এক সন্ধ্যার কিছু আগে খলিফা হারুন-অল-রসিদ উজির জাফরকে তাঁর প্রাসাদে ডেকে পাঠালেন।

উজির ব্যস্ত হয়ে খলিফার সামনে উপস্থিত হলেন। কুর্নিশ করে বললেন– ‘জাঁহাপনার কি আদেশ ?'

—'আজ এখনই আমি নগর পরিদর্শনে বেরুবো। আমার কাছে চারদিক থেকে বহু অভিযোগ এসেছে। আমি ঘুরে ঘুরে সবকিছু নিজের চোখে দেখতে ইচ্ছুক। ওয়ালি আর নগরপালকরা নাকি
কৰ্ত্তব্যকর্মে অবহেলা করছে। যদি অভিযোগ সত্য হয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। কঠোর শাস্তিদান করতেও আমি কুণ্ঠিত হব না।'

উজির জাফর বললেন—
জাঁহাপনা, আপনার আদেশ শিরোধার্য, আজ রাত্রেই তবে বেরুনো যাক।

সন্ধ্যার কিছুপরে খলিফা, উজির জাফর এবং খলিফার নিজস্ব দেহরক্ষী প্রাসাদ ছেড়ে পথে নামলেন। পথ চলতে চলতে তারা পথের বাঁকে এক জেলের দেখা পেলেন। বুড়ো জাল মাথায় করে মাছ ধরে ফিরছে। পথ চলতে চলতে জেলেটি অদ্ভূত কণ্ঠে স্বগতোক্তি করতে লাগলো—
সবই নসীবের ফের। তার ওপর যে দুর্দিন পড়েছে উদয়াস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও রুটির জোগাড় করতে পারি না। গুড়া বাচ্চাগুলো খিদের জ্বালায় ছটফট করে। খোদা, এ কী তোমার বিচার, তোমার
মর্জি কিছুই বুঝি না।

বুড়োকে দেখে খলিফা তার কাছে গেলেন। পথ আগলে দাঁড়ালেন। বললেন-- ভাইয়া, তোমার কিসের কারবার বলবে কি?

---- জেলে আমি। নদীতে মছলি ধরি। বুড়ো হয়েছি। হাড়-মাস ঠিক কাজ করতে চায় না। দেহের কলকব্জা বেইমানি করে হরবকত। জোয়ান বয়সের মত খাটতে পরি নে।

— আজ মছলি পাওনি?

— ‘দেখছেনই তো মাথায় জাল আর হাতে খালি ঝুড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরছি। সারাটা দিন নদীর ধারে ধারে ঘুঁড়ে বেড়ালাম। শরীর কাহিল হ'ল। ঘাম ঝরল খুবই। কিন্তু একটি মছলিরও দেখা মিলল
না। আজ রোজগারপাতি কিছুই হল না। গুড়া বাচ্চাদের মুখে কি দেব, ভাবছি। তারা তো পেটে কিল মেরে আমার জন্য পথ চেয়ে বসে আছে।’ চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবার বললো—
'মালিক, খোদাতায়াল্লার কাছে আমি হরবকর আর্জি জানাই— 'খোদা, আর কেন? দুনিয়ার বহুত খেলাই তো দেখলাম। এবার দয়া করে তোমার কাছে টেনে নাও। আর পারছিনে সংসারের বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াতে।’

—'আমি একটি কথা বলছি, মর্জি হলে রাজি হতে পার।'

--- “বলুন মালিক, শুনি আপনি-
তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই খলিফা বলতে শুরু করলেন—'আমার সঙ্গে তোমাকে টাইগ্রিস নদীর ধারে যেতে হবে।

— ‘মালিক, যদি কিছু রোজগারের ধান্দা হয়, তবে আমি জাহান্নামেও যেতে রাজি আছি। টাইগ্রিস নদী তো সামান্য ব্যাপার।'

—টাইগ্রিসের পানিতে তোমার জাল ফেলবে। জালে যা ধরা পড়বে সেটি আমার হবে। আর যদি খালি জাল উঠে আসে তবু তোমাকে বিমুখ করব না। আমি তোমাকে পারিশ্রমিক বাবদ একশ দিনার দেব।'

বুড়ো জেলেটি চোখে-মুখে অবিশ্বাস ও বিস্ময়ের ছাপ এঁকে খলিফার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

খলিফা বলে বললেন-- 'হ্যা, মুখে যা বলছি, কাজেও তা-ই হবে। তোমাকে দিয়ে আজ আমি আমার বরাতের পরীক্ষা করতে চাচ্ছি । 'তুমি রাজি তো?

বুড়ো জেলেটি কোন কথা না বলে টাইগ্রিস নদীর পথে হাঁটা জুড়লো।

উল্লাসিত বুড়ো নদীর তীরে পৌছেই ঝপ্ করে পানিতে জালটি ছুঁড়ে মারল। প্রায় বৃত্তাকারে পানির ওপরে জালটি ছড়িয়ে পড়লো। কয়েক মুহূর্ত নীরবে অপেক্ষা করে জাল গুটাতে শুরু করলো। জালে এক ভারি কি যেন আটাকছে মনে হল তার। মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল। ভাবল, আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন। কোনরকমে জালটি গুটিয়ে তীরে তুলে অনতেই বুড়োর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। হতাশায় চকের মত ফ্যাকাসে হয়ে গেল সম্পূর্ণ মুখটি।
একটা বাক্স জালে বেঁধে উঠে এসেছে। বেজায় ভারি। জাল ছিঁড়ে যাবার জোগাড় টানাটানি করে কোনরকমে পাড়ে তুলল। তালাবদ্ধ। বুড়ো জেলে খলিফার কাছ থেকে নগদ এক’শ দিনার বুঝে নিয়ে বেজায় খুশী হয়ে ঘরে ফিরল।

খলিফার নির্দেশে উজির জাফর এবং রক্ষী মসরু কাঁধে বয়ে বাক্সটি প্রাঙ্গদে নিয়ে এল।

মসরু একটি হাতুড়ি নিয়ে এসে বাক্সের তালাটি ভেঙে ফেলল। তালাটি ফাঁক করেই চমকে উঠল। হয় আল্লা! এ যে কতকগুলো শুকনো তালপাতা বোঝাই। হাল ছাড়ল না। ব্যস্ত-হাতে তালপাতা গুলো সরাতে লাগল। এবার একটা কার্পেট তার চোখের সামনে ভেসে উঠল! কার্পেটটি বের করতেই দেখা গেল সাদা একটি বোরখা। মসরুর কৌতূহল বেড়ে গেল। ব্যাপারটি নিয়ে খলিফার মধ্যেও কম উৎসাহের সঞ্চার হ'ল না।

খলিফা বললেন- ‘মসরু, বোরকাটি তোল, দেখা যাক, আর কি আছে রহস্যজনক এ বাক্সটিতে।'

খলিফার আদেশে মসরু এবার বোরখাটি সামান্য তুলেই চমকে উঠে এক লাফে অনেকখানি পিছিয়ে গেল! তার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এল – হ্যায় আল্লাহ!'

খলিফা বললেন – কি ব্যাপার মসরু? তুমি হঠাৎ ভড়কে গেলে যে? কি আছে বাক্সের ভেতরে?

—জাহাপনা, লাশ! বীভৎস ব্যাপার। একটি লেড়কিরে টুকরো টুকরো করে কেটে বাক্সের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়েছে।

সামান্য এগিয়ে গিয়ে বাক্সের ভেতরে উকি দিতেই খলিফার সর্বাঙ্গে কম্পন শুরু হয়ে গেলে। ভয়ঙ্কর দৃশ্যই বটে, তাঁর শরীরের সব কটি স্নায়ু, এক সঙ্গে ঝনঝনিয়ে উঠল। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন— জাফর, আমার রাজত্বে এমন সব
অমানবিক কান্ডকারখানা ঘটে চলেছে। অসম্ভব। আমি কিছুতেই বরদাস্ত করব না। তোমরা সব থাক কোথায়? তোমাদের কাড়ি কাড়ি দিনার দিয়ে পুষছি কিসের জন্য, বুঝছি না তো। কী বীভৎস ব্যাপার। কী নৃশংস আচরণ। মানুষ মানুষকে খুন করছে, আমি যে কল্পনাও করতে পারি না।

উজির জাফর নিতান্ত অপরাধীর মত ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে অসহায় ভাবে হাত কচলাতে লাগলেন।

খলিফা বলতে লাগলেন— 'তোমরা আমাকে প্রায়ই মিথ্যা প্ৰবোধ দাও, এমন ন্যায় বিচারের দেশ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
আমার কথা মনে রেখো জাফর, অনেক ধোঁকা আমাকে দিয়েছ তোমরা। আর নয়। তোমাকে আমি তিনদিন সময় দিলাম। এর মধ্যে খুনিকে পাকড়াও করে আমার সামনে হাজির করা চাই । আর যদি ব্যর্থ হও তবে তোমার গর্দান নেওয়া হবে। না, গর্দান নিয়ে তোমার শাস্তির পরিমাণ কমানো হবে না। সদর দরজায় কাঠের পাল্লার গায়ে পেরেক গেঁথে তোমাকে হত্যা করা হবে, মনে রেখো।

শুধুমাত্র তোমাকে হত্যা করেই নিবৃত্ত হব না। তোমার বংশের প্রত্যেকের গর্দান নেওয়া হবে। বংশের বাতি দেওয়ার কাউকে রাখব না। তিন-দিন—মাত্র, দিনদিন সময় তোমাকে দিলাম। এ সময়ের
প্রতিকার না করলে অন্তিম বিচারের সময় আমি আল্লাহর কাছে কি ভাবাবদিহি করব?'

মৃত্যুভয়ে কাতর জাফর কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরলেন। এতবড় বাগদাদ নগর। কোথায় ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে হত্যাকারীর খোঁজ করবেন? আর হত্যাকারী কি সামনে সাক্ষী কাউকে রেখে হত্যা করে? আর যদি কেউ দেখেই থাকে তবে তো নিজেই ছুটে এসে
নবাবের দরবারে অভিযোগ করত। কী কঠিন সমস্যা রে বাবা। বিনা কারণে শেষ পর্যন্ত গর্দানটি দিতেই হবে। আবার শুধুমাত্র সন্দেহের বলে কাউকে ধরে নিয়ে এসে শুলে চড়ালেও বেইমানি করা হবে, অবিচারের দায়ে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কোথায় খুঁজবেন উজির জাফর। কাকে পাকড়াও করে নিয়ে আসবেন। এ নিয়ে মহা ধন্ধে পড়ে গেলেন। কাউকে পাকড়াও করে নিয়ে গিয়ে খলিফার সামনে হাজির করে নিতে পারলে তাঁর নিজের ও পরিবারের সবার জান বাঁচতে পারে বটে, কিন্তু নিরীহ নিরপরাধ একটি লোকের জান নিয়ে তবেই তা সম্ভব হতে পারে। না, এরকম একটি অধর্মের কাজ তিনি প্রাণ গেলেও করতে পারবেন না।

এক এক করে তিনটি দিন অতিবাহিত হল। উজির জাফর-এর প্রাণ ওষ্ঠাগত। এবার আর কেউ তাঁর জান বাঁচাতে পারবে না। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে সন্ধ্যার কিছু পরে খলিফার সামনে হাজির হলেন।
উজির নিজের জান এর জন্য যত না ভাবিত, তার চেয়ে অনেক বেশী করে ভাবছেন তার পরিবারের চল্লিশজন নিরীহ মানুষের জন্য। তার অযোগ্যতা অক্ষমতার জন্য শেষ পর্যন্ত পরিবারের সবার গর্দান যাবে। এ যে ভাবলেও গলা পর্যন্ত শুকিয়ে আসছে। উজির জাফরকে খালি হাতে ফিরতে দেখে হারুণ-অল-রসিদ তো রেগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। গুলিবিদ্ধ বাঘের মত গর্জে উঠলেন--- 'অপদার্থ কোথাকার। তোমার গর্দান আমি নেবই।'

খলিফা এবার বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন- জল্লাদ! জাল্লাদ!’ খলিফার তলব পেয়ে জোয়ান মরদ জল্লাদ পড়ি কি মরি কবে ছুটে এল। খলিফা বললেন— “নিয়ে যাও জাফর'কে। সদর-দরজার কাঠের পাল্লায় পেরেক গেঁথে একে লটকে রাখবে।'

খলিফার অমানবিক হুকুমের কথা শুনে নগরের সবাই তো একেবারে থ বনে গেল। আতঙ্কিতও কম হল না। এমন একজন প্রবীণ, তার ওপর শিক্ষিত, নানাগুণে গুণান্নিত এবং বিচক্ষণ উজিরের ওপর খলিফার আকস্মিক ক্রোধের কারণ কি-ই বা থাকতে পারে, তার কিছুই অনুমান করতে পারল না কেউ। তবে এটুকু অনুমানে বুঝল, বড় রকমের কোন গুস্তাকী না করলে কারো জান, এমন কি
সবংশে নিধন করতে পারে না।

উজির জাফরকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হ'ল। পেরেকবিদ্ধ করে হত্যা করার যাবতীয় কাজ শেষ। এখন শুধুমাত্র হাতুড়ির ঘায়ে পেরেক ঠোকার কাজটুকু বাকী। এমন সময় এক যুবক অকস্মাৎ কৌতূহলী জনতার ভিড় ঠেলে খলিফার কাছে এসে বলল –
'জাঁহাপনা, আপনি সুবিবেচক, আপনার কাছে আমার একটি অনুরোধ, বিনাদোষে উজির জাফরকে হত্যা করে নিজের গায়ে কলঙ্কের কালিমা লেপন করবেন না। ওঁকে মুক্তি দিন। আপনি বরং আমাকে হত্যা করে তামাম দুনিয়ার ন্যায় বিচারের স্বাক্ষর রাখুন। কারণ, মেয়েটির হত্যাকারী আমি। আমিই তাকে হত্যা করে সিন্দুক-বন্দী করে টাইগ্রিসের পানিতে ফেলেছিলাম। এতে তাঁর তো কসুর নেই।'

অজ্ঞাত যুবকটির কথা শেষ হতে না হতেই এক বৃদ্ধ এসে খলিফার সামনে দাঁড়াল। সম্মোচিত কায়দায় কুর্নিশ করে বলল – 'জাঁহাপনা, ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। ও ঝুট বাত কইছে। কসুর যা কিছু আমিই করেছি। আমার জান দিয়ে উচিত
বিচার করুন। ওকে খালাস করে দিন।

যুবক বলল— জাঁহাপনা, মেহেরবানি করে ওর কথায় কান দেবেন না। এত বয়স হয়েছে যে, ওর দিমাক ঠিকমত কাজ করছে না। মেয়েটিকে আমিই খতম করেছি! কসুর আমার । শাস্তি আমারই প্রাপ্য।

বৃদ্ধ তখন এগিয়ে গিয়ে মিনতির স্বরে বলল— যুবক, কেন ঝুটমুট ঝামেলা করছ। তোমার বয়স কম। জীবনে স্বাধ-আহ্লাদ অনেকই বাখি। আমার তো এমনিতে গোরে যাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এ নড়বড়ে দেহটার পরিবর্তে যদি তোমার, উজির
সাহেবের এবং তাঁর পরিবারের এতগুলো লোকের জান বাঁচে, আর আমার জান দিতে আপত্তিটা কোথায়, বুঝছি না তো?

পরিস্থিতি খুবই জটিল। এর উচিত মীমাংসা সম্ভব না। খলিফা ঘাতককে হুকুম দিলেন উজিরকে ছেড়ে দিয়ে এদের দুজনেরই গর্দান নাও। ল্যাটা চুকে যাক।'

উজির জাফর প্রতিবাদ করে ওঠেন– হুজুর, এতে কিন্তু ন্যায় বিচারের পরিবর্তে অন্যায়কেই প্রাশ্রয় দেওয়া হবে। একজনের অপরাধে দু’জনের জান নেওয়াকে মোটেই ন্যায় বিচার বলা যাবে না।'

যুকটি উন্মাদের মত চেঁচিয়ে ওঠে— 'জাঁহাপনা, আমার কথা শুনুন, আমি আল্লাহ-র নামে হলফ করে বলছি, আমি, আমি নিজের হাতে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছি!'

—'প্রমাণ' প্রমাণ কি?' খলিফা বললেন।

খলিফার হুকুমে যুবকটি হত্যার ঘটনাটি গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বিবরণ দিল।

- "ঠিক আছে, তোমার কথা আমি বিশ্বাস করছি। ভাল কথা, হত্যা তুমিই করেছ স্বীকার করে নিচ্ছি, কিভাবে তুমি হত্যাকাণ্ডটি ঘড়িয়েছিলে, বলো। কিন্তু কেন তুমি এমন নৃশংস একটি হত্যাকাণ্ড
ঘটিয়েছ, তা তোমাকে বলতে হবে।'

—বলব! তা-ও বলব জাহাপনা।

-আর একটি কথা তোমাকে বলতে হবে, লেড়কিটিকে হত্যা করার পর তুমি লাশটি গায়েব করার উদ্দেশে টাইগ্রিসের পানিতে লুকিয়ে রেখেছিলে, স্বীকার করলাম। কিন্তু এখন নিজের কসুর প্রমাণ করার জন্য এমন তৎপর হলে কেন?

-- তা-ও বলব, জাহাপনা। আমি এক এক করে সব বলছি, ধৈর্য ধরে শুনুন। যে নারীকে আমি হত্যা করেছি সে ছিল আমার বিবি। মৌলভী সাক্ষী রেখে শাদী করেছিলাম। শাদীর পর অনেক দিন আমরা এক সঙ্গে ঘর করেছিলাম। আমার তিনটি লেড়কাকে সে গর্ভে ধারণ করেছিল। আমাকে সে নিজের জানের চেয়েও বেশী মহব্বত করত। এ মাসের প্রথমের দিকে তার বুপার হয়। একেবারে বিছানায় আশ্রয় নেয়। সবচেয়ে বড় হেকিমকে ডেকে ওর ইলাজের ব্যবস্থা করলাম। প্রচুর পয়সা ঢাললাম। কিন্তু তার বুখার কমা তো দূরের কথা বরং বেড়েই চলছে। এক সকালে আমাকে কাতর স্বরে বলল—
'বুখার আমার মুখের স্বাদ কেড়ে নিয়েছে। ভাল একটি আপেল হলে হয়ত দু চার টুকরো খাওয়া যেত।

আমি ভাল আপেলের খোঁজে নগরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত ঢুঁড়ে বেড়ালাম। প্রকৃত ভাল আপেল বলতে যা বুঝায় তার খোঁজ পেলাম না কোথাও। কিন্তু আমার ব্যর্থতার কথা তার কাছে ফাঁস করিনি। ভাবলাম, সকালে আপেলের বাগিচায় গিয়ে খোঁজ করে দেখব যদি আপেল জোগাড় করা সম্ভব হয়।

সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক এক করে অনেকগুলি আপেলের বাগিচায় ঘুড়লাম। গাছ ফাঁকা একটিও ভাল আপেল কোথাও দেখতে পেলাম না। শেষ পর্যন্ত এক বুড়ো মালি বলল–
বাছা একমাত্র বসরাহর বড় বাজারে গেলে ভাল আপেল মিললেও মিলতে পারে। সেখানে সু-চারটে আপেল আমদানি হয় বটে। কিন্তু সবই খলিফার প্রাসাদে চলে যায়। যদি তা থেকে বলে কয়ে একটি
আপেন জোগাড় করতে পার।'

আমি আশান্বিত হয়ে বিবিকে বললাম— 'এবার হয়ত তোমাকে আপেল খাওয়াতে পারব।'

—তুমি আপেলের জন্য কেন এমন হন্যে হয়ে ছুঁটে বেড়াচ্ছে? বাজারে যদি না পাওয়া যায় তাতে তো তোমার কোন কসুর নয়।'

কথাটি বলেই আমার বিবি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আমার মনটি খুবই বিষিয়ে উঠল। নিজেকে বড়ই অপরাধী মনে হ'ল। বসরাহ পনের দিনের রাস্তা। যত কষ্টই হোক, বিবিটি বুখারে ফাহিল হয়ে পড়েছে। যদি একটি অন্তত আপেলের জোগাড়
করা সম্ভব হয়!

বসরাহর বাজারে গিয়ে কোনক্রমে তিনটি আপেল জোগাড় করা সম্ভব হ’ল। ব্যস, আর দেরী নয়। সোজা ঘরে ফিরে এলাম। আপেল নিয়ে ফিরে এলাম ঘরে, বিবির কাছে। সোৎসাহে আপেল
তিনটি ওর হাতে তুলে দিলাম। সে কিন্তু খুব খুশী হল না। নিস্পৃহ ভাবে আপেল তিনটি নিয়ে বালিশের পাশে রেখে দিল।

বিবির রকম সকম আমাকে ভাবিয়ে তুলুলো,
জানতে পারলাম আমার অনুপস্থিতিকালে ওর বুখার খুবই বাড়াবাড়ি হয়েছিল। আমি নিজেকে ওর সেবায় সঁপে দিলাম।

এমন সময় একদিন দেখি এক নিগ্রো যুবক একটি আপেল হাতে আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। কৌতূহল হয়। লম্বা লম্বা পায়ে তার কাছে গিয়ে বললাম— কি হে, এমন অসময়ে আপেল কোথায় পেলে, বল তো?

– 'কোথায় অবার পাব? আমার মেহবুবা আমাকে বকশিস দিয়েছে।'

— 'মেহবুবা? কে তোমার মেহবুবা? কোথায়ই বা থাকে?'

— তাঁতীপাড়া যে তলাওটি আছে, তার পশ্চিম দিকের বাড়ির মালিকের বিবি আমার মেহবুবা।
ওর স্বামীটি এক্কেবারে বোকার হদ। বিবিকে নিজের কলিজার চেয়েও বেশী পেয়ার করে।
বিবির বিমার হয়েছে। এর মরদ পনের দিন হাঁটাহাঁটি করে বসরাহ বাজার থেকে তিনটে আপেল এনে বিবির হাতে তুলে দিয়েছে। তারই একটি আমার মেহবুব আমাকে দিয়েছে।'

কথাটি কানে যেতেই আমার মনটি যার পর নাই বিষিয়ে উঠল। মাথায় রক্ত ওঠার জোগাড় হ’ল। মাথাটি চক্কর মেরে উঠল। দুনিয়ার সব কিছু মূলাহীন মনে হ’ল। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে বাড়ি
ফিরলাম। বিবিকে কিছু বললাম না। সবার আগে গেলাম তার ঘরে। দেখলাম। তার বালিশের ধারে তিনটির মধ্যে দুইটি আপেল। তার পরই আমার মাথাটা চক্কর মেরে উঠল। কোথা দিয়ে যে কি ঘটে গেল বুঝতেই পারি নি। যখন আমার হুঁশ হ’ল তখন দেখি, আমার হাতের ছুরিটি তার বুকে আমূল গেঁথে রয়েছে। হাতলটি তখনও আমার মুঠোর মধ্যে ধরা, আমার কলিজা এক মুহূর্তে শুকিয়ে একেবারে চিপসে গেল। আমি নিজের হাতে বিবিকে হত্যা করেছি। আমাকে শূলে চড়তেই হবে। হঠাৎ মাথায় একটি চমৎকার ফন্দি খেলে গেল। একটি বাক্স নিলাম। বিবির লাশটিকে টুকরো
টুকরো করে ফেললাম। ভরলাম বাক্সটির মধ্যে। বোরখা আর কার্পেটের গায়ে রক্তের ছোপ লেগে গেছে। সেগুলোও বাক্সের মধ্যে ভরে ফেললাম। এবার সবার ওপরে কিছু তালের পাতা চাপা দিয়ে দিলাম। তালা আটকে দিলাম বাক্সের আঙটাটির গায়ে। তারপর বাক্সটিকে মাথায় করে বয়ে নিয়ে টাইগ্রিসের পানিতে ফেলে দিয়ে তখনকার মত ব্যাপারটিকে সামাল দিলাম।

মুহূর্তকাল নীরবে কাটিয়ে যুবকটি কাতরস্বরে বলল- 'জাঁহাপনা, আপনি ন্যায়ের পূজারী। আল্লাহ-র পয়গম্বর হয়ে দুনিয়ায় অবস্থান করছেন। আমার অপরাধের কথা তো শুনলেনই, এবার আমার প্রাণদণ্ড দিয়ে আপনার কর্তব্য পালন করুন।'

আমার বিবির মৃতদেহসমেত বাক্সটি টাইগ্রিসের জলে ডুবিয়ে দিয়ে আমি বাড়ি ফিরে দেখি আমার বড় লেড়কাটি ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। আমি ধমকের সুরে বললাম— হয়েছে কি রে, এমন করে
কান্নার কি আছে?'

চোখ ডলতে ডলতে সে বলল— 'আব্বাজী, আম্মার বালিশের পাশ থেকে একটি আপেল নিয়ে রাস্তার ধারে বসে খেলছিলাম। তিনি জানতেও পারেন নি। তখন গাট্টাগোট্টা একটি নিগ্রো সে পথ দিয়ে যাবার সময় আমার হাত থেকে আপেলটি ছিনিয়ে নিয়ে
পালায়।'

ছেলের রকম সকম দেখে বুঝলাম, আপেলটি খুইয়ে ভয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকে নি। সেই থেকে দরজায় বসে কেঁদেই চলেছে। আমিও বাক্সটি নিয়ে বেরোবার সময় সে দরজার ধারে কাছে থাকলেও আতঙ্ক ও ব্যস্ততার জন্য লক্ষ্য করি নি। কিন্তু তার
মাকে যে আমি বেহেস্তে পাঠিয়ে দিয়েছি বিন্দুবিসর্গও তো তার জানা নেই।

রাগে-দুঃখে আমার সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি আর্তনাদ করে উঠলাম— হতচ্ছাড়া নিগ্রোটি এমন একটি কথা বলে সব কিছু তোলপাড় করে দিয়ে গেল। তবে তো আমার বিবি
একেবারে নিষ্কলঙ্ক নিষ্পাপ ছিল। আর আমি কিনা অন্যের কথা শুনে তার কলজেটিকে টুকরো টুকরো করে দোজকে যাওয়ার পথ পরিষ্কার করলাম। হত্যার পাপ আমাকে কালনাগিনীর মত দংশন করতে লাগল। সদ্য কন্যাহারা আমার শ্বশুর আর আমি সারা রাত্রি কেঁদে ভাসালাম।

জাঁহাপনা, পাঁচদিন আগে আমি এই নিষ্ঠুর হাত দুটো দিয়ে আমার কলিজার চেয়ে প্রিয় বিবিকে হত্যা করেছি। তারপর থেকে ভেতরে ভেতরে জ্বলে-পুড়ে খাঁক হচ্ছি। আপনার কাছে আমার
একটিই মাত্র প্রার্থনা, আমার মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ন্যায় বিচার করুন।

আমাকেও কৃত গুনাহের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দিন। সব কিছু শুনে খলিফা হারুণ-অল-রসিদ আর্তনাদ করে উঠলেন— ‘হারামি কাঁহাকার! হারামি নিগ্রোটিকে ধরে এনে শূলেনচড়াবার ব্যবস্থা কর জাফর! ঝুট বলে সে এতবড় সর্বনাশ করেছে।
যাও, যেখানে পাও খুঁজে বের কর।'