পরদিন সকালে দরবারে গিয়ে খলিফা হারুণ-অল-রসিদ জাফরকে ডেকে বললেন—
যতশীঘ্র সম্ভব সে-লেড়কি তিনটি আর তাদের কুচকুচে কালো কুকুর দুটোকে দরবারে হাজির কর।

তিন বহিন বোরখার আড়ালে নিজেদের ঢেকে নিয়ে দরবারে খলিফা ও তাঁর পারিষদনের সামনে হাজির হল।

উজির জাফর বললেন— কালরাত্রে আমরা যখন তোমাদের হাতে বন্দী হয়েছিলাম তখন কিন্তু আমরা তোমাদের কাছে আমাদের প্রকৃত পরিচয় গোপন করেছিল। এখন তোমরা খলিফা হারুণ-অল-রসিদের দরবারে উপস্থিত হয়েছ। তোমরা এখানে যা কিছু বলবে তাতে কিন্তু ভুলেও কিছু মাত্র মিথ্যার আশ্রয় নেবেনা। আমরা
তোমাদের পরিচয় এবং মালী কুকুর দুটোর কথা জানতে চাচ্ছি। বল, এ ব্যাপার তোমাদের কি বলার আছে?

বড় লেড়কিটা এবার  এগিয়ে এসে যথোচিত কায়দায় কুর্নিশ করে বলতে শুরু করলো-
জাহাঁপনা, আপনার সামনে মিথ্যা বলার ইচ্ছা আমার নেই, সম্ভবও নয়। আমার জীবন কথা এমনই অদ্ভুত যে, নিতান্তই অবিশ্যাস মনে হবে। মিথ্যার প্রলাপের সন্ধান পাবেন না।

বেগম শাহরাজাদ এ পর্যন্ত বলতেই প্রাসাদ সংলগ্ন বাগিচায় ভোরের পাখিদের কলকোহল শুরু হয়ে গেল। তিনি কিস্সা বন্ধ করলেন।


ষোড়শ রজনী


বাদশাহ শাহরিয়ার অন্দর মহলে বেগমের কাছে আসতেই তিনি আবার কিস্সা শুরু করলেন— জাহাপনা, তারপর বড় মেয়েটি তাদের কাহিনী ব্যক্ত করতে গিয়ে বললো—
আমার নাম জুবেদাহ। আমার মেজো বহিনের নাম আমিনাহ আর ছোট বহিন কহিমাহ। আমাদের তিনজনেরই আব্বা একজন, আম্মা অবশ্য আলাদা আলাদা। আমার বাবার বড় বিবির গর্ভে আমার জন্ম। আমার আরও দু'জন সহোদরা ছিলেন। তারা আমার চেয়ে বড় ছিলেন। আর দুই
বিবির গর্ভে জন্ম গ্রহণ করে আমিনাহ ও কাহিমাহ।

মৃত্যুকালে আমার আব্বা পাঁচ হাজার দিনার রেখে যান। আব্বাজী মারা গেলে কাহিমা ও আমিনা তাদের আম্মার কাছে চলে যায়। আমরা তিন বহিন রয়ে গেলাম বাড়িতেই।

এক সময় আমার বড় বহিনদের শাদী হয়ে গেল। তারা আব্বাজীর রেখে যাওয়া দিনারের ভাগ দিয়ে বাণিজ্য করার ধান্দা করল। ভগ্নীপতিদের একজন তার যা কিছু অর্থ ছিল সব নিয়ে নৌকায় চাপলেন। সওদাগরী ব্যবসা করার জন্য ভিন দেশে যাত্রা
করলেন। তারপর অন্যজনও একই ব্যবসার জন্য জাহাজ নিয়ে ভিন দেশের উদ্দেশে পাড়ি জমালেন। আমার বড় বহিনরাও নিজ নিজ স্বামীর সঙ্গ নিলেন।

আমি একা বাড়ি আগলাতে লাগলাম। এক এক করে চার চারটি বছর কেটে গেল। তারপর সব খুইয়ে তারা ভিখারী হয়ে ঘরে ফিরে এল। জীর্ণ তাদের বেশ। শীর্ণকায় দেহ! মাথার চুল পর্যন্ত রুক্ষ। এমতাবস্থায় আমি তাদের প্রথমে চিনতেই পারি নি। নিজেদের পরিচয় দেওয়ার পর তবে চিনতে পারলাম যে, তাঁরা আমার বড় বহিন।

আমার ভগ্নীপতিরা যা কিছু সওদা করেছিল, সবই লুঠপাট করে নিল। এমন কি একটি দিনারও তাঁদের সম্বল ছিল না। বেকায়দায় পড়ে উহারা আমার বড় বহিনদের এক শহরে ফেলে গা-ঢাকা দেয়। পালিয়ে যায়। একবস্ত্র সম্বল তাদের। দু'বছরের মধ্যে একদিনও গোসল করতে পারে নি। সবই খোদাতাল্লার মর্জি।

বাড়ি ফিরে আসার পর আমি আমার বড় বহিনদের যা কিছু দরকার সবই সরবরাহ করলাম। নতুন করে বাঁচার ধান্দা করতে বললাম। কাবুল করলাম, আমার সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা থেকে তারা কোনদিনই বঞ্চিত হবে ন।

আমার বড় বহিরা আমার কাছেই থেকে গেল। আমি মূলধন দিয়ে তাদের ব্যবসায় লাগিয়ে দিলাম। একদিন আমার বড় বহির আবার শাদীর চিন্তা করল। তাদের ইচ্ছার কথা আমাকে জানাল। আমি সবিস্ময়ে বললাম— সে কী কথা! আবারও শাদী। একবার শাদী করে তো তোমাদের যথেষ্টই
শিক্ষা হয়েছে। আজ কালকার মানুষ প্রায় সবই ঠগ, আর বিশ্বাসঘাতক। প্রকৃত মানুষ নেই বললেই চলে।

আমার কথা তারা শুনল না। নিজেরাই গোপনে পাত্র নির্বাচন করে ফেললো। ফলে অনন্যোপায় হয়েই আমি তাদের শাদীতে মত দিলাম এবং পাশে দাঁড়িয়ে যাবতীয় ব্যবস্থাদি করলাম।

শাদীর পর আমার বড় বহিনরা তাদের স্বামীদের সঙ্গে আবার সওদাগরী ব্যবসা করার জন্য ভিন্ দেশে পাড়ি জমাল। কয়েক মাস পেরোতে না পেরোতেই এবারও পূর্ব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। তারা সবকিছু নষ্ট করে একেবারে নিঃস্ব রিক্ত
অবস্থায় বাড়ি ফিরল। আর এবারের স্বামীরাও আগের দুজনের মতোই জনবহুল বন্দরে তাদের ফেলে রেখে চম্পট দিল। তারা এসে গোমড়া মুখে আমার সামনে দাঁড়াল। নিজেদের কৃতকর্মের
জন্য আমার কাছে নানাভাবে অনুশোচনা শুরু করল। আমি প্রবোধ দিলাম। তারা নিজেরাই বললো ভুলেও আর কোনদিন শাদীর পিঁড়িতে বসব না। আমি তাদের অবার নতুন করে তাদের প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য প্রেরণ দিতে লাগলাম।

আমরা তিন বহিন আবার এক সঙ্গে বছর খানেক কাটালাম। এবার বানিজ্যে যাবার জন্য আমি উৎসাহী হয়ে পড়লাম। বড় বহিনরাও আমার পিছু নিল। আমার জাহাজ ভাসলো। আমার যা কিছু অর্থকড়ি ছিল তার অর্ধেক বাড়িতেই পেপন স্থানে মাটির তলায় পুঁতে রেখে গেলাম। অবশিষ্টাংশ নিলাম সঙ্গে। নইলে সব খুইয়ে বাড়ি ফিরতে হলে দুর্গতির সীমা থাকবে না।

আমাদের জাহাজ চলেছে তো চলছেই। কাপ্টেন ব্যাজ্যার মুখে একদিন বলেন— আমরা নসীবের ফেরে পড়েছি। পথভ্রষ্ট হয়েছি। বহু চেষ্টার পর একটি বন্দরে জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হ’ল।
জানা গেল বন্দরটি ডিসেম্বার্ক নামে পরিচিত।

খোদাতাল্লার নাম নিয়ে নগরের পথে চলতে লাগলাম। প্রথম দর্শনেই আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। পথের ধারে যত বড়ি চোখে পড়ল সেগুলো সবই কুচকুচে কালো, কষ্টিপাথরের তৈরি।
আরও বিস্মিত হলাম যখন দেখলাম, দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েও আমরা কোন মানুষের দেখা পেলাম না। আবার দোকান রাজার সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নামী নামী দ্রব্য সামগ্রীতে দোকান একেবারে
ঠাসা। কিন্তু কোন দোকানেই দোকানির দেখা পেলাম না।

আমরা হাটতে হাটতে একটি চৌরাস্তার কাছে এলাম। এবার চারজন চারদিকে হাঁটা জুড়লাম। উদ্দেশ্য মূল্যবান অলঙ্কারাদি ও চকচকে পোশাক পরিচ্ছদ ক্রয় করা।

আমি একা একা কিছুদূর অগ্রসর হতেই বিশালায়তন একটি প্রাসাদের সামনে উপস্থিত হলাম। সোনার তৈরি তার সিংহদরজাটি,
প্রাসাদের দরজা পর্যন্ত খাঁটি সোনার। দরজাটি ডিঙ্গিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আমাকে থমকে যেতে হ'ল। সুসজ্জিত বিশালায়তন কক্ষে মণি মাণিক্য খচিত মনলোভা এক সিংহাসনে বাদশাহ উপবিষ্ট। তার উভয় পার্শ্বে নিজ নিজ সোনা ও রূপার আসনে উজির-নজির এবং আমির ওমরাহরা অবস্থান করছেন। কিন্তু অবিশ্বাস্য ব্যাপার হচ্ছে
সবাই যেন নিষ্প্রাণ। পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল নিথর। ভাবলাম এ কী কারো অভিশাপের জের?

আমি দরবারকক্ষ ডিঙ্গিয়ে হারেমে প্রবেশ করলাম। সেখানেও সোনার ছড়াছড়ি বেশ কয়েকজন বেগম সোনার পালকে গা-এলিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে। তাদের সবার পাশেই সোনার পাখা হাতে
পরিচারিকারা কেউ দাঁড়িয়ে আবার কেউ বসে রূপোর জলচৌকিতে বসে। এখানেও কারো প্রাণের স্পন্দন আছে বলে মনে হয় না।

এবার পাশের আর একটি ঘরে ঢুকলাম। সেটি আরও মনোরম করে গোছানো। এক এক করে অনেকগুলো কক্ষে ঘুরে বেড়ালাম। কিন্তু ক্রমেই
আমার বিস্ময় গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠল। প্রাসাদের কোথাও কোন জীবন্ত মানুষের দেখা পেলাম না। তবে এটুকু নিঃসন্দেহ হলাম যে, একদিন না একদিন এরা সবাই রক্ত-মাংসে গড়া জীবন্ত মানুষই ছিল। ব্যাপারটি জানবার জন্য আমার অন্তরের অন্তস্থলে কৌতূহল জমাট বাঁধতে লাগল। আশ্চর্য ব্যাপার! এতবড় একটি প্রাসাদে কেনই জীবন্ত মানুষের দেখা পেলামনা যার কাছ থেকে এখানকার রহস্যের কথা জানতে পারব। তবে এমন নিদর্শন আমার সমনে আছে, যাতে করে আমি নিশ্চিত হতে পারছি কোন না কোন জীবন্ত
মানুষের অস্তিত্ব এখানে রয়েছে। আমি উদ্‌দ্ভ্রান্তের আমর বাঞ্চিত জীবন্ত মানুষের খোঁজে প্রাসাদের সর্বত্র হন্যে হয়ে ছুটে ছুটি করে বেড়াতে লাগলাম।

ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল আমি ক্লান্ত অবসহ দেহে বাদশাহের ঘরে ফিরে এলাম। প্রহার করে নয়। বাদশাহের শয়নকক্ষে। শয্যায় গা এলিয়ে দিলাম। শিয়রে এক খন্ড কোরান শরিফ রাখা ছিল। বিছানায় শুয়ে ঘুমোবার আগে পর্যন্ত আমি বহুদিন ধরে কয়েক পাতা করে কোরাণ পড়ি। মন পরিষ্কার থাকে, আনন্দের সঞ্চার হয়। সোনার পাত দিয়ে যত্ন করে বাঁধানো কেরাণটি হাতে তুলে নিলাম। অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে কয়েকটি উপদেশামৃত পাঠ করলাম।  তারপর ধর্মগ্রন্থটি যথাস্থানে রেখে ঘুমোতে চেষ্টা করলাম।

না, কিছুতেই দু' চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। মাঝরাত্রি পেরিয়ে গেল। এমন সময় হঠাৎ শুনতে পেলাম, কে যেন সুমিষ্ট স্বরে কোরানের বাণী সুর করে পাঠ করছে। উৎকর্ণ হয়ে লক্ষ্য
করলাম। হ্যাঁ, অনুমান অভ্রান্ত। কোরানের বাণীই বটে।

তড়াক করে লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। কণ্ঠস্বরটি অনুসরণ করলাম। একটি জ্বলন্ত চিরাগ নিয়ে কণ্ঠস্বরটি অনুসরণ করে বিশালায়তন এক ঘরে ঢুকলাম। মনমুগ্ধকর কারুকার্যশোভিত
একটি মসজিদ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল সবুজ একটি বাতি টিম টিম করে জ্বলছে। আর মেঝেতে বসে পশ্চিম দিকে মুখ করে এক সুদর্শন যুবক মিষ্টি মধুর সুরে কোরাণের বাণী পাঠ করে
চলেছে। আমি যে তার পাশে প্রায় গা-ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে রয়েছি, কিছুমাত্র খেয়ালও তার নেই।

কোরাণ পাঠরত যুবকটির পাশে দাঁড়িয়ে একটি কথাই আমার মনে বার বার জাগছিল, পাষাণ পুরীতে ছোট-বড় সবাই যখন প্রস্তরীভূত হয়ে পড়ে আছে তখন এ যুবকটি কি করে অব্যহতি
পেল। রক্ত-মাংসের মানুষই রয়ে গেল। যদি সে মুহূর্তে প্রাসাদের বাইরে থেকে থাকত তবু তো অভিশাপ এড়াতে পারা সম্ভব ছিল না। কারণ, প্রাসাদের বাইরেও তো কোন প্রাণবন্ত প্রাণীর দেখা মেলে নাই। তবে? কি করে এ-যুবকটি প্রাণ নিয়ে টিকে রইল?

আমি তাকে সালাম জানিয়ে বললাম—
ভাইজান, তোমার মধুরস্বরে কোরাণের বাণী পাঠ আমার মন-প্রাণকে মুগ্ধ করেছে। পাঠ করে যাও। আল্লাহর পবিত্র নাম শুনে জীবন ধন্য করি।
মেহেরবানি করে পাঠ বন্ধ করো না।

সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো। তারপর তেমনি মধুর স্বরে বলল- তোমার কথা আমি রাখব সুন্দরী। তার আগে আমাকে বল, তুমি কি করে এখানে, এ প্রাসাদে এলে?'

তার বাঞ্ছা পূরণ করতে গিয়ে আমি তাকে আমার
আদ্যোপান্তকাহিনী বল্লাম। তারপর তার নিটোল-নিখুঁত মুখের দিকে তাকালাম। অতি অপরূপ তার দেহসৌষ্ঠব। চোখ ফেরানো দায়। আমার দেহ-মনে রোমাঞ্চ জাগল । অন্তরের অন্তস্থলে যেন দপ্ করে আগুন জ্বলে উঠল। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে লাগল আমাকে। প্রথম পরিচয়ে মুহূর্তেই নিজেকে নিঃস্ব রিক্ত করে কাউকে যে বিলিয়ে দেওয়া সম্ভব এর আগে কোনদিন বুঝিনি। আমার সবকিছু যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল। আমার কথা শেষ করে তাকে বল্লাম—
আমার বৃত্তান্ত তো শোনালাম, এবার তবে তোমার কথা কিছু বলে আমার কৌতূহল নিবৃত্ত কর।

অনিন্দ্য সুন্দর যুবকটি এবার তার কাহিনী শুরু করল— আমার আব্বা এক সময় এ নগরের সুলতান ছিলেন। প্রজারা তাকে অন্তর দিয়ে পেয়ার করত, শ্রদ্ধা-ভক্তি করত। তিনিও তাদের নিজের
সন্তানের মতই স্নেহ-মায়া-মমতা দিয়ে আগলে রাখতেন। কিন্তু আল্লাহর মর্জিতে এখানকার মানুষজন, পশু-পাখি ও কীট-পতঙ্গ সবই পাথরে পরিণত হয়ে যায়। আর ওই যে সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখছ তিনিই আমার আব্বা। আর হারেমে প্রস্তুরিভূত যে প্রধান বেগমকে পালঙ্কের ওপর অর্ধ শায়িত দেখে এসেছিলে তিনিই আমার গর্ভধারিণী।

আমার আব্বা এবং আম্মা উভয়েই, যাদুবিদ্যায় পারদর্শী তারা ছিলেন অস্বাভাবিক রকম নাস্তিক। ঈশ্বরটিশ্বর মোটেই মানতেন না। কি করেই বা মানবেন? এঁরা উভয়েই যে শয়তান নারদুন- এর বর্ণীভূত। তাকেই মন-প্রাণ সঁপে দিয়েছেন।

অমার আব্বার বিয়ের বহুদিন পর আমার জন্ম হলো। তাঁদের একমাত্র লেড়কা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমি তাঁদের চোখের মনি হয়ে পলে পলে বাড়তে লাগলাম। আমার আব্বা
আমার ওপর দুটো ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন আমি যেন বড় হয়ে তাঁর মসনদের মর্যাদা রাখতে পারি। আর তাঁর একান্ত আরাধ্য শয়তান নারদুন-এর প্রতি আস্থাভাজন হই।

আগেই বলেছি আমার আব্বার আল্লাহের প্রতি কিছুমাত্রও বিশ্বাস তো ছিলই না বরং অন্তরে অশ্রদ্ধা পোষণ করতেন। আর তাঁর প্রাসাদে ও দরবারে আল্লাহর নামাজ পড়া তো দূরের কথা তাঁর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করা নিষেধ ছিল। কিন্তু প্রাসাদে এক মহিলা লুকিয়ে চুরিয়ে আল্লাহ-র নামজপ করত। নামাজ পড়ত। পয়গম্বর হজরত মুহাম্মদ-এর নাম করত। কিন্তু বাইরে, বিশেষ করে আমার বাবার কাছে প্রকাশ করত, সে যেন পরম নাস্তিক। তার মতো ইসলামের শত্রু দ্বিতীয় একজন নেই। আমার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সে-বৃদ্ধার ওপর বর্তাল। বাবা তাকে বলেছিলেন— 'আমার একমাত্র লেড়কাকে ভবিষাৎ যোগ্য সুলতানরূপে গড়ে তোলাই হবে তোমার একমাত্র কর্তব্য। সে যেন আমার বংশের এবং আমার মুখ উজ্জ্বল করতে সক্ষম হয়। আর তাকে আমার উপাস্য নারদুন এর শ্রেষ্ঠ ভক্তে পরিণত করবে।'

বৃদ্ধা রীতিমত দৃঢ়তার সঙ্গে বললো—
জাহানা, আপনি আমর উপর সম্পূর্ণ অস্থা রাখতে পারেন। আমি অবশ্যই তাকে আপনার মনের মত করে তৈরি করতে পারব। সে হবে আদর্শ মানব আর আদর্শ সুলতান।

আমার আব্বাকে কথা দেওয়ার পর সে কিন্তু গোপনে আমাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করল। শয়তান নারদুন-এর নামও আমাকে উচ্চারণ করতে দিল না। আমাকে কোরাণ শরিফ পাঠ করে শোনাতে লাগল। আল্লাহর মহিমার কথা, তাঁর ফরমানের কথা আমাকে নিয়মিত শোনাত। আমিও সর্বান্তকরণে আল্লাহর ফরমান মান্য করে পরম অস্তিক হয়ে উঠলাম।

তামাকে সতর্ক করে দিতে গিয়ে বৃদ্ধা প্রায়ই বলত—
খবরদার, এ সব কথা যেন তোমার আব্বার কানে ভুলেও তুলো না। তিনি টের পেলে কেলেম্বরীর চূড়ান্ত হয়ে যাবে। খেয়াল থাকে যেন। তবে
কিন্তু আমার গর্দান যাবে। আমার ইচ্ছা, তোমাকে একজন আদর্শ মানৰ করে তুলি। এর জন্য চাই সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি অটুট বিশ্বাস। নরদুন-এর উপাসক তোমার আব্ব। অধর্মের পথে,
অসত্যের পথে আর ধ্বংসের পথে অশ্বের মত ছুটে চলেছেন। তিনি শয়তানের উপাসক। নারদুন এক সাক্ষাৎ শয়তান। সে সর্বনাশের আর ধংসের পথপ্রদর্শক। প্রেম প্রীতি-ভালবাসা ও জীবনের প্রতি দয়া দাক্ষিণ্য ও দৈার্য কাকে বলে তা তার অজ্ঞাত। অতএব তুমি অন্তরের প্রেম-ভালবাসা নিঙড়ে মানুষদের আপন করে নেওয়ার মানসিকতা অর্জন করে। অদর্শ মনব হয়ে ওঠ।

আমার ঈশ্বরীয় পাঠদানা শেষ করে একদিন আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাসী বৃদ্ধাটি মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বেহেস্তের পথে যাত্রা করলেন।

এক মধ্যরাতে আল্লাহ নিদ্রিত নগরবাসীকে স্বপ্ন
দেখালেন— আর ঘুমিয়ে থেকো না। জাগো। আমিই একমাত্র উপাস্য, আমার অঙ্গুলি হেলনেই দুনিয়ার সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ব প্রকৃতি যা কিছুর অস্তিত্ব দেখতে পচ্ছ, সবই আমার
সৃষ্টি। আমাতেই সৃষ্টি। আবার ক্ষয়ও আমাতেই। যাদুকর নারদুন-এর মায়া-মোহে তোমরা অন্ধ হয়ে আমাকে অস্বীকার করছ। পাপের সাগর থেকে তোমাদের উদ্ধার করে তোমাদের যথার্থ মুক্তির পথের সন্ধান দিতে তারা অক্ষম। তোমাদের মুক্তিদানের ক্ষমতা কিছুমাত্রও তাদের নেই। পাপ, অন্যায় আর ব্যাভিচারই যে তার একমাত্র অবলম্বন। আমার মধ্য দিয়েই তোমরা একদিন মুক্তির স্বাদ পাবে। সার্থকতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

পাখির ডাকে ভোর হ'ল সূর্য উঠতে না উঠতেই নগরবাসীরা দলে দলে কাতারে কাতারে সুলতানের দরবারে উপস্থিত হতে লাগলো। সবার মুখেই ভীতি আর হতাশার ছাপ। সুলতান সব শুনে শরবে হেসে উঠলেন— মুষড়ে পোড়ো না। আমাকেও শয়তানটি
এই একই রকম স্বপ্ন দেখিয়েছিল। আর শাসিয়েছে তার কথামত না চললে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। ওসব বাজে চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলো। নারদুনই রক্ষা করবে। তিনি সর্বশক্তির আঁধার। তোমরা নির্ভয়ে বাড়ি ফিরে যাও।

সুলতার কথা শুনে প্রজারা আশ্বস্ত হয়ে যে যার বাড়ি ফিরে গেল। পুরো একটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। প্রজারা অভিশপ্ত রাক্তির ভয়ঙ্কর সে স্বপ্নর কথা ভুলে গেল। তারপর আবার একই
রকম দৈববাণী হ'ল। এখনও সময় আছে। তোমরা আমার আদেশ পালক করো। শয়তান নারদুন এর কাছ থেকে তোমাদের বিশ্বাস-ভক্তি তুলে এনে আমার প্রতি আস্থাবান হও। অন্যথায় ধ্বংস হয়ে যাবে বলে রাখছি।

সুলতানকে আবার সব কিছু জানানো হ’ল। তিনি এবারও পাত্তাই দিলেন না। উপরন্তু বজ্রগঞ্জীর সুরে হম্বিতম্বি করলেন। নারদুনে বিশ্বাস রাখ! অগ্নির আরাধনা কর। ব্যস, সর্ব-বিঘ্ননাশ হয়ে যাবে।
একমাত্র তিনিই দিতে পারেন মুক্তিপথের নির্দেশ।

তারপরের বছর এক মাঝ-রাতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। একই স্বরে দৈববাণী হ'ল। আল্লাহর ফরমল জারি হ'ল। প্রজারা আবারও
সুলতানের শরনাপন্ন হন। সুলতান কিন্তু একই
জেদ বজায় রাখলেন।

ব্যস, আর দেরী নয় অক্সাহ-র ফরমান অনুযায়ী কাজ না করায় প্রজাদের ভয়ঙ্কর এক ঘটনার মুখোমুখি হতে হ'ল। আকাশের গায়ে দেখা দিল এক উল্কাপিণ্ড।  চোখের পলকে নগর জুড়ে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল। ব্যস, সব শেষ। নগরে যত মানুষ ছিল সবাই চোখের পলকে পাষাণ মূর্তিতে পরিণত হয়ে গেল। কেবলমাত্র- মানুষই নয়, গরু, ছাগল, ভেড়া, উঠ, গাধা আর খচ্চরগুলো পর্যন্ত বাদ গেল না। সবাই প্রস্তরীভূত হয়ে গেল। ইসলামে বিশ্বাসী, আল্লাহ-র প্রতি অকৃত্রিম আস্থাবান কেবল আমিই অব্যাহতি পেয়ে
দেখলাম।

ব্যস, এনগরীর সবাই পাষাণমূর্তি আর আমি একাই শুধু রয়ে গেলাম রক্ত মাংসের প্রাণবন্ত মানুষ। নিঃসঙ্গ আমি সারাদিন কোরাণ শরিফ পাঠ করে, আল্লাহর নামগান করে দিন গুজরান করি। সুন্দরী,
এতদিন পর রক্ত-মাংসের প্রাণবস্তু মানুষ তোমাকে কাছে পেয়ে আমার মনে যে কী আনন্দ হচ্ছে তা বুঝিয়ে বলতে পারব না!
অনেকদিন পর প্রাণ খুলে দুটো কথা যে বলতে পারছি তা আল্লাহর দয়াতেই।

আমি তার আচরণে মুগ্ধ হলম। আর তার অসহায় অবস্থার কথা বিবেচনা করে তার প্রতি সহানুভূতিতে মন প্রাণ ভরে উঠলো।
সমবেদনার সুরে বললাম— এ প্রষাণপুরী ছেড়ে আমাদের বাগদাদ নগরীতে চল না কেন সেখানে কেউ কারো প্রতি ঈর্ষা করে না। আল্লাহর অলী পীর হারুণ-অর-রসিক সেখানকার শাসক। সুলতান। প্রজাবৎসল সুলতান। কেউ কোনদিন সহায্য প্রার্থনা করে হতাশ হয়ে ফিরে গেছে, শোনা যায় নি। ইসলাম ধর্মের অনেক বড় বড় পণ্ডিত ব্যক্তিদের সঙ্গে জান পহচান হবে। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে গভীর তত্ত্বের সন্ধান পাবে যাতে তোমার আল্লাতায়ালার ওপর অস্থা বাড়বে। এর দ্বিধা সংকোচ নয় চল। আজই পাষাণপুরী
ছেড়ে বেরিয়ে পড়া যাক। আর আমি এতদিন যে নিকা করিনি তা’ও হয়তো আল্লাহ তায়ালার মর্জিতেই। তোমাকে জুটিয়ে দেবেন বলেই
হয়ত আমকে এতদিন তিনি নিঃসঙ্গ করে রেখেছেন। বাগদাদে গিয়ে অমরা শাদী-নিকা করে স্বর্গ রচনা করি। উপলব্ধি করি জীবনের প্রকৃত স্বাদ।

বেগম শাহরাজাদ এ পর্যশু বলে তাঁর কিসসা বন্ধ করলেন।


সপ্তদশ রজনী


বাদশাহ শারিয়ার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে বেগমের ঘরে উপস্থিত হলেন।
বেগম শাহরাজাদ তাঁর কিস্সার পরবর্তী অংশ শুরু করতে গিয়ে বললেন —
জাঁহাপনা, জুবেদা তখন বাদশাহের পুত্রের মহব্বতে মাতোয়ারা।

বাদশাহের পুত্রের ঘরেই জুবেদা রাত্রিবাস করল। সকাল হল জুবেদা বাদশাহের পুত্রের পালঙ্কে, তার পায়ের কাছে শুয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে।

জুবেদা তার পরের ঘটনা সম্বন্ধে খালিফা হারুণ-অল-রসিদ 'কে বলল—
জাঁহাপনা, সকাল হতেই আমি চোখ মেলে তাকালাম। দেখি, বাইরের বাগানে অনেক আগেই সূর্যের আলো পৌঁছে গেছে।'

মণি-মাণিক্য প্রভৃতি বহু মূল্য রত্ন যত বেশী সম্ভব পোটলা বেঁধে নিলাম। এবার বাদশাহের পুত্রকে নিয়ে আমার দেশের উদ্দেশ্যে পা-বাড়ালাম।

জাহাজে পৌঁছে দেখি আমার অদর্শনে বড় বহিনরা খুবই মুষড়ে পড়েছেন। সবার চোখে মুখে হতাশা আর উৎকণ্ঠার ছাপ।
আমি নবাগত বাদশাহের পুত্রের সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিলাম। আর এ-ও বললাম—
বাদশাহের ছেলে আমার মেহবুব।

আমার সঙ্গে বাগদাদ নগরে যাবে। আমরা শাদী করে সুখে ঘর-সংসার করব। তারপর গত রাত্রে যা কিছু ঘটেছিল সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। আমার বড় বহিনেরা ছাড়া জাহাজের ক্যাপ্টেন থেকে শুরু
করে খালাসীরা পর্যন্ত সবাই আমার কথায় খুশীতে ডগমগ হয়ে উঠল। এর একটিই কারণ— ঈর্ষা। যার ধন-সম্পদ অপরিমেয় এমন এক বাদশাহের পুত্রকে শদী করতে চলেছি শোনার পর তো তাদের মাথা ঠিক থাকার কথাও নয়।

আমাদের জাহাজ আবার নোঙ্গর তুললো। আমার মেহবুব সর্বদা এঁটুলির মত আমার গায়ে গায়ে লেগে থাকে। আমার মহব্বতের সময়ে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পরমানন্দে দিন কাটাতে লাগলাম।

অমার বড় বহিনরা ঈর্ষা করলে তো কিছু আর করার নেই। তারা তো শাদী করে ঘর বেঁধেছিলই। কিন্তু নসীবে জুটেছিল দু’জন প্রবঞ্চক। মধু খেয়ে প্রবঞ্চনা করে চম্পট দিয়েছে, তার জন্য আমরা
তো কোন অংশেই দায়ী নই।

অনুকুল বাতাস পেয়ে অমাদের জাহাজ তীর বেগে ছুটতে শুরু করল। ক’দিন-ক’রাত্রি অনবরত জাহাজ চালিয়ে কাপ্টেন আমাদের জাহাড়কে বন্দরে নোঙর করাল। আমরা স্বদেশে পৌঁছে গেলাম।

অমরা বাড়ি পৌঁছে সামন্য বিশ্রাম নিলাম। তারপর ভাল করে গোসল সেরে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে নিলাম।

রাত্রির অন্ধকার ক্রমে ঘনিয়ে এল। আমরা জাহাজের মধ্যে যে যার মত শুয়ে পড়লাম। এক অনাস্বাদিত রোমাঞ্চের অনুভূতির মধ্যে আমি নির্ঘুম রাত্রি কাটাতে লাগলাম। আমার ঈর্ষাকাতরা বড় বহিনেরা ঘুমনো তো দূরের কথা, চোখের পাতা দুটো পর্যন্ত এক করল না।

আমরা গর্ভীর নিদ্রায় অচ্ছন্ন হয়ে পড়লে আমার বড় বহিনরা আমাদের চাঙ্গ দোলা করে সাগরের পানিতে ফেলে দিল। বরাত ভাল যে, আমি সাঁতার জানি! উত্থাল-উদ্দাম সাগরের সঙ্গে
লড়াই করে করে আমি কোনরকমে ডাঙায় উঠলাম।

সকাল হলে বুঝলাম, এলোমেলো ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে জাহাজ থেকে আমি অনেক দূরে চলে দিয়েছি।

সমুদ্র সৈকত থেকে তীরের দিকে উঠতে গিয়ে সরু একটি পথের হদিস পেলাম। কিছুটা পথ যেতে না যেতেই চোখে পড়ল অতিকায় একটি সাপ, ছোট্ট আরেকটি সাপকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে!
ছোট সাপটার জন্য মায়া হ’ল। হাত বাড়িয়ে একটি পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে বড় সাপটিকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিলাম! ব্যস, মুহূর্তে তার মাথাটা থেৎলে গেল। মরে গেল হিংসুক সাপটা।

চোখের পলকে এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটে গেল। ছোট সাপটা আমারই চোখের সামনে ডানা মেলে শূন্যে উড়ে যেতে লাগল।

আমার দেহ-মন উভয়ই, ক্লান্ত। সাগরের সঙ্গে লড়াইয়ের জের তখনও আমার দেহের মধ্যে অবস্থান করছে। ক্লান্ত দেহে পথের ধারের একটি গাছের তলায় বসে পড়লাম। কখন যে দু'চোখ বন্ধ
হয়ে গিয়েছিল, আমি বুঝতেই পারিনি।

ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে তাকাতেই আমার পায়ের কাছে এক হাবসী যুবতীকে বসে থাকতে দেখলাম। অবলুশ কালো। কিন্তু চোখ-মুখ ভারী সুন্দর! বুঝলাম আমার পা টিপে দিচ্ছিল এতক্ষণ!
আমি সবিস্ময়ে বল্লাম—'তুমি কে গা? আমার কাছে এমন কি প্রত্যাশা করছ যে আমার পদসেবা করতে লেগে গেলে?

--তুমি তখন আমায় জান বাঁচিয়েছিলে। আমি আসলে একটি জিনিয়াই। সাপের রূপ ধরে তখন পালাতে চেষ্টা করছিলাম। একটি জিনি আমার চরমতম শত্রু, বড় সাপের রূপ ধরে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। তাঁর বাসনা ছিল আমার উপর বলৎকার করে।
তুমি আমার ইজ্জত আর জান দু’ই বাঁচিয়েছ। সে কৃতজ্ঞতাতেই তোমার পদসেবা করছিলাম। আর একই কারণে জাহাজ থেকে তোমার বড় বহিনদের তুলে নিয়ে এসেছি। ওই দেখ, যাদুবিদ্যা প্রয়োগ করে তাদের কালো কুক্তি করে রেখেছি। অবশ্য তোমার মন চাইলে তাদের পূর্বেকার সে-রূপও আমি ফিরিয়ে দিতে পারি।

আমি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম--
দরকার নেই। তারা কালো কুত্তি হয়েই থাক। কিন্তু আমার মেহবুব, সে-বাদশাহের লেড়কার কোন হদিস দিতে পার?

হাবসী মেয়েটির মুখে বিষাদের ছায়া নেমে এল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল—
আমি দুঃখিত। আমি পৌঁছবার আগেই সে ইহলোক ত্যাগ করে অল্লাহতায়ালার সঙ্গে মিলিত হতে চলে গেছে। তার সাঁতার জানা না থাকায় পানিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে গিয়েছিল।

বড় বহিনদের ওপর রাগে আমার সর্বাঙ্গ কাপতে লাগল। মন চাইছিল গলা টিপে তাদের একেবারে নিকেষ করে দেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর পারলাম না। একই গর্ভে জন্ম কিনা। মায়া হ'ল।
হাবসী মেয়েটি তখন এক হাতে কুত্তী দুটোকে আর অন্য হাতে আমাকে আলতো করে ধরে শূন্যে উড়ল। নামল এসে আমার স্বদেশ বাগদাদে। আমার বাড়ির দরজায় নিয়ে সে আমাকে নামাল।

আমি যেসব ধন দৌলত জাহাজে তুলেছিলাম সবই দেখলাম আসার আগেই বাড়ি পৌঁছে গেছে। আমি যখন গাছতলায় গম্ভীর নিদ্রাই আচ্ছন্ন ছিলাম তখনই নাকি জিনিয়াই এগুলো এখানে রেখে
গেছে।

জিনিয়াই বিদায় নিতে চাইল। যাবার আগে বলল— সুলেমান এর নির্দেশ অনুযায়ী কুত্তি দুটোকে রোজ তিন শ' ঘা বেত্রাঘাত করবে। যদি কোনদিন বেত্রাঘাত করতে ভুলে যাও তবে আমি অকস্মাৎ হাজির হব। আর এদের আগের রূপ ফিরিয়ে দেব।

তারপর থেকে আমি প্রতিরাতেই ওদের নির্দিষ্ট সংখ্যক বেত্রাঘাত করে আসছি।

বড়বোন জুবেদা তাঁর জীবনকথা শেষ করে বললো জাহাপনা, আমার কথা তো আপনার কাছে ব্যক্ত করলাম। এবার আমার বহিনা আমিনা তার জীবনের অত্যাশ্চর্য কাহিনী শুনিয়ে আনন্দ দান করতে প্রয়াসী হবে।