উনিশতম রজনীর দ্বিতীয় প্রহর


খন্ডিত নারী এবং আপেলের কাহিনী প্রায় শেষ করে শাহরাজাদ এবার নিগ্রো যুবক রাইহান-এর কাহিনী শুরু করলেন--

জাঁহাপনা, তারপর কি হ’ল বলছি শুনুন— খলিফা
হারণ-অল-রসিদ নিজ বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে নিঃসন্দেহ হলেন হত্যাকারী যুবকটি প্রকৃতপক্ষে দোষী নয়। পথচারী নিগ্রো যুবকটি তাকে মিথ্যা ভাষণের মাধ্যমে উত্তেজিত করার জনাই, সে হঠাৎ
মাথা গরম করে এমন একটি নিষ্ঠুরতম কাজ করে ফেলেছে। আর একথা শুনে খলিফা রেগেমেগে একেবারে কাঁই হয়ে গেলেন।

ক্রোধোম্মত্ত খলিফা উজিরকে ডেকে বললেন- হতচ্ছাড়া সে নিগ্রো যুবককে দরবারে হাজির করতেই হবে। যেখানে থাক পাতালে লুকিয়ে থাকলেও আমি তাকে চাই। তাকে শূলে না চড়ানো পর্যন্ত আমার স্বস্থি নাই। আর যদি তাকে ধরে আমার সামনে হাজির করতে না পার তবে সে-শূলে তোমাকেই চড়তে হবে, খেয়াল রেখো।

খলিফার কথায় উক্তির জাফর-এর চোখে নতুন করে পানি দেখা দিল। তিনি কেঁদে কেটে বলতে লাগলেন— হায় খোদা। তোমার এ কী মর্জি! তুমি কি আমার জান না নিয়ে ছাড়বেই না?
এ যাত্রায় যা হোক করে জানটি রেহাই পেল বটে কিন্তু আর হয়তো এ-জান টিকবে না। এখন তুমিই একমাত্র ভরসা।

উজির জাফর পৌনেমরা হয়ে তিনটি দিন ঘরের কোণে বসে চোখের পানি ফেললেন। বাড়ির সীমানার বাইরে বেরোলেন না। ভাবলেন ইতিমধ্যে খলিকার ক্রোধ প্রশমিত হলে হতেও পারে।
পাল্টে যেতে পারে তার নির্মম নিষ্ঠুর মৃত্যু।

এদিকে খলিফার ক্রোধ এক তিলও প্রশমিত হ'ল না। জাফর লোকমারফৎ খবর নিয়ে জানতে পারলেন, তিনি নির্দিষ্ট দিনের প্রতীক্ষায় নিশ্চিন্তে বসে রয়েছেন। জাফর নির্ঘাৎ নিগ্রো যুবকটিকে
তার শামনে হাজির করবেন। আর যদি ব্যর্থ হন বিকল্প ফরমাস তো জারি করেই রেখেছেন।

জাফর এক সময় বাধ্য হয়ে খলিফার সামনে হাজির হলেন। তার যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উইল তৈরী করে ফেললেন। এবার শেষ বিদায় নেবার পালা। বিবি ও ছেলেদের কাছ
থেকে চোখের পানির বিনিময়ে বিদার নিলেন। দুয়ারের কাছে তাঁর ছোট্ট মেয়েটি দাঁড়িয়ে। তাকে কোলে তুলে শেষ চুম্বনটি দিতে গিয়ে কোলে তুলে নিলেন। তার কামিজের জেবে ছোট কি জেন একটি রয়েছে বুঝলেন। জিজ্ঞাসা করলেন—
'বেটি, এটা কি?'

— ‘আপেল’ আর ‘নিঙ্গো যুবক' কথা দুটো কানে যাওয়া মাত্রই সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন-- 'বেটি, আপেল! নিখো যুবক!

ব্যস, আর এন্ড মুহূর্তও দেরী নয়। রেহানকে তলব করে আনলেন।

উজির জাহর-এর তলব পেয়ে রেহান ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এল।

জাফর জিজ্ঞাসা করলেন কোথা থেকে আপেলটি
পেয়েছিলি, সত্যি করে বল।

---- হুজুর, পথের ধারে কয়েকটি লেড়কা ও লেড়কি এটি নিয়ে লোফালুফি খেলছিল। আমি এক লেড়কাকে ছোট করে একটি চড় মেরে এটা ছিনিয়ে নিয়েছিলাম।'

–কেন? এর উদ্দেশ্য কি ছিল?

—- আমার ছোট লেড়কিকে দেব বলেই সেদিন অন্যায়ভাবে লেড়কাটির কাছ থেকে এটি ছিনিয়ে নিয়েছিলাম। সে কেঁদে কেঁদে বলছিল——
“এটি নিও না। আমার আম্মার খুব বিমার, আমাকে খুব বকাবকি করবে। আমি তাকে না বলে চুপি চুপি এটি নিয়ে এসেছি।” আমি তার চোখের পানির কোন দাম না দিয়েই এটি নিয়ে চলে এসেছি।'

জাফর এবার নতুনতর সমস্যার মুখোমুখি হলেন। নিগ্রো যুবক রেহান তাঁরই নোকর! সে ঘটনাটির সঙ্গে জড়িত শুনলে নানা জন নানা কথা বলাবলি করবে। রসসিক্ত করে কল্পিত কাহিনীর জাল
বুনতেও দ্বিধা করবে না। তবে এখন উপায়?

নসীবে যা আছে তাকে খন্ডাবে কে? অনন্যোপায় হয়ে উজির জাফর নিগ্রো যুবক রেহানের হাতে শিকল পরিয়ে নিয়ে এলেন খলিফার দরবারে।

খলিফা রেহানের-এর মুখ থেকে আপেলের বৃত্তান্ত শুনে একেবারে থ বনে গেলেন। অবাক হবার মত কথাই বটে। অতি সামান্য একটি ব্যাপার কেমন জটপাকিয়ে সর্বনাশের চূড়ান্ত ঘটাতে পারে এর আগে কোনদিন শোনা তো দূরের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি।

জাফর চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—
'জাঁহাপ্সা, নসীব যখন মন্দ হয়, আল্লাহ্ যখন মুখ ঘুরিয়ে থাকেন তখন এমন জটিল সমস্যা সৃষ্টি হয়ে আদমীর জান খতম হওয়াও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।
আপেল আর নিগ্রো নোকর রেহান-এর নির্বুদ্ধিতাকে অবলম্বন করে নসীব খেল দেখিয়েছে।

জাফর এবার মুহূর্তকাল নীরবে ভেবে বললেন—'জাহাপনা, এর চেয়ে বিস্ময়কর কাহিনী খটেছিল উজির নুর-অল-দিন আর তাঁর ভাই সামস্ অল-দিন এর জীবনে।'

খলিফা কপালের চামড়ায় চিন্তার ভাঁজ এনে বললেন- কি ঘটেছিল দু'ভাইয়ের জীবন, বল তো?'

— জাহাপনা, আপনার বাঞ্ছা অবশ্যই পূরণ করব তার আগে আমার ছোট্ট একটি অনুরোধ—
আমার নিগ্রো নোকর রেহান-এর মৃত্যু দন্ডাদেশ দয়া করে মকুব করে দিন। আসলে এটি এক বোকার হদ্দ। কাণ্ডজ্ঞান বলতে কিছু নেই। জাঁহাপনা, যা ঘটে গেছে তাকে তো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। অতীতের কথা ভেবে বর্তমানকে
উপেক্ষা করা মোটেই সমীচীন নয়।'

– তোমার ইচ্ছাকেই পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে আমি রেহানকে মুক্তি দিলাম। রেহান নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে দড়ি ছেঁড়া গরুর মত মালিকের বাড়ির দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল।