খলিফা হারুণ-অল-রসিদ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে মেজো বোন আমিনা তার জীবনকথা শুরু করল—জাঁহাপনা, অমার বড় বহিন, তার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, আব্বাজী গোরে যাওয়ার পর আমরা কে কোথায় গেলাম। তার কথায় ছিল, আমি আম্মার কাছে গিয়ে বড় হতে লাগলাম। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমার আম্মা এমন এক বুড়ো বণিকের সঙ্গে আমার শাদী দিয়ে ছিলেন। যার গোরে
যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। ধন দৌলতের কুমীর কিন্তু সামর্থ্য কিছুই তার ছিল না। এক বছর পেরোবার আগেই আমার বুড়ো স্বামী বেহেস্তে চলে গেলেন। আমি আশি হাজার সোনার মোহরের মালিক হলাম। আমির বাদশাহের কাছাকাছি তখন আমার ধন সম্পদ। গহনা আর দামি পোশাকে আমার ঘর ভরে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই মুড়ি-মুড়কির মত মোহর উড়িয়ে আমি
হয়ে গেলাম।

এক সকালে এক থুড়থুড়ে বুড়ি আমার কাছে হাজির হল। একেবারেই কদাকার তার চেহরা। এর আগে অবশ্যই তাকে কোথাও দেখিনি।
আমার সামনে এসে কুর্নিশ করল। ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল—
একটা অনাথ লেড়কিকে আমি লালন পালন করে আজ ইয়া ডাগরটি করে তুলেছি। আজ রাত্রে তার শাদী, কিন্তু আমার হাত একেবারে শূন্য তোমার দয়া দাক্ষিণের কথা অনেক শুনেছি।
তোমার মনে যা চায় আমার হাতে দিয়ে একটি অনাথ মেয়ের গতি করতে সাহায্য কর। আর একটি অনুরোধ, মেহেরবানি করে তোমাকে একবারটি আমার কুড়ে ঘরে পায়ের ধূলো দিতেই হবে।

সন্ধ্যার আগে আমি নিজে তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব, আবার পৌঁছেও দিয়ে যাব।
আমি এক কথাতেই রাজি হয়ে গেলাম।
আমি বিকেল পড়তেই আমার জড়োয়ার গহনাপত্র ও সোনার জরি দেওয়া পোশাক পরিচ্ছদ গয়ে চাপিয়ে তৈরি হয়ে বুড়ির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতেই বুড়িটি আমার বাড়ির দরজায় দেখা দিল।

আমার এক গাট্টাগোট্টা নোকরকে সঙ্গে নিয়ে আমি বুড়ির সঙ্গে যাত্রা করলাম। বিশালায়তন এক বাড়িতে সে আমাদের নিয়ে গেল। বাদশাহের প্রাসাদের ঢঙে বড়িটি তৈরি! শাদীর উপযুক্ত করে ফুল-মালা আর রঙ বে-রঙের ঝাড়বাতি প্রভৃত্তি দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে সেটিকে।

বুড়িটি আমাকে নিয়ে বড়সড় একটি ঘরে ঢুকল। তারবআসবাবপত্র এবং অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে ঘরটি এমন নিপুণভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে যার বর্ণনা দিতে গেলে রাত্রি কাবার হয়ে যাবে, জাঁহাপনা।

সুনিপুণ হাতে তৈরি কারুকার্য শোভিত একটি পালঙ্কের ওপর আধা শেওয়া অবস্থায় এক রূপসী যুবতীকে দেখতে পেলাম। যাকে বলে একেবারে অপরূপা।

আমাকে দেখেই মেয়েটি হাসির প্রলেপ মুখে এঁকে ব’লে উঠল— আমাদের নসীবের কী জোর যে, তোমার পায়ের ধুলো আমাদের জীর্ণ কুটীরে পড়ল। কথাটি বলতে বলতে সে পালঙ্ক থেকে
নেমে এসে আমার হাত দুটো ধরে নিয়ে গিয়ে বসাল।

মেয়েটি এবার বল— তোমাকে একটি কথা বলার জন্য বড়ই মানসিক চাঞ্চল, বোধ করছি। শোন, আমার একটি ভাই আছে। সুঠাম দেহী। যথার্থই সুপুরুষ। অগাধ ধন-দৌলতের অধিকারী।
তোমার রূপ দেখে সে পাগল। তোমাকে শাদী করে জীবনসঙ্গিনী করার জন্য খুবই ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। বুড়িকে তোমার কাছে পাঠিয়েছিলাম কৌশলে তোমাকে এখানে নিয়ে আসার জন্য। আমি বলব, আমার ভাই তোমার পাশে দাঁড়াবার অনুপযুক্ত অবশ্যই নয়। তুমি বরং এক কাক্ত কর। তাকে নিজের চোখে দেখে তবেই তোমার
মতামত ব্যক্ত কর।

আমি তার কথায় সম্মতি জানালাম।

আমার সম্মতি পেয়ে মেয়েটি দু'বার করতালি দিল। ব্যস, একটি দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল। এক সুপুরুষ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল।

চোখের তারায় বিস্ময়ের ছাপ এঁকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে যুবকটির রূপ-সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। সত্যই রূপবান যুবকই বটে। কোন পুরুষের দেহে এখন রূপের জৌলুষ থাকতে পারে
আমি ভুলেও কেনদিন ভাবিনি।

আমি যখন মুগ্ধ নয়নে যুবকটির রূপ-সৌন্দর্য পান করে চলেছি। তখনই এক বৃদ্ধ মৌলভী আর চারজন সাক্ষী ঘরে ঢুকলেন।

আমার সম্মতি পাওয়ার পর মৌলভী শাদীর কবুলনামা তৈরি করলেন। সাক্ষীরা তাতে স্বাক্ষরদান করল।

কাজ সেরে মৌলভী ও সাক্ষীরা বিদায় নিলেন।

আমার সদ্য শাদী করা স্বামী একটি কোরাণ শরীফ তুলে নিয়ে বললো—
মেহবুবা, পবিত্র প্রশ্নটি স্পর্শ করে তুমি একটিবার বল, তুমি আমার, শুধুই আমার। আমাকে ছেড়ে ভুলেও কোথাও যাবে না। আর অন্য কোন পুরুষের প্রতি আসক্তি জন্মাতে মনকে কোনদিনইবপ্রশ্রয় দেবে না।

আমি কোরণ শরিফ হাতে নিয়ে উচ্চারণ করলাম, তুমি আমারবস্বামী, তুমি ছাড়া আর কোন পুরুষের প্রতি ঝুঁকব না।

আমার স্বামী আমাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনে চুম্বনে মুহূর্তে আমার মধ্যে উন্মাদনা জাগিয়ে তুলল। পুরুষের দেহের সস্পর্শসুখ যে কী মধুর আমি সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করলাম। মুহূর্তে আমার সর্বাঙ্গে বিদ্যুতের শিহরণ খেলে গেল। মাদকতা জগল আমার দেহ-মনে। হৃদপিণ্ডের স্পন্দন ক্রমেই দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগল। এক অনাস্বাদিত পুলকানদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলাম আমি।

আমার স্বামীর বোন অনেক আগেই আমাদের কঙ্ক ছেড়ে চলে গেছে। ঘরে তখন আমি আর আমার ভাল মানুষ স্বামীটি ছড়া আর কেউ-ই নেই। আমার পরমতম প্রাপ্তির প্রথম রাত্রি।

ইতিপূর্বেও আমার একবার শদী হয়েছিল। এক হাড় গিলগিলে বুড়োর সঙ্গে। কিন্তু সে আমার দেহ স্পর্শও করতে পারে নি। আমাকে স্পর্শ করার মত সামর্থ্য বা মানসিকতা কোনটিই তার ছিল
না। কিন্তু সে রাত্রে? আমার স্বামী এক মধুরতম শুভ লগ্নে আমার কুমারীত্বকে ছিনিয়ে নিল। না, ছিনিয়ে নেয় নি। আমি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তার হাতে নারীর অমূল্য সম্পদ কুমারীত্বকে তুলে দিলাম। আর সেই সঙ্গে তার পেশীবহুল হাতও সুপ্রশস্ত বুকের দলন, পেষণ, মর্দনের মাধ্যমে মনুষ্য জীবনের পরম প্রাপ্তি সম্বোগ-সুখ পুরোপুরি উপভোগ করলাম। আমার স্বামী কখনও ওষ্ঠে ওষ্ঠ রেখে, বুকে বুক রেখে আমাকে অমৃত পান করাতে লাগল। আবার কখনও বা তার বলিষ্ঠ জানুদ্বয়ের পেষণে আমার জানুদ্বয়কে পিষ্ঠ করে অবর্ণনীয়
পুলকানন্দ দান করতে লাগল। সম্ভোগে নাকি পিষ্ট হয়ে–কিসে যে বেশী সুখ তা বোঝার মত ক্ষমতা তখন আমার অন্তর থেকে অন্তর্হিত হয়ে গেছে। আমার আঠার বছরের যৌবনভরা দেহপল্লবটিকে তার হাতে সঁপে দিয়ে আমি স্থবিরের মত পালঙ্কের ওপর এলিয়ে পড়ে রইলাম। ও যেমনভাবে খুশি ছিঁড়ে কুঁড়ে উপভোগ করুক আঠার বছর ধরে সযত্নে রক্ষিত আমার দেহটিকে। উদ্দাম আনন্দানুভূতি আর চাওয়া পাওয়ার মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘ রাত্রিটি যেন মুহূর্তে কেটে গেল।

এক-দুই-তিন করে ত্রিশটি রাত্রি যে কি করে ফুরিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না।

এক সকালে কিছু কেনাকাটা করার জন্য স্বামীর অনুমতি নিয়ে বুড়িটিকে সঙ্গে করে বাজাবে গেলাম। কয়েকটি পছন্দমত দামী শাড়ি কিনলাম। দাম দিতে গিয়ে পড়লাম ফ্যাসাদে। দোকানি দাম
চাইল না। বললো— আপনি এই প্রথম আমার দোকানে এলেন। আজকের কাপড় ক'টি আপনাকে উপহারস্বরাপ দিলাম। আমি ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলাম না। রেগে গিয়ে
বললাম– দাম না নিলে আপনার শাড়ি রেখে দিন। বিনা মূল্যে আমি—

বুড়ি আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো— কেন মিছে পীড়াপীড়ি করছ? ভালবেসে যদি উনি শাড়ি ক’টি দিয়েই থাকেন
নিতে আপত্তি কিসের বুঝছি না তো!

আমি কিছু বলার আগেই দোকানি এবার বললো—আপনি মিছেই রাগের অপব্যবহার করছেন। আমি না হয় উপহারই দিলাম! কি-ই বা দাম যে, এর জন্য আপনার প্রবল আপত্তি থাকতে পারে।
বিনিময়ে কেবলমাত্র আপনার মধুমাখা ঠোঁট দুটো চুম্বন আশা করছি। মেহেরবানি করে—

আমি বুঝলুম নচ্চার বুড়িটি কুমতলবের শিকার হয়ে আমাকে এ-দোকানে ঢুকিয়েছে।

আমি সবে অধিকতর ক্ষোভ প্রকাশ করতে যাব অমনি বুড়িটি বললো— তুমিও পার বাপু। এতগুলো টাকার শাড়ির বিনিময়ে একটি বা দু'টি চুম্বন দিলে কি তোমার ঠোট দুটো ক্ষয় হয়ে যাবে? তুমি ভাবতে পারছ না, তার বাসনা পূর্ণ করলে সোনা-রূপা আর মণি মাণিক্য তোমার গা-ঢেকে দেবে।

----'অসম্ভব। আল্লাহর নামে আমি স্বামীর কাছে কবুল করেছি কোন পুরুষের প্রতিই আমি অকৃষ্ট হ’ব না। আমার স্বামী জানতে পারলে পরিণাম কি হবে, বুঝতে পারছ?”

—'আরে ধ্যুৎ! তুমি যে এমন হদ্দ বোকা তা তো জানতাম না। কি করে জানাবে? আমরা তিনজন ছাড়া একটি কাক পক্ষীও জানতে পারবে না। যাও এগিয়ে যাও। হাতে পাওয়া জিনিস পায়ে ঠেলতে
নেই।

বুড়ির পীড়াপীড়িতে রাজি হতে বাধ্য হলাম। লোকটি আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরে একটি চুম্বন করল। কথা ছিল একটি মাত্র চুম্বনই সে করবে। কিন্তু পরমুহূর্তে সে আমাকে হিংস্র জানোয়ারের মত চেপে ধরল। আচমকা একটি ধাক্কা দিয়ে কোনরকমে নিজেকে মুক্ত করে নিলাম। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম। সংজ্ঞা
লোপ পেল আমার। কতক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরল বলতে পারব না। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি বুড়ি আমার মাথাটি কোলে নিয়ে বসে।
গালের ক্ষতস্থানটি দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। দোকানি আতঙ্কে দোকান ছেড়ে পালিয়েছে।

বুড়ি আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিল- বাছা, যা হবার তা-তো হয়েই গেছে। বাড়ি গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বে। ভাব দেখাবে যেন বুখার হয়েছে। বাঁ-দিকের গালটি চাপা দিয়ে রাখবে। কারো নজরে যেন না পড়ে। ও মাত্র দু’দিনের ব্যাপার। ব্যস দাগটাগ কোথায় উধাও হয়ে যাবে।

বুড়ির পরামর্শে বাড়ি ফিরে বাঁ-দিকে কাৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। তার ওপর একটি চাদর চাপিয়ে দিলাম। বুখার।

আমার স্বামী এসে সবিস্ময়ে বললো–
তোমার তবিয়ত তো আচ্ছাই ছিল। এরই মধ্যে এমন কি বুখার হ’ল যে একেবারে বিছানা
আশ্রয় করতে হ’ল?'

আমার মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে সে সচকিত হয়ে বলে উঠল— 'আরে ব্বাস! তোমার গালটি এমন করে কেটে গেছে! কি করে এমন সর্বনাশ হল?'

—আর বোলো না, নসীবের ফের। বাজারে যাওয়ার পথে এক বুড়ো লকড়ি বেচতে যাচ্ছিল। অন্যমনস্কতার জন্য আচমকা ধাক্কা লেগে একটু ঘায়েল হয়। দু'দিনেই শুকিয়ে মিলিয়ে যাবে।

আমার স্বামী রেগেমেগে একেবারে কাঁই হয়ে গেল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল -- 'হারামি, কাঠুরেদের ধরে এনে আমি জবাই করে ছাড়ব!'

আমি কাতর মিনতি করতে লাগলাম— 'ছিঃ মাথা গরম কোরো না।আমারও তো দেখে পথ চলাটা উচিত ছিল। তার ওপর কয়েকটি ছেলে আবার রাস্তায় গুলি-ডান্ড খেলছিল। আমার বরাত মন্দ।
অন্যকে দোষ দিয়ে কি করবে?"

—‘‘হতচ্ছাড়ি চুপ করে থাক। তুই ডাইনি! বিশ্বাসঘাতিনী! একটি মিথে ঢাকতে হাজারটা মিথ্যে কথা টেনে আনছিস। কোরান শরিফ স্পর্শ করে হলফ করার পরিণতি কি এ-ই ?”

— 'হারামজাদি। এবার মজাটা টের পাবি।' কথা বলতে বলতে সে বার তিনেক মেঝের ওপর পা ঠুকে আওয়াজ করতেই চোখের পলকে সাত সাতটি হাবসি ক্রীতদাস এসে কুর্নিশ করে আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়াল। স্বামীর নির্দেশে তারা আমাকে আছাড় মেরে মেঝেতে ফেলে দিল।সুতীক্ষ্ণ তরবারি উচিয়ে ধরল একজন। সবার
চোখ জবা ফুলের মত লাল যেন আমাকে টুকরো টুকরো করে চিবিয়ে খেয়ে নেবে।

আমার স্বামী কর্কশ গলায় গর্জে উঠলেন—'হারামজাদিকে কোতল কর। কেটে টুকরো টুকরো করে নেকড়ে দিয়ে খাওয়াবি।
একমাত্র এতেই তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া হবে।'

আমি কাতর মিনতি জানালাম আমাকে যখন তুমি কোতলই করবে তখন একটু বিলম্ব করলে এমন আর কি ক্ষতি হবে। গোরে যাবার আগে তোমাকে একটি কথা বলে যাচ্ছি— 'যদি মহব্বতের বাতি নিজ হাতে জ্বালিয়েই ছিলে, তখন তাকে আবার নেভাতে এত উৎসাহী হয়ে পড়েছ কেন? আর ফুলকে যদি এমন করে অনাদরে ঝরিয়েই দেবে তবে আর কেন মিছে সোহাগ করে তাকে ফুটাতে
গেলে?"

–চুপ কর শয়তানি ডাইনি কোথাকার। তোর মুখে মহব্বতের বুলি শোভা পায় না। তোর পিরিতের মরদগুলোকে ছেড়ে কেন আমার দিলটায় এমন করে দাগা দিতে এলি? তোর রূপ যৌবন আমাকে পাগল করেছিল। মহব্বত করতে শখ হয়েছিল। মোহান্ধ হয়ে পড়েছিলাম। আজ মোহ টুটে গেছে আমার।

আমার চোখের কোল বেয়ে পানি ঝরতে লাগল। ভাবলাম, তার অবিশ্বাস তো অমূলক নয়। কিন্তু এর জন্য আমি কতটুকু দায়ী? কতটুকু গুণাহ আমার হয়েছে?

আমার স্বামীর আচরণে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। আমার গুণাহের কথা তো তার অজ্ঞাত। কেবল অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই তার মেহবুবার জান নিচ্ছে। একেবারে কোতল। আবার এ-ও ভাবলাম-- আসলে পুরুষের কাছে পেয়ার মহব্বত ছেলের হাতের মোরার মত। মেহবুবা বলে মনের মানুষটিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। ভোগ করে করে বেস্বাদ হয়ে গেলে ছলে-বলে-কৌশলে
দূরে ছুঁড়ে দিল। একটি নারী, একটি যৌবন আর একই মাংসপিণ্ড কতদিন অ'র স্বাদ লাগতে পারে।

আঁখির পানি মুছতে মুছতে ডুকরে কেঁদে বললাম- কোতল তো আমাকে তুমি করবেই। নসীবের ফেরে জান আমাকে দিতেই হবে। আমার মত বোকা মেয়ের নসীবে এর চেয়ে বেশী আর কিই বা জুটতে পারে।

যথামার্কা হাবসী যুবকটি আবার আমাকে লক্ষ্য করে হাতের তরবারিটি উড়িয়ে ধরল। এমন সময় সে-বুড়িটি থপ্ থপ্ করে ঘরের দরজার সামনে এসেই সচকিত হয়ে বলে উঠল—
একে মেরো না বাছা! জান নেয়ার মত গুস্তাকী কিছু করেনি। আমি তোমাকে পেটে না ধরলেও মায়ের মত করে মানুষ করেছি। বুকের স্তন দিয়ে তোমার জান টিকিয়ে রেখেছিলাম একদিন। যদি লঘু পাপে এমন গুরুদণ্ড দাও, তবে আল্লাতাল্লা তোমাকে কিছুতেই মাফ করবেন না।

বুড়ির কথা আমার স্বামী ফেলতে পারল না। আমার গুস্তাকী মাফ করল কিনা জানি না। তবে সে এবারের মত আমার জান নিল না। আবার তেমনি গর্জন করে উঠল– ঠিক আছে, জান নেব না। কিন্তু এমন এক ক্ষতচিহ্ন এর দেহে এঁকে দেব যে, যা আমৃত্যু তাকে একথা স্মরণ করিয়ে দেবে।

আমার স্বামী তখন হাবসী নোকরদের বিদায় দিল। বুড়িকে বাইরে যেতে বলল। তারপর বলপূর্বক আমার অঙ্গের যাবতীয় আচ্ছাদন খুলে একেবারে উলঙ্গ করে দিন। একটি চাবুক নিয়ে ক্রোধোন্মত্ত সিংহের মত আমাকে একের পর এক আঘাত হানতে লাগল। কতক্ষণ যে আমার ওপর দৈহিক নির্যাতন করেছিল, বলতে পারব না। কারণ কয়েক ঘায়ের বেশী চাবুকের খা আমি সহ্য করতে পারিনি। সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। সংজ্ঞা ফিরে পেলে দেখি, আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অসংখ্য ক্ষত৷ চুঁইয়ে চুঁইয়ে
খুন ঝরছে।

বুড়ি কোত্থেকে যেন ভাল দাওয়াই এনে দিল। নিজে হাতে ক্ষতস্থানগুলিতে প্রলেপ দিয়ে দিতে লাগল। ক্ষত শুকোতে দেরী হ'ল না।
কাল রাত্রে এ ক্ষত চিহ্নগুলোই আপনারা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন।

মাস চারেক পর আমি ঘর থেকে বেরোতে পারলাম। দরজার বাইরে আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ধ্বংস স্তূপ। কে বা কার যেন চরম আক্রোশে বাড়িটিকে বিরাট একটি ধ্বংস স্তূপে পরিণত করে দিয়েছে। অন্য সব বাড়ি অক্ষতই রয়ে গেছে। আমার স্বামীর দেখা পেলাম না। কেউ তার কোন হদিসও দিতে পারল না। বুক ভরা দুঃখ-যন্ত্রণা নিয়ে ফিরে এলাম আমার ছোট বহিন কহিমা-র আশ্ররে। আমার দু' বহিন জুবেদা ও কাহিমা। আমার নসীবের বিড়ম্বনার কথা গুলো শুনে ব্যথিত- মর্মাহত হলো। আমাকে নানা ভাবে প্রবোধ দিল তারা। মানুষ তো
কেবল একতচেটিয়া সুখের প্রত্যাশাই করে। কিন্তু খোদাতাল্লার মর্জি যে তা নয়। দুঃখের পরিমাপই তিনি বেশী দেন। ফলে মানুষ সুখের প্রকৃত স্বাদ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।

আমরা তিন বহিন এবার থেকে এক সঙ্গে বাস করতে লাগলাম। সাদী-নিকার ধারকাছ দিয়েও গেলাম না। আমরাই দোকানপাট সারি, খানা পাকাই, ভাগজোক করে আহার করি। আমাদের দু'বহিনের বড় জুবেদার মর্জি মাফিকই আমাদের সংসার চলতে লাগল ।

বেশ কয়েক বছর দিব্যি কাটিয়ে দিলাম। কোন পুরুষের সাহচর্য ছাড়াই। তারপর কুলি-যুবকটিকে পেলাম আমাদের কাছে। হাসি-মষ্করা আর দৈহিক সুখ ভোগের মধ্য দিয়ে পরমানন্দে আমাদের যে-দিন কেটেছিল। আমাদের অনুরোধে সে রাত্রেও আমাদের কাছে রয়ে গিয়েছিল। তারপর এল বাঁ-চোখ কানা, দাড়ি-গোঁফ কামনো কালান্দার ফকির। তারপর যা কিছু ঘটেছে, সবই তো আপনারা অবগত আছেন।

মেজো বোন আমিনা-র জীবন কথা খালিফা হারুণ-অল্-রসিদকে মুগ্ধ করলো।

ভোরের পূর্বাভাষ পেয়ে বেগম শাহরাজাদ তাঁর কিস্সা বন্ধ করলেন।