অষ্টাদশ রঞ্জনী

বাদশাহ শাবিয়ার মধ্যরাত্রের কিছু আগে বেগম শাহরাজাদ-এর মহলে উপস্থিত হলেন।

কোনরকম ভূমিকার অবতারণা না করেই বেগম শহরাজাদ তাঁর কিস্সা শুরু করতে গিয়ে বললেন – 'জাঁহাপনা, খলিফা হারুন-অল-রসিদ- এর ফরমাস অনুযায়ী জুবেদার ছোট বহিন কহিমা
সে-কালো কুত্তী দুটোকে এবং বাঁ চোখ কানা কালান্দার ফকির তিনজনকে তাঁর সামনে উপস্থিত করল।

লিপিকাররা খলিফার সামনে দুটো পাণ্ডুলিপি পেশ করল। তিনি বড় বহিন জুবেদা এবং মেঝো বহিন আমিনার জীবন কথা দিখে রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ দুটো তারই পান্ডুলিপি।

খলিফা এবার জুবেদাকে কাছে ডাকলেন। সে এলে তিনি নির্দেশ করলেন, যে জিনিয়া’হ তার বড় দুই বহিনকে মানুষ থেকে কুত্তীতে পরিণত করেছিল তাদের ঠিকানা তাকে নেওয়ার জন্য।

জুবেদা বললো 'জাঁহাপনা, এবারই তো আমকে বিপদে ফেললেন। তাদের পাত্তা তো আমার জানা নেই।'

– তবে তাকে পাওয়ার উপায় কি?'

--জাঁহাপনা, তাকে কাছে পাওয়ার জন্য আমাদের যখনই দরকার পড়ে তখনই, একটি বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করি। ব্যস, সে আমাদের সামনে হাজির হয়।

—ভাল কথা, কি সে পদ্ধতি জানতে পারি কি?

বড় বহিন জুবেদা এবার নিজের মাথা থেকে দু'গাছি চুল ছিড়ল। সে- দুটো খলিফার হাতে দিয়ে বললো- 'জাঁহাপন', এ দু'টে'কে আগুনে পুড়িয়ে দিন। পুড়ে একেবারে নিঃশেষ হওয়া মাত্র জিনিয়াহ
আমাসের সামনে হাজির হয়ে যাবে।'

খলিফা চুল দু’গাছি এক কর্মচারীর হাতে দিলেন। বললেন, "আগুন জ্বেলে এদের পুড়িয়ে দাও।'

খলিফার নির্দেশ পালিত হ'ল। চুল দু'গাছি পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া মাত্র সমগ্র প্লাসদটি প্রবল ভূমিকম্পের মত দুলতে লাগল।
কয়েক মুহূর্ত ধরে প্রাসাদটি দুলে আবার স্বাভাবিক হ'ল। ব্যস, এবার দরজার কাছে দর্শন দিল এক কুদর্শনা হাবশী যুবতী।

জুবেদা হাবশী যুবতীকে হাতের ইশারা করে কাছে ডাকল। সে এগিয়ে এলে জুবেদা বলল– 'জাঁহাপনা, এ-ই সেই 'জিনিয়াহ, এর কথাই আপনাকে বলেছিলাম।'

জিনিয়াহ এবার খলিফার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। যথোচিত কায়দার কুর্নিশ করল।

খলিফা বললেন— 'তোমার কথা আমি জানতে চাই। তুমি নিজ মুখে বল, কিভাবে তাদের সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছিল?

— 'জাহাপনা, এক সময় এ-যুবতীর অনুগ্রহে আমার প্রাণ বেঁচেছিল। আমি তারই প্রতিদান স্বরূপ এর কিছু উপকার করতে প্রয়াসী হয়েছিলাম। এর জন্য কিছু করতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য জ্ঞান করছি।"

জাহাপনা, এই যে কৃত্তী দুটোকে দেখতে পাচ্ছেন এরা উভয়েই এ-যুবতীর বড় বহিল। বড়ই বিশ্বাসঘাতিনী। সুযোগ বুঝে এরা তার প্রাণনাশের চেষ্টা করতেও কসুর করে নি। তাদের মনোভাবের কথা আমি নিজ ক্ষমতাবলে জানতে পারি। তখনই আমি এর বিহিত করে ফেলি। তাদের কৃত্তীতে পরিণত করে দিই।'

খলিফা হারুণ অল-রসিদ মুহূর্তের জন্য কুত্তী দুটোর দিকে তাকালেন। জিনিয়াই বলল – 'জাহাপনা, অবশ্য আপনি যদি এদের অতি সহানুভূতিশীল হন তবে আমি আবার যাদুবলে এদের পূর্বশ্রী ফিরিয়ে আনতে পানি। অর্থাৎ মন্ত্রবলে আবার এদের মনুষ্যদেহ দান করতে আমি সক্ষম।'


চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেঁপে খলিফা বললেন জিনিয়াহ, আমার বিশ্বাস এদের কৃতকর্মের উপযুক্ত ফলা এরা ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে। অতএব এদের আর কষ্ট দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি তো বলেছই, তোমার যাদুবিদ্যার বলে এদের পূর্বশ্রী মনুষ্যে আবার ফিরিয়ে দিতে পার। তবে তা-ই কর, এদের আবার মানুষ করে দাও।

--তাঁহাপনার আদেশ শিরোধার্য।

-হ্যাঁ, তুমি শিগ্রই এদের মনুষ্যদেহ দান কর তারপর আমি আমিনা-র ব্যাপারটি ভেবে দেখছি কি করা যায়! হাঁ, সে যা কিছু বলল সবই যদি সত্য হয় তবে যেভাবেই হোক, তার স্বামীর সন্ধান আমাদের পেতেই হবে। তাঁর জন্য যদি আমাকে আমার তামাম রাজ্য জুড়ে খোঁজ-খবর করতে হয় তবু আমি দ্বিধা করব না। আমার দেশে এমন অন্যায়-অবিচার আমি কিছুতেই বরদাস্ত করব না।
এর হিল্লে আমি করবোই।

এবার জিনিয়াই খলিফাকে কুর্ণিশ করে বললো+ জাহাপনা, আপনার আদেশ শিরোধার্য। আপনার বাঞ্ছা পূরণ করতে গিয়ে আমি এখনই এদের মনুষ্য দেহ ফিরিয়ে দিচ্ছি। এবার সে হাত কচলে বিনম্ন বিনয়ের সঙ্গে বললো– 'জাহাপনা, এর আগে একটি কথা আপনার কাছে নিবেদন করতে চাই।'

--কথা? কি সে কথা?

—'আমিনার স্বামীর খোঁজে আপনাকে তামাম রাজ্য ঢুঁড়ে বেড়াতে হবে না। সে আপনার কাছাকাছিই অবস্থান করছে। আপনি হাত বাড়ালেই হাতের মুঠোর মধ্যে তাকে পেয়ে যেতে পারেন।

-- সে কী কথা! আমার কাছেই রয়েছে, অথচ আমি তাকে জানি না! কে? কে সে, বল তো?

--আপনার লেড়কা। আপনার লেডকা অল-আমিন।

জিনিয়াহ-র মুখ থেকে কথাটি বেরোতে না পেরোতেই দরবার কক্ষে নেমে এল অখন্ড নীরবতা। সবাই নির্বাক -নিস্তব্ধ।

খলিফা হারুণ-অল-রসিদ-এর মুখে নেমে এল লজ্জা, অপমান, আর ঘৃণার চাপ। বিষাদের কালোছায়া। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি
হতাশার দৃষ্টিতে জিনিয়াহ-র দিকে তাকালেন।

জিনিয়াই এবার খলিফার আদেশ কার্যকরী করার জন্য তৎপর হ'ল। একটি পাথরের বাটিতে সামান্য পানি আনলো। পানির পাত্রটি হতে নিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে কি সব মন্ত্র আওড়াল। মন্ত্র পড়া শেষ হলে
পানিটুকু গন্ডুষ ভরে হাতে নিল। আবার একই রকমভাবে বিড়বিড় করতে করতে হাতের পানিঠুকু কুত্তী দুটোর গায়ে ছিটিয়ে দিল। তার যাদুবিদ্যা কার্যকরী হতে শুরু করল। ধীরে ধীরে কুত্তীর দেহ
পরমা সুন্দরী দুটো মেয়ের দেহে পরিণত হতে শুরু করলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দুই যুবতী নিজ দেহ ফিরে পেয়ে খলিফাকে নতজানু হয়ে কুনিশ করল। রূপসী দুই যুবতী। জুবেদা ও তার অন্য
তুই বহিনের চেয়ে এদের রূপের আভা কোন অংশে কম নয়।

দরবার কক্ষের সবাই বিস্ময়ভরা চোখে ব্যাপারটি প্রত্যক্ষ করতে লাগলো।

দরবার কাছে এতোক্ষণ অখন্ড নীরবতা বিরাজ করছিল। কারো মুখে টু-শব্দটিও ছিল না। তখন কি খলিফাও নীরবতার মধ্য দিয়ে জিনিয়া'হর কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করছিলেন? না। জিনিয়ার একটু আগে তাঁর লেড়মা অল-আমিন সম্বন্ধে যে উক্তি করেছে তা নিয়েই তিনি আকাশ পাতাল ভেবে চলেছেন। তিনি আপন মনে বলে উঠলেন—
তার কথাটি কি বিশ্বাস করার মত। এ-ও কি অল-আমিন এর পক্ষে সম্ভব? সে না হয়ে অন্য কেউ হলেও না হয় ভেবে দেখা যেত। কিন্তু-- না খলিফা-হারুণ-অর-রসিদ আর ভাবতে পারছেন না।

কিন্তু জিনিয়াদের তথা অবিশ্বাস করাও তো যায় না। তারা সর্বজ্ঞ। সর্বত্র তাদের অগাধ গতি। তামাম দুনিয়ার খবর ভাগের হাতের মুঠোর মধ্যে। এতএব তার কথটিকে পাগলের প্রলাপ ব'লে উড়িয়ে দিতে পারলেন না। তিনি অনন্যোপায় হয়ে উজির
জাফরকে বললেন – ' আমার লেড়কা অল-আমিনকে দরবারে হাজির করার ব্যবস্থা কর।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অল-আমিন দরবারে উপস্থিত হয়ে আব্বাজীকে কুর্নিশ করে এক পাশে দাঁড়াল।

খলিফা লেড়কাকে জিনিয়াহ্-র কথা বললেন। কথাটি শুনে সে যেন একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। কপালের চামড়ায় ভাঁজ এঁকে আব্বাজীর মুখের দিকে পরমুহূর্তেই জিনিয়াহর দিকে তাকাল। তারপর সে যে বিবৃতি দিল তা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার ব্যর্থ প্রয়াস ছাড়া কিছুই বলা যায় না। তার বক্তব্য শোনারবপর তাকে তেমন দোষী বলে মনে হল না।

খলিফা কিন্তু লেড়কার কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। সে তার বক্তব্যে আসলের চেয়ে খাদই যে বেশী সংযোজন করেছে বুঝতে পারলেন। তিনি উজিকে বলেন ‘মৌলভীকে তলব কর।
তাকে বলবে, শাদীর ব্যবস্থা করতে। আর যা কিছু লাগে সবই যেন সঙ্গে করে নিয়ে আসে।'

খলিফার তলব পেয়ে মৌলভী হস্তদস্তু হয়ে দরবারে উপস্থিত হলেন। খলিফা তাঁকে শাদীর কবুলনামা লিখতে নির্দেশ দিলেন। মৌলভী অল–আমিন- এর সঙ্গে দ্বিতীয়বার আমিনার শাদীবদিলেন।

তারপর প্রথম কালালার ফকিরের সঙ্গে শাদী দিলেন বড় বহিন জুবেদা-র।

আর অন্য দুই বহিনের শদী হ'ল দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কালান্দার ফকিরের সাতে।

খলিফা নিজে? তিনি নিজে শাদী করলেন ছোট বহিন কহিমকে।

শাদী হয়ে গেল। খানাপিনাও হ’ল খুবই। রাজ্যের প্রজারাও কম আনন্দ করলো না।

শদী হ’ল। সবাই আনন্দও করল প্রাণভরে। কিন্তু এদের সবার বসবাসের জন্য মহলও তো চাই। খলিফার নির্দেশে কারিগররা লেগে গেলো সবার জন্য পৃথক পৃথক মহল বানাতে। সুদক্ষ কারিগররা চমৎকার সব মহল বানিয়ে ফেললো অল্প সময়ের মধ্যেই।

খলিফা নিজে উপস্থিত থেকে মহলগুলো সুন্দর করে সবাসযোগ্য করে সাজিয়ে দিলেন।

সবাই নিজ নিজ মহলে সুখে ঘর সংসার করতে লাগল।