ধরে চললো ঝড়ের তান্ডব আর সমুদ্রের ফোঁসফোঁসানি।

সকাল হলে দেখি, আমার জাহাজগুলো ছোট্ট একটা দ্বীপের চড়ায় আটকা পড়ে গেছে। অসহায় বোধ করলাম।

আমি জাহাজগুলোকে নিয়ে মহাফাঁপরে পড়লাম। সাগর তখন একেবারে শান্ত সৌম্য। কেউ ধারণাও করতে পারবে না যে গতরাত্রি পর্যন্ত সাগর প্রলয়ঙ্কর ছিল।

দুইদিন আটকা পড়ে থাকার পর নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই জাহাজে পাল তুলে দিয়ে আবার সাগরে ভাসলাম।

নিরবচ্ছিন্নভাবে কুড়িদিন পাল তোলা জাহাড়ে কাটালাম। কিন্তু হারাণো পথের হদিস তবু পেলাম না। সাগরে ভাসছি তো ভেসেই চলেছি। কোথায় চলেছি, কোন্‌দিকে যে চলেছি কিছুই জানা নেই।

ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তর পাওয়া গেল না। হতাশ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল—
হুজুর, সাগরের এদিকে আমি এর আগে আর কোনদিন আসিনি। এটা একেবারেই অজানা, অচেনা অঞ্চল।

মনটা বিষিয়ে উঠল। উপায়ান্তর না দেখে সাগরের পানিতে একজন ডুবুরিকে নামিয়ে দিলাম। কিছু সময় বাদে সে ভুস করে ভেসে উঠল। সাতরে জাহাজের কাছে এল। দড়ির মই বেয়ে উঠে
এক জাহাজে। সে বলল –
জাহাপনা, সাগরের এদিকে অতিকায় সব মাছ সাঁতরে বেড়াচ্ছে দেখলাম। আর দেখলাম একটা পাহাড় মাথা উঁচিয়ে দঁড়িয়ে। তার কিছু অংশ কালো আর অবশিষ্টাংশ সাদা।

ডুবুরির কথা শেষ হতে না হতেই ক্যাপ্টেন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল ! কাঁদতে কাঁদতে বললো–
আর নিস্তার নেই জাঁহাপনা, ডুবুরি যে-পাহাড়টার খোঁজ নিয়ে এসেছে সেটা সাধারণ পাহাড় নয়। তার গায়ে গেঁথে দেওয়া আছে সহস্রাধিক চুম্বকের বর্শা। আমাদের জাহাজ তার দিকে এগোতে থাকলে তাঁর তীব্র আকর্ষণে কাছে টেনে নিবে। ব্যস, শেষ পর্যন্ত জাহাজ হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়বে তার গায়ে। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। আমাদের পরমায়ু ফুরিয়ে এসেছে। এখন আল্লতামার নাম করা ছাড়া উপায় নেই। সকাল
হলেই আমরা চুম্বক-পাহাড়ের দৌলতে জান খোয়াব। আজ পর্যন্ত যত নাবিক এপথে এসেছে কেউই জান নিয়ে ফিরতে পারে নি। আমদেরও ফিরে যাওয়ার ভরস| নেই।

চোখের পানি মুছতে মুছতে ক্যাপ্টেন এবার বললো—
জাহাপনা, পাহাড়ের মাথায় একটা গম্বুজ রয়েছে। তার মাথায় এক ব্রোঞ্জের তৈরি ঘোড়সওয়ার। তার মাথায় শিরস্ত্রাণ, বুকে বর্ম। ডান হাতে তরবানি আর বাঁ হাতে ঢাল। যতদিন ওই ব্রোঞ্জের মূর্তিটা পাহাড়ের চূড়ায় থাকবে ততদিন আর কারো রেহাই নেই। তবে কোনক্রমে তাকে ওখান থেকে ফেলে দিতে পারলে আর কোন বিপদাশঙ্কা থাকবে না।

আমি দু’বাহ ওপরে তুলে বললাম –
হায় খোদা, এমন কি গোস্তাকি করেছি তোমার কাছে, যার জন্য এমন ফাঁদে ফেলে দিলে?
অথৈ সাগরে জান দিতে হবে। নিরবিচ্ছিন্ন হতাশা আর হাহাকারের মধ্য দিয়ে রাত্রি কাটালাম। ভোরের আলো ফুটে উঠল সাগরের বুকে।

ক্যাপ্টেন আমার কাছে ছুটে এসে বললো—
জাহাপনা, আমরা চুম্বক পাহাড়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের জাহাজগুলো পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে গুঁড়িয়ে যাবে। এখন খোদাতাক্তার নাম করুন। পরপারে যাবার জন্য মনকে শক্ত করে বাঁধুন।

ক্যাপ্টেনের কথাই বস্তবে পরিণত হ'ল। বিকট শব্দ করে জাহাজ গিয়ে আছড়ে পড়ল পাহাড়ের গয়ে। মুহূর্তে ভেঙ্গেচুরে একসার হয়ে গেল। উত্তাল-উদ্দাম সাগরের বুকে পড়ে আমরা কে যে কোথায় ছিটকে পড়লাম তার হদিস মিললো না।

ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালি করে আমি হারা উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম। এত কষ্ট করেও আমি কিন্তু হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিইনি। দাঁতে দাঁত চেপে নিরবিচ্ছিন্ন লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলাম। সে আর কতক্ষণ? আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললাম। কতক্ষণ যে অচেতন্য অবস্থায় কাটিয়েছিলাম তা আমার নিজেরই জানা ছিল না। সংজ্ঞা  ফিরলে দেখলাম, এক বালির চড়ায় আমি চিৎ পটাং হয়ে পড়ে আছি। আল্লাহ-র উপর বিশ্বাস আরও অনেকাংশে বেড়ে গেল আমার।

সামনেই অভিশপ্ত পাহাড়টা মথা উড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বালির চড়া ছেড়ে পাহাড়ের পাছে গেলাম। সামনেই একটা পথ নজরে পড়ল। এঁকেবেঁকে পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত উঠে গেছে।

খোদার নাম নিয়ে আঁকাবাঁকা পথটা ধরে পাহাড়ে উঠতে লাগলাম। মনে আমার অদম্য উৎসাহ-উদ্দীপনা।

পেম শারাজাদ দেখলেন ভোরের আলো একটু একটু করে উঁকি দিতে শুরু করেছে। তিনি কিস্স বন্ধ করলেন।


পঞ্চদশ রাজনী


যথা সময়ে বাদশাহ শহরিয়ার অন্দরমহলে এলেন।

বেগম শাহরাজাদ কিস্সা শুরু করলেন—
তৃতীয় কলান্দর ফকির তার জীবনের ঘটনাবলী বলে চললো—

খোদার নাম নিয়ে আমি যখন পাহাড়ের খাড়া পথ বেয়ে ধীর মন্থর গতিতে উঠছিলাম। তখন হঠাৎ এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুদ্ধি আমাকে হতে হ’লো।

বাতাসের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে গেলো। বাতাসের সঙ্গে লড়াই করে খাঁড়া পথ বেয়ে ওপরে উঠতে খুবই তকলিফ হতে লাগল।

অমানুষিক তকলিফ সহ্য করে আমি এক সময় বহু আকাঙ্ক্ষিত চূড়াটায় উঠতে সক্ষম হলাম। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে আমি ডগমগ। গম্বুচটার নীচে শুয়ে পড়লাম। অনভ্যস্থ পা দুটো টনটন করছে। মনে
অফুরন্ত উম্মাদনা বটে, কিন্তু শরীর ক্লান্ত অবসন্ন। ফুরফুরে বাতাস পেয়ে ক্লান্ত চোখের পাতা দুটো বুজে এল। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। ঘুমের ঘোরে শুনতে পেলাম কে যেন বলছে—
শোন, কাদিব-এর লেড়কা, তুমি যেখানে শুয়ে আছ, সেখানে, তোমার ঠিক পায়ের কাছে সামান্য গর্ত খুড়লেই একটা তীর আর ধনুক মিবে।
এ দুটো দৈবশক্তি সম্পন্ন। ধনুকে তীর সংযোজন করে ঘোড়সওয়ারটার গায়ে আঘাত করলে, তবেই ব্রোঞ্জের ঘোড়সওয়ারের মূর্তিটা হুমড়ি খেয়ে সাগরের পানিতে পড়বে। তোমার কাজে দুনিয়ার মানুষ বড়ই উপকৃত হবে। যেখান থেকে ধনুকটা তুলেছিলে সেখানেই সেটাকে রেখে আগের মতই মাটিচাপা দিয়ে দেবে।

ব্রোঞ্জের মূর্তিটা সাগরে পড়ামাত্র সাগরের উন্মাদনা অনেকাংশে বেড়ে যাবে। পানি ফুলে ফেঁপে উঠতে উঠতে তোমার পায়ের তলায় পাহাড়ের চূঁড়ার সমান হয়ে যাবে। ঠিক তখনই তোমার
চোখে পড়বে একজন একটা ছোট্ট নৌকো নিয়ে তোমার কাছে এসেছে। তোমার মনে হবে, ঘোড়সওয়ার। ঘোড়সওয়ার আর ডিঙির লোকটাকে একই ধাঁচে গড়া মনে হবে। আসলে কিন্তু তোমার চোখের ভুলের জন্যই উভয়কে অবিকল একই রকম মনে হবে। নৌকো আরও কিছুটা এগিয়ে এলে তোমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে পাটাতনের ওপর একগাদা মরার খুলি। তা দেখে তুমি আবার মুষড়ে পোড়ো না যেন। লোকটার নৌকোটা নিয়ে আসার উদ্দেশ্য তোমাকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়ে আসা।

খবরদার! নৌকোয় পা দেওয়ার পর থেকে যতক্ষণ তাতে থাকবে ততক্ষণ ভুলেও যেন খোদাতাল্লা-র নাম উচ্চারণ কোরো না।

নৌকোয় ওঠার পর থেকে শুরু করে নিরবিচ্ছিন্নভাবে দশদিন নৌকোর দাঁড় বেয়ে তোমার দেশের কাছাকাছি শান্ত সমূদ্রের বুকে
তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। সামনেই এক বণিকের নৌকো দেখতে পাবে। বণিক তোমাকে নৌকোয় তুলে নিয়ে তোমার বন্দরে নামিয়ে দিয়ে আসবে।

আচমকা আমার ঘুম ভেঙে গেল। ব্যাস্ত হাতে পায়ের তালার মাটি খুঁড়তে শুরু করলাম। সামান্য কুড়তেই বাঞ্ছিত তীর-ধনুকটা চোখে পড়ল। তুলে নিলাম।

ব্রোঞ্জের মূর্তিটার গায়ে তীরটা গিয়ে আঘাত করতেই সেটা কুড়মুড় করে ভেঙে সাগরের পানিতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সাগর উত্তাল উদ্দাম রূপ ধারণ করল। তারপরই দ্রুত ফুলে ফেঁপে উঠতে
উঠতে পানি পাহাড়ের চূড়াটার সমান উঁচুতে উঠে গেল। তারপরই একজন ছোট্ট একটা নৌকো নিয়ে আমার কাছে এল। নৌকার পাটাতনের তলা থেকে একগাদা মড়ার খুলি উঁকি মারতে লাগল।
দেখতে সে-ঘোড়সওয়ারটার মত হলেও আসলে একই লোক নয়।

একেবারে কাছে যেতে আমার ধারণা স্পষ্ট হ’ল যে, লোকটা রক্ত-মাংসের মানুষ নয়। পিতলের তৈরি মূর্তি। তার বুকে একটা সীসার ফলক। দৈববাণী খোদাই করা।

আমি নিঃশব্দে নৌকোয় উঠে বসতেই লোকটা নৌকো বাইতে শুরু করল । দশদিন এক নাগাড়ে নৌকোয় কাটালাম। দশদিন পরে সমুদ্রটাকে পরিচিত মনে হ'ল। বড়ই আনন্দ হ'ল। দু'হাত তুলে
খোদাকে ধন্যবাদ জানালাম।

ব্যস, মুহূর্তে ঘটে গেল বিপর্যয়। পিতলের মূর্তিটা আমাকে প্রচণ্ড আক্রোশে দু'হাতে তুলে সাগরের পানিতে ছুড়ে ফেলে দিল। পরমুহূর্তেই নৌকো ও রহস্যজনক সে-পিতলের মূর্তি দু-ই নিশ্চিহ হয়ে গেল। আবার সাগরের পানি সম্বল করে ভাসতে লাগলাম। সারাদিন অবিশ্রান্ত লড়াই চালিয়ে খোদার নাম স্মরণ করতে লাগলাম। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল সাগরের বুকে। হঠাৎ ঢেউয়ের তান্ডব গেল বেড়ে। আমায় ভাসিয়ে নিয়ে চললো
উপকূলের দিকে। এক সময় ঢেউয়ের ঝাপটায় তীরে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়লাম।

সমুদ্রের ঠাণ্ডা বাতাসে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে লাগল। জামা-কাপড় খুলে বালির উপর শুকোতে দিলাম। জায়গাটা সমুদ্রের মাঝখানে ছোট্ট একটা দ্বীপ। চারদিকে কেবল পানি আর পানি।

আমার নিজের ওপর খুব রাগ হতে লাগল। ভাবলাম, সাবান্য একটা ভুলের জন্য আমাকে এরকম করে খেসারত দিতে হচ্ছে। হতাশজর্জরিত মনে দ্বীপের এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে হঠাৎ নিজেকে ভাগ্যবান মনে হতে লাগল। একটা জাহাজ নজরে পড়ল। দ্বীপের দিকেই এগোতে দেখলাম। কিন্তু মনের আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হ'ল না। ভাবলাম, আবার নতুনতর কোন বিপদে পড়াও
কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। এরকম আশঙ্কা করে তাড়াতাড়ি একটা গাছের মগডালে উঠে বসলাম। পাতার ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম।
এক সময় জাহাজটা কূলে ভিড়লো। দশ বারোজন গাট্টাগোট্টা নফর নেমে এল একটা করে কোদাল হাতে। কূল থেকে কিছুদূরে এক জয়গায় মাটি কাটতে লাগল ব্যস্ত হাতে। মনে হ'ল, কিছু খুঁজছে
নফরগুলো। হ্যাঁ, অনুমান অভ্রান্ত। সামন্য খোঁড়াখুঁড়ির পর তারা একটা গুপ্ত দরজা পেয়ে গেল। এবার জাহাজ থেকে কতগুলো বড় বড় পেটিকা এনে গুপ্ত দরজাটা দিয়ে নিচে নামিয়ে দিল। সেগুলোর মধ্যে দামী খাবার দাবার এবং মদ ভর্তি রয়েছে। কয়েকটা পেটিকায় দামী পোশাক পরিচ্ছদও রয়েছে দেখলাম। সব মিলিয়ে একটা পরিবারের যা কিছু দরকার সবই জাহাজটাতে ছিল।

এবার জাহাজ থেকে নামিয়ে আনা হ'ল এক অশিতিপর বৃদ্ধকে। কেবল বার্ধক্য নয় জরাব্যাধিও তার ওপর ভর করেছে মনে হ'ল। বৃদ্ধের পিছন পিছন সুদর্শন এক কিশোরও জাহাজ থেকে নেমে
এল। আর তাদের দেখভাল করছে কয়েকজন নফর। বৃদ্ধটি থপ্ থপ্ করে হেঁটে গুপ্ত দরজায় গেল। অন্যরা তাকে অনুসরণ করল। কিছু সময় কেটে গেল নিঃশব্দে। এক সময় সে-কিশোরটি ছাড়া অন্যান্য সবাই এক এক করে গুপ্ত দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে এল।

বৃদ্ধকে নিয়ে সবাই জাহাজে উঠে গেলে, জাহাজ আবার অথৈ সাগরের দিকে এগিয়ে চলল।

আমি গাছ থেকে নেমে এলাম। ব্যস্ত হাতে মাটি সরিয়ে গুপ্ত দরজটা বের করলাম। তার মুখে একটি পাথর চাপা দেওয়া। অতি কষ্টে সেটাকে সরিয়ে ফেলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল সঙ্কীর্ণ একটা সিঁড়ি। ভেতরে আবছা অন্ধকার। সিঁড়ি হাতড়ে হাতড়ে নেমে গেলাম নিচে। হঠাৎ চমকে গেলাম। এক সুদৃশ্য ঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম
অমি! মূল্যবান শ্বেত পাথরের মেঝে। আসবাবপত্র যা কিছু একটি পরিবারের দরকার সবই ঘরে সাজানো রয়েছে। আমি পর্দা সরিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি দিতেই কিশোর বালকটিকে দেখতে পেলাম।
সোনার পালঙ্কে শরীর এলিয়ে দিয়ে সোনার পাথায় বাতাস খাচ্ছে। আমকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই সে ভয়ে একেবারে কুঁকড়ে গেল। আমি তাকে অভয় দিতে গিয়ে বল্লাম-
আমাকে দিয়ে তোমার কোনই অহিত সাধিত হবেন। আমি দত্যি-দানো নই, সাধারণ মানুষ। এক বাদশহের লেড়কা। আবার আমি নিজেও এক
দেশের বাদশাহ। তোমার কোন অনিষ্ট তো করবই না বরং মৃত্যুর কবল থেকে তোমাকে উদ্ধার করতেই আমার এখানে আগমন।
তারা তোমাকে এখানে বন্ধী করে রেখে গেছে। তোমাকে এ পাতলপুরী থেকে আমি উদ্ধার করতে এসেছি।

আমার কথায় কিশোর বালকটার উৎকণ্ঠা দূর হ’ল। মুখে হাসি রেখ ফুটে উঠল।

কিশোর বালকটির চোখ-মুখ দেখে মনে হ’ল কোন আমির- ওমরাহের ঘরের ছেলে। তার চেহারায় সারল্যের চাপ। আমাকে কাছে ডাকল ঘরের ভেতরে যেতেই সামান্য সরে গিয়ে পালঙ্কের
ওপরে আমাকে বসতে দিল।

আমকে পাশে বসিয়ে কিশোর বালকটি মিষ্টি-মধুর স্বরে কেটে কেটে বলতে লাগল— শুনুন বদশাহ, তারা আমাকে এখানে বন্দী করে রেখে যায় নি। আমাকে হত্যা করতে নয়, আমাকে মৃত্যুর হাত
থেকে বাঁচাবার জন্যই তারা আমাকে এখনে লুকিয়ে রেখে গেছে।

আমার আব্বাজী সর্বজন পরিচিত। তুমিও তার নাম অবশ্যই শুনে থাকবে। তামাম দুনিয়ায় তাঁর মত বড় জহুরি তার দ্বিতীয় কেউ নেই। আমির আদমি। খানদানি বংশ আমাদের। বাবার বুড়ো বয়সে আমার জন্ম হয়েছে। খুবই আদুরে।

আমার জন্মের পর এক' প্রখ্যাত গণৎকার ভবিষ্যদ্বাণী করেন, পিতা-মাতার জীবদ্দশাতেই আমি বেহেস্তে চলে যাব। আর এ-ও বলেছেন, আমার পনের বছর বয়সে বাদশাহ কাসিবের লেড়কা আমাকে হত্যা করবে। তিনি তার গণনার ফলাফলের বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন বাদশাহ কাসিবের পুত্র সাগরের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে এক দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নেবে। সেখানকার
পাহাড়ের চূড়র ব্রোঞ্জের তৈরি এক ঘোড়সওয়ারকে সাগরের পানিতে ফেলে দিয়ে হাজার হাজার নাবিকের জীবনরক্ষা করবে। গণৎকারের ভবিষাদারী শোনার পর থেকে আমার আব্বাজী
আমাকে বাদশাহ কাসিবের লেড়কার ভয়ে পনের বছর ধরে নানাভাবে রক্ষা করে চলেছে।

কিছুদিন আগে চারদিকে খবর হয়ে গেছে, বদশাহ কাসিবের লেড়কা লকি সে-ব্রোজের ঘোড়াসওয়ারটাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে সাগরের পানিতে ফেলে দিয়েছে। খবরটা কানে যওয়ার পর
থেকেই আমার আব্বাজী আমাকে নিয়ে বড়ই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন। আমার বৃদ্ধ জরাজীর্ণ আব্বাজীর শরীর দ্রুত কাবু হয়ে পড়তে থাকে। আমার আম্মা কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছেন।

কিশোর বালকটার মুখে গণৎকারের কথা শুনে রাগে আমার মাথায় খুন চেপে যাওয়ার জোগাড় হল। যত্তসব মিথ্যাবাদী ভণ্ড গণৎকারের দল। অযথা মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। তাদের
ধরে কচুকাটা করলেও গায়ের ঝাল মেটবে না। এমন সুন্দর সহজ-সরল ফুলের মত পবিত্র এক কিশোরকে হত্যা করবে এমন নরাধম দুনিয়ায় কেউ আছে। আমি কিশের বালককে লক্ষ্য করে
বাললাম— তুমি মিছে ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পেড়ো না ভাইয়া। আমি তোমাকে রক্ষা করবো। আমি থাকতে তোমার কেশাগ্রও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। চল্লিশদিন আমি তোমাকে ছায়ার মত
অনুসরণ করব। উক্ত সময় অতিক্রান্ত হলে আমি নিজে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে তোমার আব্বাজানের কাছে যাব। তুমিই হবে আমার সত্যিকারে জিগরি দোস্ত। আমার মসনদে তোমাকেই আমি অভিহিক্ত করে যাব। কথা দিচ্ছি।

আমার কথায় লেড়ক'টা আশ্বস্ত হ'ল। আমার ওপর তার মনে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, বিশ্বাস অর ভালবাসার সঞ্চার হল। পাতালপুরীতে আমাদের কোন অসুবিধাই হল না। রাশীকৃত খাবার, পোশাক পরিচ্ছদ আর অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী বৃদ্ধ জহুরী
সেখানে জড়ো করে রেখে গেছেন।

জহরীর কিশোর ছেলেটা অমাকে কাছে পেয়ে যে স্বস্তি ও আনন্দ পেয়েছে তা বুঝলাম সারা রাত্রি তার সুনিদ্রার মধ্য দিয়ে। মনে হ’ল বহুদিন পর সে এরকম স্বস্তিতে ঘুমোতে পেরেছে।

আমরা নিজেদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনের গল্পকথা খেলাধূলা আর হাসি-অনন্দের মধ্য দিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে লাগলাম। কিশোরটা'র মন থেকে তার আম্মা আর আব্বাজীর অভাব মুছে গেল। মৃত্যুভয়ও কিছুমাত্র রইল না। আমাদের পারস্পরিক আন্তরিকতাই উভয়কে পাঙালপুরীর জীবনেও নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের মধ্যে রেখেছে।

এক সকালে সে আমাকে বলল –
ভাইজান, আজ আমি ঘরে ফিরে যাব। আমার আব্বাজী আমাকে নিয়ে যেতে আসবেন। আমি
তাকে গরম পানি দিয়ে ভাল করে গোসল করালাম। সোনার জরি দিয়ে কাজকরা দামী পোশক পরিয়ে দিলাম। সে সেজেগুজে একটা আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়ে তার আব্বাজীর জান্য অপেক্ষা করতে লাগল।

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম – ভাইয়া, কি খাবে বল??
—তরমুজ। আমাকে একটু তরমুজ দাও ভাইজান।'
— আমি একটা তরমুজ নিয়ে তার আরাম-কেনায়ার পাশে রাখলাম! আরাম-কেদারার মাথার ওপর দেওয়ালে একটা বড়সড় ছুরি ঝুলানো ছিল। একটা টুল টেনে নিয়ে তার ওপর উঠে দাঁড়ালাম।
ছুরিটিকে নাগালের মধ্যে পাওয়ার জন্য গোড়ালি দুটোকে উঁচু করতেই তার মনে দুষ্টুমি বুদ্ধির উদয় হল। আমার উঁচু গোড়ালির তলায় সুড়সুড়ি দিতে লাগল। আচমকা সুড়সুড়ি দেওয়ায় একটা পা
উঁচু করতেই হ’ল। ব্যস, আর দেহের ভারসাম্য বজায় রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হ’ল না। আমি তার আরাম কেদারার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। হাতের চুরিটা অতর্কিতে তার বুকে গেঁথে গেল।
গণৎকারের ভবিষ্যদ্বাণী হাতে নাতে ফলে গেল। বার কয়েক ছটফট করে কিশোরটার রক্তাপ্লুত শরীরটা এলিয়ে পড়ল।

আমার তখনকার মনের অবস্থা বুঝিয়ে বলার মত ভাষা আমার নেই! আমি জহুরীর কিশোর লেড়কার রক্তাপ্লুত নিঃসাড় দেহটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম, উন্মাদের মত দাপাদাপি করতে লাগলাম।

বৃদ্ধ জহুরীর সন্ধ্যাবেলা ছেলেকে নিয়ে যেতে আসার কথা। তখন আমার কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাঁর সামনে আমি কোন মুখে দাঁড়াব? কি বলে তাঁকে প্রবোধ বে? বৃদ্ধপিত্তর
হৃদয়বিদারক দৃশ্য আমি চোখের সামনে দেখতে পারব না। কিছুতেই না।

চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আমি পাতালপুরীর প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। গুপ্ত দরজাটা পাথরচাপা দিয়ে বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু আমার মনে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই।

কিন্তু দূরে চলে যেতেও মন সরল না। পুরো ব্যাপারটা কোথাও আত্মগোপন করে থেকে নিজের চোখে দেখার জন্য চিত্তে চাঞ্চল্য বোধ করতে লাগলাম। নইলে বৃদ্ধের নোকরগুলো আমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেবে।

আগেকার সে-গাছটার মগডালে উঠে পাতার আড়ালে লুকিয়ে রইলাম।

প্রায় এক ঘণ্টা আমি গাছের ডালে কাটানোর পর সে জাহাজটা এসে তীরে ভিড়ল। দশজন নোকর পরিবেষ্টিত হয়ে সে-অশিতিপর বৃদ্ধ আগের মতই লাঠি ভর দিয়ে দিয়ে জাহাজ থেকে নেমে এলেন।
সঙ্গের নোকরদের বললেন — নিয়ে এসো আমার প্রাণনিধিকে।

বৃদ্ধ নোকরদের নিয়ে থপথপ করে আমার গাছটার নিচের গর্তটার মুখের সামনে এল। সেদিকে চোখ পড়তেই সবিস্ময়ে বলে উঠলেন— এ কী কাণ্ড। মনে হচ্ছে কেউ সদ্য মাটি খুঁড়ে রেখেছে, কি ব্যাপার। তবে কি আমার লেড়কা জিন্দা নেই?

বৃদ্ধের সঙ্গের নোকরগুলো ব্যস্ত হাতে মাটি সরিয়ে গর্তের মুখটা খালি করল। বৃদ্ধ উন্মাদের মত ছেলের নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলেন। কিন্তু কে-ই বা সাড়া দেবে? যাকে বুকে ফিরে পাওয়ার
জন্য বৃদ্ধটি প্রায় উন্মাদদশা প্রাপ্ত হয়েছেন, তাকে যে আমি অনিচ্ছায় হলেও নিজের হাতে খতম করেছি। সে আজ চিরনিদ্রায় শায়িত।
তার ঘুম কেউ ভাঙাবে সাধ্য কি!

নফররা বিষণ্নমুখে বৃদ্ধকে পাতালপুরীর প্রাসাদে নিয়ে গেল ধরাধরি করে।

কিছুক্ষণ বাদে নোকররা বৃদ্ধের সংজ্ঞাহীন দেহটাকে নিয়ে ওপরে উঠে এল। সে মর্মান্তিক দৃশ্য সহ্য করাই তো দুষ্কর। বৃদ্ধ তখন লেড়কার নাম ধরে বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগলেন!

এবার নোকরগুলো ছুরিকাবিদ্ধ রক্তাপ্লুত নিঃসাড় শিশুর দেহটাকে ধরাধরি করে ওপরে নিয়ে এল। গাছটার ছায়াতেই তার লাশটাকে গোর দেওয়া হ'ল। আর পাতাল পুরীতে যেসব দ্রব্য সামগ্রী ছিল। সবই জাহাজে তুলে নেওয়া হ'ল। জাহাজ ছেড়ে দিল।

জাহাজ চলে গেলে আমি গাছ থেকে নেমে বিষণ্নমনে ছোট্ট সে দ্বীপ্টার এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। চারদিকে কেবল জল আর জল। ডাঙ্গার কোন চিহ্নও চোখে পড়ল না। কিন্তু আমাকে যে তীরের সন্ধান পেতেই হবে।

একদিন গাছের তলায় বিষণ্ণ মনে শুয়েছিলাম, অপ্রত্যাশিত এক দৃশ্য নজরে পড়ল। দেখলাম, অভাবনীয় উপায়ে সাগরের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বালির চড় সৃষ্টি হয়ে গেল।
আমি আশান্বিত হয়ে হাঁটতে লাগলাম। ভাবলাম, কোথায় এর শেষ, কোথায় গিয়ে পৌঁছায় দেখাই যাক না। হেঁটে হেঁটে পুরো দিনটা কাবার করে নিলাম। সন্ধ্যার কিছু আগে দেখতে পেলাম আসল
মাটিতে আমি হাঁটছি, এক সময় যা সমুদ্রের তীর ছিল। খোদাতাল্লার প্রতি মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল।

আমি উল্লসিত মনে বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত প্রান্তর দিয়ে হেঁটে চলেছি। কিছুদূরে আগুন জ্বলছে দেখলাম। ভাবলাম, অবশ্যই কোন জনবসতি সেখানে আছে। আগুন জ্বেলে কেউ ভেড়াও পোড়াতে পারে। আশান্বিত মন দিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে হাটতে লাগলাম। কাছে যেতেই আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। দেখি বিশালয় একটা পিতলের তৈরি প্রাসাদ। বিকালের বিদায়ী সূর্যের লালচে আভা পড়ায় মনে হয় পিতলের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

আমি প্রাসাদের সিংহদরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখেই দশজন ষণ্ডামার্কা লোক আমার সামনে এসে দাঁড়াল। সুস্বাস্থোর অধিকারী সুপুরুষ। কিন্তু অবাক মানলাম যে, সধারই বাঁ-চোখ কানা।
একটু পরে এক অতিবৃদ্ধ তাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। গায়ের চামড়া ঢিলা হয়ে পড়লেও এক নজরে দেখলেই মনে হয় এক সময় তিনি সুপুরুষ ছিলেন। জরা ব্যাধিতে জীর্ণদশা প্রাপ্ত হয়েছেন।

অশিতিপর বৃদ্ধটি আটজন গাট্টাগোট্টা লোকসহ আমার দিকে এগিয়ে এলেন আর বাকি দু' জন সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। আমি প্রথমে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। কিন্তু বৃদ্ধ ও অন্যান্যরা আমাকে হেসে স্বাগত অভিনন্দন জানালেন। আমার কলিজায় জল এল। মন থেকে ভয়-ডর নিঃশেষে মুছে গেল। আমি মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বৃদ্ধকে অভিবাদন জানালাম।

বৃদ্ধ আমাকে তাঁর প্রাসাদে স্বাগত জানালেন। আমি তাদের সবার সঙ্গে প্রাাসাদাভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। আমার বিড়ম্বিত জীবনের কথা তাদের কাছে, বিশেষ করে বৃদ্ধের কাছে প্রকাশ করলাম। আমার জন্য তারা নানাভাবে দুঃখ প্রকাশ করল। বৃদ্ধ আমার পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা  দিলেন।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর বৃদ্ধটি আমাকে সঙ্গে করে প্রাসাদটি ঘুরে ঘুরে দেখালেন।

আমাকে সুউচ্চ একটি কারুকার্যশোভিত প্রাসাদে আসনে বসতে দেওয়া হল। বৃদ্ধ নিজে বসলেন মূল্যবান ভেলভেটে মোড়া গালিচায়। আর অন্যান্যরা নিজ নিজ কুর্সি দখল করল।

আমাকে বলা হ’ল চুপ করে বসুন কিছুক্ষণ। আমরা এখন আপনার জন্য প্রার্থনা করছি।

নিরবচ্ছিন্ন নীরবতার মধ্য দিয়ে কিছুটা সময় কেটে গেল। এক সময় প্রার্থনা শেষ করে বৃদ্ধসহ সবাই আঁখি খুলে তাকালেন। তারপর বৃদ্ধের সঙ্গী দশজন আর আমি দামী সুরা ও মুখরোচক খাদ্যবস্তু দিয়ে ভোজন সারলাম।

বৃদ্ধের আতিথ্যে আমি মুগ্ধ হলাম। ভাবা যায়, নিজের হাতে আমার উচ্ছিষ্ট থালাবাসন সাফ করলেন। কিন্তু মুখে একটি কথাও বলেন না।

দশজন যুবকদের মধ্য থেকে এক সুদর্শন যুবক একটু রাগত স্বরেই বলল— প্রার্থনা জানাবার জন্য দরকারী সামগ্রী এখনও না?

বৃদ্ধ নীরবে পাশের ঘরে চলে গেলেন। মূল্যবান সার্টিনের কাপড়ে মোড়া দশ বারে দশটা পাত্র আর দশটি জ্বলন্ত চিরাগবাতি আর ধূপদানি এনে প্রত্যেক যুবকের সামনে একটা করে রাখলেন।
আমার সামনে কিছুই রাখলেন না।

এবার যুবকেরা নিজ নিজ পাত্র হাতে নিয়ে ঢাকনা খুলে ফেললো। দেখা গেল, চিরাগবাতির ফালি, চুলার ছাই এবং কাজল মাখানো প্রত্যেকটি পাত্র। পাত্রের ঢাকনা খুলেই সবাই ডুকরে ডুকরে কাঁদতে
লেগে গেল। আঁখির পানি ফেলতে পেতে কান্নাপ্লুত কণ্ঠে সবাই বললো— আমাদের কৃতকর্মের, আমাদের পাপের ফল। এবার তারা নিজ নিজ পাত্র থেকে চিরাগবাতির কালি আর ধূপের ছাই নিয়ে মুখে মেখে নিল। আর তর্জনী দিয়ে কাজল নিয়ে ডানচোখে পরল।

ভোরে কালি-কাজল সব মুছে মূল্যবান পোশাক পরে কেতাদুরস্ত হয়ে গেল। কে বলবে, এরাই রাত্রে অবিশ্বাস্য কৌশলে প্রার্থনা করে সং সেলেছিল।

তাদের বিচিত্র সব কাজকর্ম সম্বন্ধে মনে অদম্য কৌতূহল জমা হলেও সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে সংযত রাখতেই হ'ল। কারণ, বৃদ্ধ আমাকে বার বার বলে দিয়েছিলেন— কোন কথা বলবে না। সর্বদা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে।

অবিশ্বাস্য কাণ্ডকারখানার মধ্যে তিনদিন তিনরাত্রি কেটে গেল। রোজ তাদের একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে দেখলাম। নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলাম না। একদিন বলেই ফেললাম— আচ্ছা, আপ্নাদের এসব আচরণের অর্থ কি? যদিও এসব ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরকম অত্যাশ্চর্য সব কাণ্ড চোখের সামনে দেখে মুখবুজে থাকাও তো যায় ন! আমার
নসীবে যা থাকে থাক, তবু আমাকে আজ শুনতেই হবে। আপনাদের সবার বাঁ-চোখ কানা কেন? আর রোজ রাত্রে আপনারা কেনই বা ছাই আর কাজল চোখে-মুখে মাখেন? এসবের অর্থ কি আমাকে
বলতেই হবে।

—কেন এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ, জানতে চাইছ। নিষেধ করা সত্ত্বেও এসব প্রশ্ন করে নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারতে উৎসাহী হচ্ছ কেন, বুঝছি না তো!

—নসীরে যা আছে তা-তো ঘটবেই। তবু আমি মানতে আগ্রহী। বলুন, এসব কাণ্ডকারখানার অর্থ কি?

—শোন, তোমার কৌতূহলের জন্য তোমাকেও বাঁ-চোখটি কিন্তু খেয়াতে হবে, জেনে রেখো।

—পরোয়া করি না। তবু আমাকে কৌতূহল মেটাতেই হবে। জীবনভর একটা জমাট বাঁধা কৌতূহল জগদ্দল পাথরের মত বুকে করে হয়ে নিয়ে বেড়নোর চেয়ে বাঁ-চোখটি যদি বিনিময়ে খোয়াতে হয় তবু ভাল। আপনারা বলুন, বরাত ঠুকে আমি সব শুনব।

—শোন তবে, অমরা নিজেদের দোষেই নিজ নিজ বাঁ চোখ খুইয়েছি। তোমাকেও নিজেরই দোষেই খোয়াতে হবে। আর মনে রেখো, বাঁ চোখ খোয়াবার পর কিন্তু এখান থেকে তোমাকে পাততাড়ি গোটাতে হবে। তোমার ঠাঁই এখানে হবার নয়। কারণ এখানে মাত্র দশজনের জায়গা রয়েছে। এগারোজনকে ঠাঁই দেওয়া সম্ভব নয়। অতএব তোমার—

তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই সে বৃদ্ধ একটি ভেড়া নিয়ে ঘরে এলেন। জাান্ত ভেড়া। নিঃশব্দে একটি সুতীক্ষ্ণ চুবির ফলা দিয়ে সেটাকে জবাই করলেন। ছালচামড়া মুক্ত করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে
গেলেন।

ষণ্ডামার্কা চোখ কানা যুবকদের একজন বললো— শোন, তোমাকে ভেড়ার চামড়াতির মধ্যে পুরে প্রাসাদের ওপারে ফেলে রেখে দিয়ে আসা হবে। একটি রুম পাখি উড়ে এসে তোমাকে ছোঁ মেরে দিয়ে চলে যাবে। রুম পাখি অতিকায় এবং অমিত শক্তিধর একটি হাতীকে ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যাওয়াও তার পক্ষে সমস্যা নয়।
কারণ, সে ভাববে ভূমি সত্যিকারের একটা ভেড়া। যা-ই হোক তোমাকে নিয়ে গিয়ে বসবে একটি পাহাড়ের চূড়ায় তোমার গোস্ত দিয়ে' উদরপূর্তির ইচ্ছায়ই রুম পাখিটি তোমাকে সেখানে নিয়ে
যারে। ভাল কথা, তোমাকে ভেড়ার চামড়ায় ভরার আগে একটা ছুরি দিয়ে দেয়া হবে। সুযোগ মত যাতে চামড়া কেটে তুমি নিজেকে মুক্ত করতে পার। ঘাবড়ে যেয়ো না। রুম পাখি মানুষের গোস্ত খায় না। ফলে চামড়ার ভেতর থেকে তোমাকে বেরিয়ে আসতে দেখে পাখিটি হতাশ হয়ে শূন্যে ডানা মেলবে।

তুমি এবার হাটতে গিয়ে হাজির হবে সুবিশাল এক প্রাসাদে। কম করেও এ প্রাসাদের দশগুণ বড় তো হবেই। মনে করতে পার তার প্রায় সবটুকুই সোনার পাত দিয়ে মোড়া। মনে হবে বুঝি খোয়াব দেখছ। এবার বলছি আসল কথা। এ-প্রাসাদেই তোমাকে বাঁ-চোখটি খোয়াতে হবে। আর কি ভাবে, তাই না? আমরা দশজনে এক এক করে যেভাবে বাঁ-চোখ হারিয়েছি তোমাকেও খোয়াতে হবে একই রকম ভাবে। আর রোজ রাত্রে আমরা তার কাছে প্রার্থনা জানিয়ে মানসিক স্বস্তি লাভ করি।

যুবকটি যখন আমার কাছে তাদের কান্ডকারখানার কথা বলে আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করছিল তখন অন্যান্যরা ভেড়ার চামড়াটাকে
তৈরি করে নিতে লাগল। তার বক্তব্য শেষ হলে তারা আমার হাতে একটি ছুরির ফলা ধরিয়ে দিল। বলল- পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে চামড়া কেটে বেরোনোর কাজে এটি ব্যবহার কোরো। এবার আমাকে ভেড়ার চামড়ার থলিটাতে ভরে মুখ সেলাই করে দিল। কাঁধে করে প্রাসাদের মাথায় রেখে এল। তার একটু বাদেই বুঝলাম আমি
মহাশূন্যে ভেসে চলেছি। প্রকাগু একটি রুম পাখি আমাকে ঠোটে করে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে রাখল। মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে চুরির ফলা দিয়ে চামড়াটি কেটে বেরিয়ে এলাম।

রুমপাখিটি যাকে ভেড়া ভেবে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাকে মানুষের রূপে দেখে ভড়কে গেছে। হতাশ হয়ে উড়ে পালাল। একটি পাখি কত বড় এবং কী ভয়ঙ্কর রূপবিশিষ্ট হতে পারে একে দেখার
আগে আমার সে ধারণা তিলমাত্র ছিল না।

আর নয়। এবার আমি লম্বা লম্বা পায়ে পাহাড়ের চূড়া থেকে নামতে লাগলাম। সুবিশাল সে সুরম্য অট্টালিকার খোঁজ আমাকে পেতেই হবে। যুবক দশজন মধ্যাহ্ন ভোজনের আগে আমাকে যেসব
কথা বলেছি তা থেকে আমি মোটামুটি একটি ধারণ নিয়ে নিতে পেরেছিলাম। সেসব কথা অন্তরের অন্তঃস্থলে আঁকা রয়েছে। কিন্তু এখন বাস্তবে যা চোখের সামনে দেখছি তাতে করে মনে হচ্ছে, তারা প্রাসাদটি সম্বন্ধে তেমন কিছুই বলে নি।

একের পর এক করে নিরানব্বইটি চন্দনকাঠের কারুকার্যমণ্ডিত অতিকায় দরজা ডিঙিয়ে প্রাসাদ অভ্যন্তরের বড়সড় একটি ঘরে এসে দাঁড়ালাম ৷ আরে ব্বাস! কেবল হীরা, মানিক, পন্না, চুনি প্রভৃতি
বহুমূল্য সব পাথরের ছড়াছড়ি। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
এবার হাঁটতে হাটতে একটি ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম, চল্লিশজন পরমা সুন্দরী যুবতী বিচিত্র কায়দায় বসে। প্রত্যেকেই ষোড়শী, বা বড়জোড় অষ্টাদশী। বেহেস্তের হুরপরীদের চেয়ে তারা কেন অংশে কম
সুন্দরী নয়। আবার বিস্ময়কর ব্যাপার যে, তাদের একের সঙ্গে অন্যের দৈহিক সাদৃশ্য রয়েছে পুরোদস্তুর।

রূপসী যুবতীরা আমাকে দেখামাত্র মুচকি হেসে সাদর সম্ভাষণ জানাল।

তারা সানন্দে আমাকে নিয়ে গিয়ে একটি উচ্চাসনে বসাল। আমি যেন তাদের মেহমান এরকম আদর-আপ্যায়ন করতে লাগল।
আমার হুকুম তামিল করার জন্য তারা ব্যস্ত। আমার সামান্য সুখ উৎপাদন করাই যেন তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ। তাদের মধ্যে দু'জন মখমলের তোয়ালে ও মৃদু গরম পানি নিয়ে এল আমার পা ধুইয়ে দেবার জন্য। একজন বদনা থেকে পানি ঢেলে ঢেলে পা ধুইয়ে দিল. আর দ্বিতীয়জন তোয়ালে দিয়ে যত্ন করে মুছিয়ে দিল। আহারান্তে রূপসী যুবতীরা আমাকে ঘিরে বসল।
বিভিন্ন কৌশলে আমাকে আদর করতে লাগল। এক সময় আমার জীবনকথা শোনানোর জন্য অনুরোধ করল।

রূপসী যুবতীরা এখানে যেন নির্বাসন-জীবন যাপন করছে। হাসি-খুশী-আনন্দ কাকে বলে তারা ভুলেই গেছে। আমাকে কাছে পেয়ে তারা যেন এই প্রথম হাসি-আনন্দের স্বাদ পেল। সবার মধ্যেই খুশীর আমেজ। অফুরন্ত হাসির ছোপ। তাদের সবার মুখে একটাই কথা— তুমি আদর দিয়ে দিয়ে আমাদের মন-প্রাণ ভরিয়ে দাও। ভালবেসে কাছে টেনে নাও। দাও অনাবিল আনন্দের স্বাদ।

রূপসী যুবতীদের আব্দার আগ্রাহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব হ’ল না। আমার জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা তাদের কাছে ব্যক্ত করলাম।

সারাদিনের কর্মক্লান্ত সূর্যটি বিদায় নেবার জন্য উন্মুখ। তারই রক্তিম ছোপ পড়েছে পশ্চিম-আকশের গায়ে। এক সময় অদূরবর্তী
ঝাকড়া গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিল রক্তিম সূর্যটি। প্রকৃতির কোলে শুরু হয়ে গেল আলো-আধারির খেল। তারই কিছুক্ষণের
মধ্যেই নেমে এল রাত্রির অন্ধকার।

প্রাসাদের কক্ষগুলোতে জ্বলে উঠল মোমবাতির আলো। ঝমলিয়ে উঠল বিশালায়তন প্রাসাদটি।
রূপসী যুবতীরা এবার উৎকৃষ্ট সরানের পাত্র আর পেয়ালা নিয়ে এল। একের পর এক পেয়ালার সরাব উজাড় হতে লাগল।
তারপরই শুরু হ'ল বাজনার তালে তালে গান আর নাচ আমি সরাবের পেয়ালা নিয়েই মজে রইলাম।
তাদের নাচ পুরুষের হৃদয়ে দোলা দেয়৷ রক্তে জাগায় মাতন।

রাত্রি ক্রমে গভীর হয়ে এল। নাচ গান বন্ধ হল। রূপসীদের একজন আমার একটি হাত জড়িয়ে ধরে মিষ্টি-মধুর স্বরে বললো– রাত্রি তো অনেক হ’লো, এবার শোবে ঢল। আমরা চল্লিশজন
রয়েছি। এর মধ্যে থেকে তোমার যাকে মনে ধরে তাকেই আজ রাত্রের জন্য বেছে নাও। সেই হবে তোমার আজ রাত্রের মহব্বতের বেগম, শয্যা-সঙ্গিনী। সে-ও তোমাকে মহব্বত-ভালবাসায় ভরিয়ে দেবে! এ নিয়ে আমাদের কারো মনেই কিছুমাত্রও ঈর্ষার উদয় হবে না। হবেই বা কেন? আমরা চল্লিশ বহিন তো পা’লা করে তোমাকে আজ না হোক কাল তো পাবই। তোমাকে সঙ্গদানের মাধ্যমে নিজে সুখ পাব, আবার তোমাকেও সুখে-আনন্দে ভরপুর করে তুলব।

এ তো এক মহাসমস্যার ব্যাপার রে বাবা, কী ফাঁপরেই না পড়া গেল। সে মুহূর্তে আমার কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কাকে ফেলে কাকে নেই। সবাই একই রকম সুন্দরী। করো দেহে তিলমারও খুঁত নেই।

মাথা খাটিয়ে উপায় একটি বের করে ফেলাম বটে। চোখ বুজে আচমকা একজনের হাত চেপে ধরলাম। চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম এক রূপসী-ষোড়শীর হাত ধরে আমি দাঁড়িয়ে। তার চোখে-মুখে যুদ্ধ জয়ের অপার আনন্দ!

আমাকে'টু-শব্দটা পর্যন্ত করার সুযোগ না দিয়ে সে আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেল পাশে এক সজ্জিত ঘরে। পালঙ্কের ওপর মখমলের চাদর পাতা। সাগরের ফেনার মত নরম বিছানায় নিয়ে গিয়ে বসাল আমাকে। আমাকে অমৃততুল্য মধু পান করাল নিরবচ্ছিন্নভাবে চল্লিশবার। চাওয়া আর পাওয়া, দেওয়া আর নেওয়ার মধ্যে দিয়ে সুখের রাত্রিটি যেন চোখের পলকে কেটে গেল।

প্রতিটি রাত্রি আমার কাছে নিত্য নতুন আনন্দের ফোয়ারা নিয়ে হাজির হতে লাগল। চল্লিশটি বহিন এক এক করে আমাকে অমৃত সাগর মথিত করে সুখ দান করতে লাগল। নারীর সবথেকে মূল্যবান
সম্পদ সতীত্ব তা-ই স্বেচ্ছায়, হাসি আর আনন্দের মধ্য দিয়ে আমার কাছে নিবেদন করল।

চল্লিশটি সুখের রাত্রি অতিবাহিত হয়ে গেলে রূপঙ্গী যুবতীদের মুখে নেমে এল বিষাদের কালো ছায়া। আর এখানে নয়। তাদের এবার বিদায় দিতেই হবে। তারা কেঁদে কেটে বলতে লাগল—
আমাদের নসীবের ফের! নইলে অতীতে এক সুপুরুষ পেয়েও হারিয়ে ছিলাম। তারপরই পেলাম তোমাকে। তা-ও আজ ছেড়ে যেতে হচ্ছে। তারা সবাই আমাদের মন সুখে-আনন্দে ভরিয়ে তুলেছিল খুবই সত্য বটে কিন্তু আজ তুমি যে আনন্দ দিলে তা সত্যই অতুলনীয়, এক অনাস্বাদিত আনন্দ। তোমার পৌরুষের
তুলনা একমাত্র সিংহের পৌরুষের সঙ্গেই তুলনীয়। সারাটা বছর আমরা প্রেম জ্বালায় জর্জরিত হই। প্রেমজ্বালার জর্জরিত দেহ-মন নিয়ে পথ চেয়ে বসে থাকি কবে আমাদের নাগর এসে দরজায়
দাঁড়াবে। বুকে টেনে নেবে। সোহাগে আদরে মন-প্রাণ ভরিয়ে তুলবে। আল্লাহতাল্লা বছরান্তে একজন করে সুঠামদেহী যুবক আমাদের উপহার দেন। তোমাকেও একই নিয়নে পাঠিয়েছেন। তুমি
আমাদের মহব্বতের আগুনে শন্তিবারি সিঞ্চন করতে গিয়ে যে সুখ আর তৃপ্তি দিলে তা অতীতে যেমন কেউ দিতে পারে নি তেমনি ভবিষ্যতেও কেউ দিতে পরবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম।

আমি সবিস্ময়ে তাদের দিকে তাকিয়ে বললাম—কেন?
আমকে কেন তোমাদের ছেড়ে চলে যেতে হবে। তোমাদের সন্নিধ্যে কেন আমি আর থাকতে পারব না, বলবে কি??
— শোন, আমাদের আব্বাজী এখনকার বাদশাহ। আমরা চল্লিশ হহিন একই বাবার ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছি বটে কিন্তু অমাদের সবার মা আলাদা। আমরা প্রাসাদে অবস্থান করি সারা বছর ধরে! বছর পুরণের ঢল্লিশদিন বাকি থাকতে খোদাতাল্লা একজন করে সুদেহী যুবককে পাঠিয়ে দেন আমাদের কাছে। আমাদের যৌবনরক্ষার জন্যই এ ব্যবস্থা। চশদিন অতিক্রান্ত হলে আমরা আবার আব্বা আর আম্মাদের কাছে চলে যাই। আজ সে-দিন। আজ তোমাকে ছাড়তে হবে, চলে যেতে হবে তাদের কাছে। তোমার মত যৌবন ভরা জোয়ার কারো মধ্যেই দেখি নি। তোমার অকৃত্রিম-
অফুরন্ত মহব্বত আমাদের মন-প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু মন না চাইলেও তোমাকে ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হবেই।

—তোমরা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেও আমার পক্ষে এ জায়গা ছেড়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তোমরা আব্বা-আম্মার সঙ্গে মোলাকাত সেরে এসে গিয়ে। আমি তোমাদের প্রতীক্ষায় এখানেই থাকব।

আমার কথায় তারা উল্লসিত হলো। প্রাসাদের সবগুলো ঘরের চাবির গোছা আমার হাতে তুলে দিল। তারপর বলল— প্রাসাদের সব ঘরে যেতে পারবে। কিন্তু প্রাসাদের যেদিকে বাগিচা আছে
খবরদার সেদিকের দরজায় ভুলেও যেন খুলো না। যদি আমাদের কথা অগ্রাহ্য করে সে-দরজা খোল তবে কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে। আমাদের সঙ্গে পুনমিলনের পথ কিন্তু চিরদিনের মত বন্ধ হয়ে যাবে। খেয়াল রেখো।

পরদিন আমার হাড়ে প্রাসাদের চাবির গোছা দিয়ে রূপসী যুবতীরা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বিদায় নিল। রূপসী যুবতীরা বিদায় নিলে বিশাল প্রাসাদটা আমি একা আগলাতে লাগলাম। মনটক খুবই বিষিয়ে উঠল। অফুরন্ত হাসি আনন্দ উচ্ছলতার মধ্য দিয়ে দিন যে কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারিনি। আজ আমি একা যেন গোরস্তান আগলাচ্ছি। আজ আমার সামনে জমাটবাঁধা হাহাকার আর হাহুতাশ সম্বল। অখন্ড নীরবতার মধ্যে বার বার মৃত্যুর কথাই আমার অন্তরের  অন্তস্থলে ভেসে উঠতে লাগলো।

প্রথম দরজাটি খুলতেই আমার চোখের সামনে বেহেস্তের বাগিচার মত মনলোভা এক ফল-ফুলের বাগিচা ভেসে উঠল। চাবি ঘুরিয়ে দ্বিতীয় দরজাটি খুল্লাম। কেবলই জানা অজানা রঙ-বেরঙ্গের কত সব ফুলগাছে বিচিত্র সমারোহ যে এখানে ঘটেছে
তা বলে শেষ করা যাবে না। এমন চিত্তাকর্ষক অনন্য সৌন্দর্য অন্য কোথাও আছে বলে আমার অন্ততঃ জানা নেই। আমার অন্তরাত্মা পুলকে নেচে উঠল। বারবার মনের কোণে বার বার একটি কথাই ভেসে উঠতে লাগল, আমি কি সত্যি জেগে, নাকি ঘুমের ঘোরে খোয়াব দেখছি?

চাবি ঘুরিয়ে প্রাসাদের তৃতীয় দরজাতি খুলে ফেললাম। এবার বাগিচার অন্য এক প্রান্ত চোখের সামনে ভেসে উঠল। পাখি, গাছের ডালে ডালে কত রঙ আর কতই না আকৃতি বিশিষ্ট পাখি একত্র সমাবেশ ঘটেছে এখানে। তাদের খেলা দেখতে দেখতে চোখ দুটো বুজে এল। কখন যে অমার চোখের পাতা দুটো এক হয়ে এসেছিল, বুঝতেই পারি নি। ঘুমের মধ্যে নিজেকে সঁপে দিয়ে ঘাসের বিছানায় শরিল এলিয়ে দিলাম।

পাখির কাকলিতে সকাল হ’ল। চাবির গোছাটি হাতের মুঠোর মধ্যেই রয়েছে দেখলাম। চতুর্থ দরজাটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল সুপ্রশস্ত এক উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। চন্দন কাঠের
অতিকায় চল্লিশটি দরজা প্রাসাদটিকে ঘিরে রেখেছে। প্রত্যেকটি দরজার গায়েই সুক্ষ শিল্পীর মনলোভা কারুকার্যের স্বাক্ষর সুস্পষ্ট।

এ কৌতূহলের শিকার হয়ে আরও একটি দরজা খুলে ফেল্লাম। আমি যেন মুক্তার সাগরে পড়ে গেলাম। রাশি রাশি বস্তা বস্তা মুক্তা ঘরের মেঝেতে রাখা হয়েছে। আর এক একটির অকৃতিও এমনই বিশাল, যা এর আগে কোনদিন প্রত্যক্ষ করার বরাত আমার হয় নি। পাশের ঘরে যেতেই আমার মুখ দিয়ে অচমকা বেরিয়ে এল— হায় আল্লাহ্! এযে রুবী আর হীরার পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে।
তার পরের ঘরে ঢাই করে রাখা হয়েছে পান্না। তার পাশের ঘরে পৰ্বত সমান সোনা৷ ইয়া বড় বড় সোনার তালের পর্বত। আর একটি ঘরে মোহরের ঢিবি। তার পরেরটিতে ছাদ পর্যন্ত স্তরে স্তরে সাজানো রূপোর বাট তার পরেরটিতে রৌপ্যমুদ্রার পাহাড়।

আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম—হায় খোদা! এত ধন-রত্ন তো আমার সারা রাজ্যেও নেই!

আমার অখণ্ড অবসর। নেই বলতে কিছুই করার নেই। ফলে চাবি ঘুরিয়ে এক একটি দরজা খুলে প্রাসাদের কোথায় কি রয়েছে, দেখে বেড়াতে লাগলাম এবার একটিমাত্র চাবি বাকি রয়েছে। আর আমার অদেখা রয়েছে একটিমাত্রই ঘর। তবেই ষোলকলা পূর্ণ হয়। সে-মুহূর্তেই রূপসী যুবতীদের সতর্কবাণীর কথা আমার মনের
কোণে ভেসে উঠল। চাবিটি ভুলেও ব্যবহার কোরো না। কৌতূহলের শিকার হয়ে চাবিটি ঘুরিয়ে ঘরটি খুললেই কেলেঙ্কারীর চূড়ান্ত হয়ে যাবে।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার এবং অচেনাকে চেনার কৌতূহল আমার মনকে প্রতিনিয়ত নাড়া দেয়। এবার তাদের আর একটি কথা মনের কোণে ডেসে উঠল—
যদি কৌতূহলের শিকার হয়ে চাবি ঘুরিয়ে ঘরের দরজাটি ঘোল তবে আর কোনদিনই আমাদের দেখা হবে না। মেহেবুব তোমাকে হারানোর ইচ্ছা আমাদের মোটেই নেই। আমাদের অনুরোধটি রাখবে আশা করছি। ওই দরজার ত্রি-সীমানায়ও যেয়ো না।

উদ্ভিগ্ন যৌবনা রূপসীদের পাওয়ার লোভ আর ঘরের ভেতরে এমন কি আছে তা দেখার অদম্য কৌতূহল— এই দুয়ের মাঝখানে পড়ে আমি প্রায় বে-সমাল হয়ে পড়লাম। কেনটিকে আমি বেছে
নেব! তাদের যৌবনের জোয়ারলাগা সুখ ও তৃপ্তিদায়ী দেহ, নাকি ঘরের ভেতরের বস্তু দেখা? তাদের মহব্বত অনন্য সৌন্দর্যের স্বাদ আর দেহলতা আস্বাদনের মাধ্যমে পরিতৃপ্তি লাভের কথা এ জন্মে আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। একের পর এক করে চল্লিশটি রাত্রি আমি উদ্ভিগ্ন যৌবনা রূপসীর দেহলতা দলন, পেষণ, চুম্বন আর
সম্ভোগের মধ্য দিয়ে নিজে স্বর্গীয় সুখ লাভ করেছি আবার তাদেরওবদিয়েছি অপার আনন্দ। সে-সুখ চিরদিনের মত বিসর্জন দিতে কোন আহাম্মকের মন চায়?

আমার সর্বনাশের চূড়ান্ত হবে, নারীদেহ সুখ, স্বর্গসুখ চিরদিনের মত বিলুপ্ত হবে জেনেও আমি অদম্য কৌতূহলের শিকার হয়ে এক নিঃশ্বাসে তালার ভেতরে চাবিটি ঢুকিয়ে দিলাম। বরাত ঠুকে চাবিটি ঘোরালাম। ব্যস, দরজাটা আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হয়ে গেল। কিন্তু হায়! কিছুই আমার চোখে পড়ল না। উৎকট একটি গন্ধ ছড়া কিছুই উপলব্ধি করতে পারলাম না।

অংশ্চর্য ব্যাপার তো। উৎকট গন্ধটি ক্রমে উগ্র থেকে উগ্রতর হাতে লাগল। আমার মাথার মধ্যে ঝিমঝিমানি শুরু হয়ে গেল। আর কোন্ অদৃশ্য হাত যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে আমার মাথার মধ্যে হাতুড়ি পিটিয়ে চললো। ব্যস, তার পরই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম। তারপরই সব বিস্তৃতির অতলে তলিয়ে গেল।

কতোক্ষণ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়েছিলাম ঠিক মনে নেই। জ্ঞান যখন ফিরল তখন ধীরে ধীরে উঠে পাশের ঘরের ভেতরটা দেখার জন্য ধীর পায়ে এগোতে লাগলাম। দরজাটি ফাঁক করে ভেতরে
উঁকি দিতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল মোমবাতির মিষ্টি মধুর আলোর অপরূপ রশ্মি। মোমবাতির আলোয় দেখলাম, ঘরের কোণে রয়েছে একটি কালো ঘোড়া খুবই মোটাসোটা। তার কপালে সাদা একটা তারা। সামনের ডান পায়ে আর পিছনের বাঁ-পায়ে সুদৃশ্য সাদা তারার মোজা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর পিঠের সোনার জিনে মোমবাতির আলো পড়ে চকচক করছে। একটি
গামলায় খাবার আর একটিতে খাবার জল রাখা রয়েছে।

ছেলেবেলা থেকেই বেপরোয়া ঘোড়সওয়ার হিসাবে আমার খুব নাম ডাক ছিল। বহু তেজী দৌড়বীর ঘোড়াকে আমি বহুবার দৌড়ে হারিয়ে দিয়েছি। তাই এমন মোটাসোটা ও তেজী কালো ঘোড়াটি দেখেই আমার খুব লোভ হ'ল।

লোভের বশবর্তী হয়ে কালো সে ষোড়টিকে বাগিচায় এনে দাঁড় করালমে। কিন্তু যখন তাকে নিয়ে এগোবার চেষ্ট করলাম তখন সে জগন্দল পাথরের মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইজ। এমন বেয়াড়া জানোয়ার আমি জন্মেও দেখিনি। অধৈর্য হয়ে ঘা কতক চাবুক কষিয়ে দিলাম। মুহূর্তে তার দেহের দু' পাশ থেকে দুটো সুদৃশ্য পাখা বেরিয়ে এল।
পাখা দুটো যে চমৎকার ভাবে গোটানো ছিল আগে দেখতেই পাইনি। আমি তড়াক করে লাফিয়ে তার পিঠের জিনের উপর বসে পড়লম। দু’হাতে শক্ত করে লাগাম ধরলাম। এবার পা দুটো দিয়ে তার পেটের দু'পাশে বার কয়েক গুঁতো দিতেই সে বাতাসের বেগে শূন্যে উঠতে শুরু করল। পাহাড় পর্বত, নদী-নালা আর বনবাদাড় অতিক্রম করে আমার কালো মানিক পঙিরাজটি আমাকে নিয়ে
বাতাসের বেগে এগিয়ে চলল। দেহ-মনে এক অনাস্বাদিত পুলক অনুভব করতে লাগলাম।

এক সময় এক ছাদের ওপর ধীরে ধীরে নামল আমার পঙ্খীরাজ। আমি ব্যস্ত হয়ে নামতে গেলাম। আচমকা তাঁর একটি ডানার আগাত লাগল আমার বাঁ চোখে। আমি আর্তনাদ করে চোখটি চেপে ধরলাম। এ-সুযোগে সে আকাশে ডানা মেললো। চলে গেলো একেবারে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

আমি বা-চোখের যন্ত্রণার কাৎরাতে কাৎরাতে সিঁড়ি ভেঙে কিছুটা নিচে নামতেই বাঁ-চোখ কানা যুবক দশজন আমার সামনে আবির্ভূত হ'ল।

তারা ক্রুদ্ধস্বরে বললো- কতবার নিষেধ করেছিলাম, পাত্তাই দাওনি তখন। এখন? আর এ-ও তো বলেছিলাম এখানে দশজনের বেশী স্থান সঙ্কুলান হবার নয়। আমরা তো দশজন আগে থেকেই রয়েছি। তোমাকে কিছুতেই জায়গা করে দেওয়া সম্ভব নয়। মানে মানে কেটে পড়।

একজন মুহূর্তকাল ভেবে নিয়ে বললো–
তোমাকে একটি বুদ্ধি দিচ্ছি, বাগদাদ নগরে চলে যাও। সেখানকার খালিফা হারুণ-অল-রসিদ পরম মহানুভব। তাঁর দয়া দাক্ষিণ্যের খ্যাতি তামাম দুনিয়ায় কে না জানে। তাঁর কাছে গেলে তোমার বসবাসের যা হোক একটি বিহিত হয়েই যাবে।

আমি যেন অথৈ সাগরে পড়ে গেলাম। দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে ফেল্লাম। কালান্দার ফকিরের সাজে সজ্জিত হলাম। পরিচিত জনও বুঝতে পারবে না, আমি বাদশাহ কাসিব-এর বেটা। বাগদাদে
পৌঁছে চৌরাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ভাবছি, কোথায় যাব, কোথায় গেলে আমার ঠাঁই মিলতে পারে। এমন সময় আরও দু'জন কালান্দার ফকিরের দেখা পেয়ে গেলাম। তাদেরও দাঁড়ি-গোঁফ কামানো আর বাঁ-চোখ কানা। তারপরই এ-বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লাম। আপনারা মেহেরবানি করে আশ্রয় দিলেন।

তৃতীয় কালান্দার ফকিরের কাহিনী শুনে তিন বহিনের মধ্যে বড়টি বল্‌ল—
ফকির সাহেব, তোমার কাহিনী আমাদের মুগ্ধ
করেছে। তোমাকে আমরা মুক্তি দিলাম। তুমি যেখানে খুশী যেতে পার।

এবার উজির জাফর ছোট মেয়েটির দিকে তাকিয়ে
বললেন— আমাদের যা কিছু কথা সবই তো তোমার কাছে ব্যক্ত করেছি। আমার জীবনে তো এর চেয়ে বেশী উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা ঘটেনি যা বলে তোমাদের হর্ষ উৎপাদন করতে পারি।

বড় লেড়কিটি মুচকি হেসে বললো—
যাক গে, তোমাদেরও মুক্তি দিলাম। যে, যেখানে খুশি চলে যাও, আপত্তি নেই।

লেড়কি তিনটির কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে খলিফা হারুণ-অল-রসিদ প্রাসাদে ফিরলেন। নির্ঘুম অবস্থায় নিদারুশ অস্থিরতার মধ্যে তিনি রাত্রি কাটালেন।