উজির জাফর, খলিফা হারুণ-অল-রসিদ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে উজির সামস-অল-দিন ও নুর-অল-দিন এর কিসসা শুরু করতে গিয়ে বললেন জাহাপনা, কোন এক সময় মিশরে মহাধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ এক সুলতান রাজত্ব করতেন। তাঁর বৃদ্ধ উজির ছিলেন একজন যথার্থই জ্ঞানী, বিভিন্ন বিষয়ে তার পারদর্শিতা ছিল অনন্য।
উজির সাহেবের দুই যমজ পুত্র ছিল। তাদের একজনের নাম ছিল সামস 'অল-দিন আর দ্বিতীয় জন ছিল নুর-অল-দিন। তাদের রূপ ছিল অসাধারণ। চোখ ফেরানো দায়। যেন তারা বেহেস্তের দূত।

মর্তে নেমে এসেছে আদমিত্র সুরত নিয়ে।
এক সময় বৃদ্ধ উজির দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। সুলতান দুই ভাইকে উজিরের পড়ে বহাল করলেন।

এক সকালে দু ভাইয়া দরবারে যাবার পথে পরস্পরের মধ্যে বাক্যলাপ করছিল। বড় ভাইয়া বললো—'আমাদের বয়স হয়েছে এবার আমাদের শাদী করে বিবি ঘরে আনা দরকার। আর মিছে দেড়ি করলে গুড়া বাচ্চানের মানুষ করে যেতে পারব না।

বিদ্যাশিক্ষা, নোকরি আর শাদী দিয়ে ঘর সংসার পেতে দিয়ে যেতে পারব না।'

-শাদী? তোমার মর্জি মাফিক'ই কাজ হবে।'

— শাদীর পর তো এমনও হতে পারে ভাইয়া, আমার লেড়জি হ'ল আর তোমার হল লেড়কা। তখন তো আমার লেড়কির সঙ্গে তোমার লেড়কার শাদী দিতে হবে, তখন?

—'আমার লেড়কাকে তোমার লেড়কির জন্য তবে কত সোনার দিনার দিতে হবে?'

—'আমি আগেই ঠিক করে রেখেজি পুরো তিন হাজার সোনার দিনার আমি তোমার লেড়কার কাছ থেকে নেব। তিনটি বড় গাঁও জায়গীর আর তিনটি খামারও দাবী করব আমি। সাফ কথা শোন,
তোমার লেড়কা যদি এতে রাজি না হয় তবে আর আমাদের মিছে কথাকাটাকাটি করে লাভ নেই। প্রসঙ্গটি এখানেই চাপা দিয়ে দেওয়া ভাল।'

—'ভাইয়া, তুমি মিছেই তিতা সৃষ্টি করতে চাইছ। ও ভাইয়া আর বহিন মিলে ঘর বাঁধবে এতে আবার দিনারের কচকচানি আসে কি করে, বুঝছি না তো।'

-তা হোক গে, আগে দেনা-পাওনার ব্যাপারটিরই ফয়সালা হয়ে যাওয়া উচিত। ঠিক আছে, আমি কসম খাচ্ছি তোমার লেড়কার সঙ্গে আমার লেড়ক্তির শাদী দেব না। কিছুতেই দেব না।
আমার লেড়কি টাইগ্রিসের জলে ভেসে আসবে নাকি?' রাগে গস্ গস্ করতে করতে সামস অল দিন বলল। বড় ভাইয়ার আচরণে নূর-অল-দিনও রেগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। সে-ও রীতিমত উত্তেজিত স্বরেই বড় ভাইয়ার উদ্দেশ্যে কথটি ছুঁড়ে দিল— 'আরে রাম— রাম! আমার ছেলেও রূপেগুণে সবার সেরাই হবে। তখন তোমার মত কত মেয়ের বাপ পিছন পিছন ঘুর ঘুর
করবে, দেখে নিও। এখন ব্যাপারটি চাপা দাও।

বড় ভাইয়া বলল— ‘তোর দেমাগ দেখে অবাক হচ্ছি। ঠিক আছে, কাল সুবহে তো আমি সুলতাদের সঙ্গে বেরোচ্ছি, তখন আমি তোর ঔদ্ধত্য ও কার্পণের কথা সুলতানের কানে তুলবই।
দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।

পরদিন ভোরে নবাব উজির সামস-অল-দিনকে নিয়ে নীল নদের তীরে এলেন। পালকী চেপে ভ্রমণ শুরু করলেন। জিজায় পিরামিড দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা। এদিকে বড় ভাইয়ার আচরণে নূর-অল-দিন খুবই ক্ষুব্ধ হ’ল। মনস্থ করল, এ-সুলতানিয়তেই আর থাকবে না। অন্যত্র গিয়ে নোকরি জোগাড় করে নেবে। সে নোকরকে দিয়ে নিজের ছাই রঙের খচ্চরটি তৈরী করিয়ে নিল।

নোকরটি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল—
“হুজুর, আপনার আদেশ আমি এক্ষুণি পালন করছি। কিন্তু কোথায় যাবেন, মেহেরবানি করে এ-অধমটির কাছে বলবেন কি?'

—কোথায় যে যাব তা আমিও ঠিক জানি না। তবে সবার আগে কালিব নগরে যাব। সেখানে দু'তিন দিন থাকার পর যেদিকে দু’চোখ যায় খচ্চরটিকে নিয়ে যাত্রা করব। মিছে আমার পাত্তা জানার চেষ্টা করিস নে। এ-স্বার্থপর, হিংসা, দ্বেষ আর রেষারেষির মধ্যে আমার আর এক মুহূর্তও থাকার ইচ্ছে নেই।'

নূর-অল-দিন তাঁর বাহন ছাই রঙের খচ্চরটির পিঠে চেপে অজানা উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। দুপুরের দিকে বুলবেশা নগরে হাজির হ’ল। ইতিমধ্যেই কায়রো নগর পেরিয়ে এসেছে। একটি সরাইখানার দরজায় খচ্চরটিকে ছেড়ে দিয়ে খাওয়া দাওয়া করার জন্য ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর অত্যাবশ্যকীয় কিছু সামগ্রী কেনাকাটা সেরে আবার খচ্চরের পিঠে চেপে বসল। এবার হাজির
হ'ল জেরুজালেম নগরে। নূর-অল-দিন পথশ্রমে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বিশ্রাম না নিলে আর চলছে না। খচ্চরটির পিঠ থেকে গালিচা আর কম্বল নামিয়ে তাকে চরতে দিল। কম্বল বিছিয়ে শুয়ে
পড়ল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের ঘোরে তার বড় ভাইয়াকে খোয়াবের মধ্যে দেখল। তারা দুজনে গলা ছেড়ে ঝগড়া করছে দেখল। আচমকা তার ঘুম ভেঙে গেল। হুড়মুড় করে উঠে বসল। তার মন-প্ৰাণ অস্বাভাবিক বিষিয়ে উঠল। সে বড় ভাইয়া আত্মীয় কুটুম্বদের ছেড়ে এসেছে বটে কিন্তু তাদের চিন্তা তার মাথা থেকে কিছুতেই নামছে না দেখে যারপর নাই বিস্মিত হ'ল।

সকাল হ’ল। নূর-অল-দিন আবার গাধার পিঠে চাপল। সন্ধ্যার কিছু আগে আলেপ্পো নগরে গাধা দাঁড় করাল, একটি সরাইখানার সামনে গাধাটিকে বেঁধে সে ভেতরে ঢুকে গেল। খানাপিনা সেরে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে ঘুম থেকে উঠে জায়গাটিকে ঘুরে ঘুরে দেখল। খুবই ভাল জায়গা। মনে ধরে গেল। দুপুরের কিছু আগে আবার সে যাত্রা শুরু করল। কোথায় যাচ্ছে, কোথায় গিয়ে নামবে একমাত্র আল্লাহ-ই জানেন। সংসারেরবস্বার্থপরতা দ্বেষ আর হানাহানি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এসে আজ সে যাযাবর জীবন সম্বল করেছে। পথই আজ তার একমাত্র অবলম্বন।

এবার সে সুবিখ্যাত নগর ও বন্দর বসরাহতে পৌঁছল। স্থানীয় ও বহিরাগত বহু সওদাগর প্রতিদিন এখানে জড়ো হয়, দ্রব্যসামগ্রী কেনা বেচা করে।

নূর অল দিন একটি ছোট্ট সরাইখানায় ঢুকে খানাপিনা সারল। সরাইখানার মালিক খান-সাহেবের এক কর্মচারীকে নিয়ে সে এবার
নগর পরিভ্রমণে বেরল। পাহাড়ী পথ। ঘন ঘন চড়াই-উৎরাই। অনভ্যস্থ পা দুটো সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল! নগরের কেন্দ্রস্থল অসমতল হলেও খুব বেশী উঁচু-নিচু নয়।

নূর-অল-দিন খচ্চরটির পিঠে চড়ে বসরাহ্ নগর দেখতে  দেখতে এগিয়ে চলল। সরাইখানার বালক কর্মীটি পাশে পাশে পায়ে হেঁটে চলেছে। বসরাহ্ এর উজির নিজের বাড়ির জানালা দিয়ে শহরের শোভা দেখছেন। অকস্মাৎ সুদর্শন যুবক নুর-অল-দিনকে
দেখে তার রূপে মুগ্ধ হলেন। এক নোকরকে বললেন— 'এক ছুটে দেখে আয় তো খচ্চরটির পিঠে কে যাচ্ছে? আর সঙ্গের ওই লেড়কাটিকে ডেকে নিয়ে আসবি।'

সরাই-বালকটি এলে উজির নূর-অল-দিন-এর পরিচয় জানতে চাইলেন। সে কিছুই বলতে পারল না! তবে খানসাহেবের সাইখানায় আজই প্রথম এসেছেন, তার সঙ্গের সমানপত্তর বহুমূল্যবান। নবাব, বদশাহ বা সুলতানই কেবল সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন।

উজির খানসাহেবের সরাইখানার ঠিকানাটি নিয়ে সরাই- বালকটিকে বিদায় দিলেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই উজির সরাইখানায় এসে খান সাহেবের সঙ্গে মোলাকাৎ করলেন। উজিরের অতুগ্র আগ্রহে খানসাহেব অতিথি নূর-অল-দিনকে ডেকে আনলেন।

নূর-অল-দিন উজিরকে অভ্যর্থনা করে ঘোড়া থেকে নামিয়ে সরাইখানায় নিয়ে গেল। একটি ছোট্ট খাটিয়া পেতে বসতে দিল।

কথা প্রসঙ্গে উঠির বলেন-- 'সে কি বাছা! তুমি আমাদের দেশের মেহমান। আর তুমি কিনা এরকম একটি ভাঙাচোরা সরাইখানায় পড়ে থাকবে, হতেই পারে না। আমার বাড়িতে অতিথ্য গ্রহণ করবে চল। তোমার কোন আপত্তিই শুনব না।'

নূর-হল-দিন বহুভাবে আপত্তি করল। ধোপে টিকল না। অন্যাপায় হয়ে শেষ পর্যন্ত উজিরের বাড়িতে তাকে আতিথ্য গ্রহণ করতেই হল।

খানাপিনা সেরে গল্প করতে বসে প্রসঙ্গক্রমে উজির তাকে বললো– বাছা, তোমার মনের কথা খোলসা করে বল তো, এত পথ পাড়ি দিয়ে তুমি আমাদের দেশ এ-বসরাহ নগরে এলে কেন?
নিছকই দেশভ্রমণের তাগিদে, নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে।'

কোন বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে এখানে অবশই আসিনি। নিছকই ঘুরে ঘুরে দেশ দেখতে দেখতে এখানে এসে পড়েছি। মিশরের সুলতানের উজির ছিলেন আমার আব্বাজী।
তিনি বেহেস্তে গেলে আমরা দুই’ভাই উজিরের পদে বহাল হই। কিন্তু সংসারের স্বার্থপরতা, লোভ, নক
নীচমনোবৃত্তি প্রভৃতি দেখে বিতৃষ্ণায় আমার মন-প্রাণ বিষিয়ে ওঠে। ভালম কি, এ জায়গা তো আমার জন্য নয়। চারদিকে স্বার্থপর মানুষের ভিড়ে আমার প্রাণ তো ওষ্ঠাগত হয়ে উঠছে। বিরক্ত হয়ে খচ্চরটিকে নিয়ে হারা উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। ঘুড়ে ঘুড়ে নিত্য নতুন দেশ দেখে বেড়াব, এই তো চাই। একদিন সত্যি সত্যি কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে গেলাম।

নূর-অল-দিন-এর যুবক বয়সেই ঘর-সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণা জেগেছে দেখে উজির সবিনয়ে বললেন- একী কথা! আজ বয়স কম, রঙিন স্বপ্নে মসগুল হয়ে পড়েছ। কিন্তু চিরদিন তো আর এ
মনোভাব স্থায়ী হবে না। তারপর একদিন দেহের তাকতও কমতে থাকবে। পথ চলার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবে। তখন কিন্তু তোমার নিজের দেহকেই এক বাড়তি বোঝা বলে মনে হবে, জেনে রাখ।
তুমি সুন্দরের পিয়াসী, খুবই সত্য। কিন্তু এ-সুন্দরকে তো চিরদিন সুন্দর বলে মনে হবে না। বিতৃষ্ণ জন্মাবে। তামাম দুনিয়া ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে না বেড়িয়ে এক জায়গায় বসেই সব সৌন্দর্যকে উপভোগ করা সম্ভব। বৃদ্ধ, উজির খুবই বিচক্ষণ ব্যক্তি। অমিত বুদ্ধির আধার। এমন সুদর্শন এক যুবককে পেয়ে তার মনে অদম্য উৎসাহ জাগলো।
মনস্থির করে ফেললেন, নিজের লেড়কিকে এর হাতে তুলে দেবেন। শদী দিয়ে সুলতানকে অনুরোধ করে শেষে দরবারে একটি নোকরি জোগাড় করে দেবেন।

উজির নিজের প্রাসাদের সুসজ্জিত কক্ষে মেহমান নূর-অল-দিন এর থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।

এক সকালে বৃদ্ধ’উজির নূর-অল-দিনকে বললে—'বাছা, আমি বুড়ো হয়েছি। আর নোকরি করার মন নেই, তাই উজিরের পদ থেকে এবার বিদায় নেব ভাবছি। সুলতানকে বলে আমার পদে তোমাকে নিয়োগ করার ব্যবস্থা করব। তার আগে আমার বেটির সঙ্গে তোমার শাদীর ব্যাপারটি মিটিয়ে নিতে চাই। আমার বেটিকে তো তুমি দেখেছই। সে যে খুবসুরৎ, তা আমি নিজমুখে না-ই বা বললাম। বিচারের ভার আমি তোমার হাতেই দিচ্ছি। তারপর যদি মন চায় আমার বেটিকে শাদী করে তোমার জীবন সঙ্গিনী করে নিতে পারবে।'

কথাটি শুনে নুর-অল দিন এর খুবই শরম হ’ল।শির নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। এক সময় সঙ্কোচে লজ্জাতুর কন্ঠে বলল— এতে আমার আর কি বলার থাকতে পারে? আপনি ভাল বুঝে যা হয় করুন।

নূর-অল-দীন-এর সম্মতি পেয়ে বৃদ্ধ উজিরের মনে অনন্দ যেন আর ধরে না। খুশীতে একেবারে ডগমগ। প্রাসাদের অন্দর মহলেও খুশীর জোয়ার বয়ে চললো।

উজির খুবই জাঁকজমকের সঙ্গে তার বেটির শাদীর আয়োজন করলেন। আত্মীয়-বন্ধুরা কব্জী ডুবিয়ে খানাপিনা করল। দামী সরাবের বন্যা বয়ে চললো।

নিমন্ত্রিত মেহমানরা বিদায় নিলে উজির নূর-অল -দীনকে হামামে পাঠালেন। সঙ্গে দুজন নফর গেল। হামামে যাওয়ার ব্যাপারটি সে দেশের প্রচলিত প্রথা। জামাতা বাবাজীকে হামাম থেকে গোসল সেরে বেরিয়ে লেড়কির অব্বাজীর হাত থেকে নতুন পোশাক পরতে হয়। তারপর সুসজ্জিত খচ্চরের পিঠে চেপে নগর পরিক্রমণে বেরোবেন।

নূর-অল-দীন খচ্চরের পিঠে চেপে নগর পরিভ্রমণ করে ফিরে এল। উজির অপেক্ষা করছেন। জামাতা বাবাজীকে অভ্যর্থনা করে অদরমহলে নিয়ে গেলেন।


বেগম শাহরাজাদ দেখলেন ভোরের আলো ফুটতে আর বিলম্ব নেই। এবার কিস্সা বন্ধ করলেন।

রাত্রে আবার বাদশাহ শাহরিয়ার এলেন। বেগম শাহরাজাদ কিসসা শুরু করলেন---
জাঁহাপনা, সে উজির তার জামাতা নুর-অল-দীন কে অভ্যর্থনা করে অন্দরমহলে নিয়ে ফুলমালায়
সুশোভিত একটি ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

নুর-অল-দীন দেখল তার বিবি সোনার জরিবুটি দেওয়া ঝলমলে পোশাক পরে সুসজ্জিত পালঙ্কের ওপর অপেক্ষা করছে।

আজ তার জীবনে সবচেয়ে মধুর রাত্রি। সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত। আজই প্রথম চরম আনন্দের স্বাদলাভে জীবন ধন্য হবে।

নূর-অল-দীন সদ্য শাদীকরা বিবিকে পাশে বসিয়ে দেশ- বিদেশের বহু চটকদার গল্প শোনাল।

রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর। নূর-অল-দীন তার বিবিকে বুকে টেনে নিল। একে অন্যের মধ্যে নিঃশেষে বিলীন হয়ে গেল। দোহে মিলে এক ও অভিন্ন। একজনকে বাদ দিয়ে অন্য জনের অস্তিত্বের কথা
কল্পনাও করা যায় না।

ছোট ভাইয়া নূর-অল-দীন যখন সদ্যবিবাহিতা বিবিকে নিয়ে আনন্দে মসগুল হয়ে দিন কাটাচ্ছে তখন তার বড় ভাইয়া সামস-অল-দীন সুলতানের সঙ্গে গীজের পিরামিড দেখে বাড়ি ফিরল।
দেখে, নূর-অল-দীন বাড়িতে অনুপস্থিত।

নফরের মুখে সামস-অল-দীন শুনল, ক'দিন আগে তার ছোট ভাইয়া খচ্চরের পিঠে চেপে কোথায় গেছে। ব্যস্ আর বাড়ি ফেরে নি। কোথায় গেছে, কবে ফিরবে কিছুই নাকি বলে যায় নি।

সামস-অল-দীন ছোট ভাইয়ার শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ল। তার বুঝতে কিন্তু বাকি রইল না যে, রাগের মাথায় সেদিন যেসব অসঙ্গত কথা বলেছে তারই ফলে তার ভাইয়া ঘর-সংসার ছেড়ে বিবাগী হয়ে গেছে। নিজের কাজের জন্য খুবই মর্মাহত হ’ল সে।
উপায়ন্তর না দেখে সামস-অল-দীন সুলতানের কাছে সবকিছু খোলসা করে বললেন, সুলতান ব্যাপারটিতে মনে খুবই ব্যথা পেলেন।

ব্যথিত মর্মাহত সুলতান বহু দেশের দরবারে দূত পাঠিয়ে নুর-অল-দীন-এর খবরাখবর নিতে লাগলেন। বৃথা চেষ্টা। দুতরা এক এক করে খালি হাতে ফিরে এল। দূতদের কেউ-ই কিন্তু বসরাহ্ রাজ্যে যায় নি। কেন যে তারা একটিমাত্র রাজ্য বাদ দিল এ নিয়ে কারো মনেই কোন সন্দেহের উদ্রেক হয় নি।

ছোট ভাইয়ার খোঁজ না পেয়ে সামস-অল-দীন বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল। একমাত্র নিজের দোষেই সে তার প্রাণপ্রতীম ভাইকে হারিয়েছেন। তার শোক ক্রমে মন থেকে মুছে যেতে যেতেবএক সময় একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। স্বাভাবিকতা ফিরে পেল সে।

সামস আল-দীন বিয়ে শাদী করে ঘর বাঁধল। তার জীবনে আবার হাসি আনন্দের জোয়ার নেমে এল।

আল্লাহ-এর মর্জি মানুষের বুঝা ভার। তা নইলে ছোড় ভাইয়া নূর-অল-দীন-এর শাদীর রাতেই বড় ভাইয়া সামস-অল-দীন এর বিয়ে কি করে সম্ভব হ’ল! আরও আছে— নূর-অল-দীন-এর বিবি
যে-রাত্রে অন্তঃসত্ত্বা হল সে রাত্রেই সামস-অল-দীন-এর বিবিও গর্ভে সন্তান ধারণ করল। আশ্চর্য ব্যাপার নয় কি। একমাত্র আল্লাহর
খেয়ালের ফলেই এমনটি সম্ভব হতে পারে।

নুর-অল-দীন-এর শাদীর ব্যাপার স্যাপার মিটে গেলে বৃদ্ধ উজির তাকে নিয়ে সুলতানের দরবারে হাজির হলেন। সুদর্শন নূর-অল-দীন'কে প্রথম দর্শনেই সুলতানের মধ্যে স্নেহের উদ্রেক ঘটল।
বৃদ্ধ উজির প্রস্তাব দেওয়ামাত্রই তিনি তাকে উজিরের পদে বহাল করতে সম্মত হলেন।

সুলতানের নির্দেশে বৃদ্ধ উজির তার জামাতা নূর-অল-দীনকে উজিরের কাজকর্ম সব বুঝিয়ে দিলেন।

নূর-অল-দীন উজিরের পদলাভ করলেন। সেই সঙ্গে সুন্দর বাসস্থল, আসবাবপত্র, নফর, খচ্চর ও ঘোড়া প্রভৃতি প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবই পেল।

যথাসময়ে নূর অল-দীন-এর এক লেড়কা জন্মগ্রহণ করল। আবার ঠিক সেদিনই তার দেশের বাড়িতে তার বড় ভাইয়ার একটি লেড়কী জন্মায়। নুর-অল-দীন তার লেড়কার নাম রাখল হাসান-বদর-অল-দীন।

এদিকে সুতানের দরবারে নূব-অল-দীন-এর খুবই, সুখ্যাতি। সে যেমন কাজকর্মের দিক থেকে বিচক্ষণ তেমনি ব্যবহারও খুবই মধুর। সবার সঙ্গেই হেসে হেসে কথা বলে। সুলতান তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তার বেতন বাড়িয়ে দিলেন বেশ কিছু দিনার। হবে না-ই বা কেন? রাজস্বও যে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

উজির যখন মারা গেলেন তখন হাসান-বদর-অল দীন এর ওমর মাত্র চার সাল। উজিরের মৃত্যুতে সে পদে আসীন হয় নূর-অল-দীন। উজিরের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সর্বদাই কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে হয় তাকে। তা সত্ত্বেও বেটার শিক্ষা দীক্ষার
দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলত। ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ও শিল্পকলা বিষয়ে অত্যল্পকালের মধ্যেই প্রভূত জ্ঞানলাভ করল।
তার ওমর যখন বারো সাল হ'ল তখন মৌলভী নূরু-অল-দীন-কে বলল -- 'তোমার বেটাকে আমার আর কিছু দেবার নেই। আমার বিদ্যা সবই ওকে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছি।'

নূর-অন-দীন তার বেটা হাসানকে নিয়ে সুলতানের দরবারে হাজির হ’ল। তাকে দেখে সুলতান চমৎকৃত হলেন। তার রূপণ্ডলে তিনি যারপর নাই মুগ্ধ হলেন। তিনি উজির নুরকে ডেকে বললেন— 'আমার হুকুম তুমি রোজ দরবারে আসার সময় তোমার বেটা হাসান'কে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।

উজির নূর সোল্লাসে বললো- জ্বী হুজুর। অবশ্যই নিয়ে আসব, আপনার হুকুম তামিল করব, কথা দিচ্ছি।'

তারপর থেকে উজির নূর রোজ তার বেটা হাসান'কে সঙ্গে করে দরবারে নিয়ে যায়। সুলতান তাকে পাশে বসিয়ে খুব আদর যত্ন করেন।

উজির নূর-অল-দীন-এর সংসার হাসি-আনন্দের মধ্যেই কাটাতে লাগলো।

এমন সময়ে হঠাৎ একদিন নূর-অল দীন বিমারে পড়ল। বিমার ক্রমেই বেড়ে চলল। অভিজ্ঞ হেকিম ডাকা হ'ল। কোন ফল হ'ল না। হেকিম জবাব দিয়ে গেল।

নূর-অল-দীন বুঝল, দিন ঘনিয়ে এসেছে। বেটা হাসানকে ডেকে বলল -- 'বেটা, আল্লাহর কাছ থেকে আমার ডাক এসেছে। আমাকে চলে যেতেই হবে। এ-সংসার তো সরাইখানারই নামান্তর মাত্র। দু চারদিনের জন্য আসা। মায়া মোহে জড়িয়ে থাকা বৈ তো নয়। এবার মায়া কাটিয়ে বিদায় নেন। আবার বেহেস্তে ফিরে যাব।
সেখানে কেবল সুখ-আনন্দ। আনন্দের ছড়াছড়ি।

বেটা, আমার যা কিছু কর্তব্য সবই খতম করেছি। মাত্র একটি কাজই করার বাকি রয়ে গেছে। তোমাকে সে কাজের ভার দিয়ে যাচ্ছি। কায়রোতে আমার এক বড়ভাই আছে। তার নাম সামস অল-দীন। সুলতানের উজিরের পদে বহাল রয়েছে। আমিও সেখানকার উজির ছিলাম এক সময়। সামান্য একটি কারণে বড় ভাইয়ের সঙ্গে আমার মতবিরোধ ঘটে, আর তারই ফলে আমি
স্বদেশ ত্যাগ করে বহুদেশ ঘুরে এখনে হাজির হই। এবার হাসান- এর দিকে চোখ রেখে বলল – কাগজ কলম নিয়ে আমার সামনে বোসো।

হাসান তাড়াতাড়ি এক টুকরো তুলোট কাগজ আর কলম নিয়ে বাপের সামনে বসল। নূর বলল— 'বেটা, আমি যা যা বলছি লিখে নাও।

নূর কবে কায়রো ত্যাগ করেছিল, কবে ও কিভাবে বসরাহ নগরে হাজির হয়েছিল, কবে সুলতানের সঙ্গে পরিচয় হয় কবে উজিরের লেড়কিকে শাদী করে, করে তার বিবি অন্তঃসত্ত্বা হয়, কবে হাসান এর জন্ম হয় প্রভৃতি বিবরণ দিল আর হাসান সবকিছু হুবহু লিখে নিল। তারপর নুর বলল— 'বেটা, কাগজটি যত্ন করে রেখো। সময় মত বের করবে, অশেষ উপকারে আসবে, আর আমার মৃত্যুর পর একবারটি তুমি স্বদেশ থেকে ঘুরে এসো, আমার বড় ভাইয়াকে বোলো, তার সঙ্গে দেখা করে যেতে পারলাম না বলে আমি বড়ই মর্মবেদনা নিয়ে যাচ্ছি।'

সে ঘটনার মাত্র একদিন পরেই নূর অল-দীন-এর মৃত্যু হ'ল। পুত্র হাসান বদর-অল-দীন চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে তার আব্বার গোর দিল। শোকে খুবই ভেঙে পড়েছে, কোন কাজেই
মন নেই। সর্বদা মনমরা হয়ে বসে থাকে। সুলতান তাকে উজিরের পদে বহাল করবেন বলে দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য বারবার তলব পাঠান। কিন্তু হাসান-এর কিছুমাত্রও ভ্রক্ষেপ নেই।

হাসান একটি মাত্র কাজকেই এ-মুহূর্তে অবশ্য করণীয় জ্ঞান করছে, তাকে কায়রোতে যেতে হবে। তার বাবার শেষ বাঞ্ছা তাকে পুরণ করতেই হবে।

এদিকে হাসান-এর আচরনে সুলতান যারপর নাই অপমানবোধ করলেন। ক্রোধোম্মত্ত সুলতান তাঁর কয়েকজন সিপাহীকে আদেশ দিলেন- হাসান যেখানে যে অবস্থাতেই থাক না কেন, হাতে শিকল পরিয়ে আমার সামনে হাজির কর।

সুলতানের হুকুমে সৈন্যরা হাসানকে শিকল পরিয়ে দরবারে হাজির করার জন্য ছুটলো। সময়মত হাসান-এর এক বিশ্বস্ত অনুচর তাকে সতর্ক করে দিল। তাড়াতাড়ি এ সুলতানিয়াত ছেড়ে যাবার
জন্য অনুরোধ করলো।

অনুচরটির কথা শুনে হাসান প্রমাদ গুনল। সে অনুচরটির কাছ থেকে কিছু দিনার ধারস্বরূপ নিয়ে দীন ভিখারীর সাজে নিজেকে সাঁজিয়ে নিয়ে পথে নামল। ভাবলো, তার আব্বার গোরস্থানে গিয়ে
রাত্রিটুকু কাটিয়ে নেবে। তারপর রাত্রির চতুর্থ প্রহরে সে যখন তার বাবার গোরস্থানে বসে চোখের পানি ফেলছে তখন হঠাৎ এক জু অভাবনীয়ভাবে সেখানে হাজির হ'ল। বসরাহ-র ধনকুবের বণিক।
সরবে হেসে বলল— 'হুজুর, আপনি হঠাৎ এখানে কেন ?'

—'আরে, আর বোলো না। আজ দুপুরে এক খোয়াব দেখেছি, আমার বাবা যেন বলছেন, আমার কবরের ধারে একবারটি যাস্।
একটি জরুরী কথা তোকে বলব।'

তারপর আশায় বুক বেঁধে এখানে এসে বসে আছি। চাপা দীর্ঘশ্বাসের মত আওয়াজ করে জু বললো— 'অপনার বাবার মত ভাল মানুষ দ্বিতীয় আর একজন দেখিনি। আহারে! কী স্নেহই না
করতেন আমাকে। একটি কথা আপনাকে বলার জন্য ছটফট করছি। বলার সুযোগ আর হয় নি। আপনার আব্বার যে জাহাজের ব্যবসা ছিল আশাকরি আপনার অজানা নয়। তাঁর সঙ্গে আমার কথা একরকম পাকাপাকিই হয়ে গিয়েছিল, আমি তার জাহাজ কিনে নেব। কিন্তু জাহাজটি হস্তান্তর হওয়ার আগেই তিনি বেহেস্তে চলে গেলেন। আপনি চাইলে আমি একটি জাহাজ নগদ এক হাজার
দিনারের বিনিময়ে কিনে নিতে ইচ্ছুক।'

হাসান বণিকটির কথায় আপত্তি করতে না পেরে এক হাজার দিনারের বিনিময়ে একটি জাহাজ তার কাছে বেচে দিল। আর একটি রসিদও লিখে দিল-“আমি হাসান-বদর অল-দীন, পরলোকগত উজির নুর-অল-দীন-এর একমাত্র ছেলে- আপনার কাছ থেকে নগদ এক হাজার দিনার বুঝে পেয়ে (পিতার) সম্প্রতি আমার একটি সওদাগরী জাহাজ বিক্রি করলাম। আর এ-ও কথা থাকছে, আমার যে জাহাজটি বন্দরে প্রথম ভিড়বে সেটিই আপনার
হাতে তুলে দেব।” হাসান দলিলটিতে নিজের নাম স্বাক্ষর করে জু এর হাতে তুলে দিল। সে বহুভাবে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বিদায় নিল। হাসান রাত্রির অন্ধকারে আবার একা বসে রইল।
তৃতীয় গ্রহরে আব্বাজীর সমাধি সৌধের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

নিঃঝুম নিস্তব্ধ গোরস্থানে গভীর রাত্রে প্রেতাত্মাদের আগমন ঘটে। আর আসে জীন ও পরীরা। তখন এক জিনিয়াহ সেখানে হাজির। খুবসুরৎ হাসান'কে দেখে তার মনে পুলকের সঞ্চার ঘটে। সে নিজেও খুবসুরৎ দেখতে। হাসানকে দেখামাত্রই সে ভালবেসে ফেলে। কিন্তু তখন তার ঘুম ভাঙাল না। ভাবল, একটু ঢুঁড়ে এসে একে জাগিয়ে গল্পগুজব করবে। আবার পাখা মেলল।

আকাশ পথে ঢুঁড়তে গিয়ে অন্য এক জিনিয়াহর সঙ্গে তার দেখা হয়। সে কায়রো নগর থেকে আসছে। কুশলবার্তাদি আদান-প্রদানের পর জিনিয়াহ তাকে নিয়ে গোরস্থানে এল একটি জিনিস দেখাবার লোভ দেখিয়ে।

হাসান-এর যৌবনভরা দেহের রূপ সৌন্দর্য দেখে জিনিয়াহও মুগ্ধ হয়ে গেল। জিনি বল— উজির নূর আল-দীন-এর বেটা হাসন নাকি তামাম দুনিয়ার যুবকদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু এ-যুবকও তো খুবসূরত-ই বটে। কমতি কিসে? আর কায়রোর
উজিরর সমস-অল-দীন-এর বেটিকেও দেখেছি। কী সুরৎ! হুরী পরীর মত দেখতে। এর শাদী যদি কোন দিন হয় তবে একমাত্র সে লেড়কিকেই এর পাশে মানাবে।

—'আমি সে লেড়কিকে কোনদিন চোখে দেখি নি। তার কথা শুনিও নি কোনদিন।'

—'তবে বলছি শোন, এমন রূপ-যৌবনের আকর লেড়কিটি খুবই হতভাগিনী।'

উজিরের খুবসুরৎ লেড়কি দেখে সুলতানের মাথা বিগড়ে যাওয়ার জোড়। উজিরকে একদিন বললেন– 'শোন, তোমার বেটিকে আমি শাদী করতে চাই। তুমি রাজি হয়ে যাও।'

চমকে উঠে উজির বলল – 'জাঁহাপনা, আমার গেস্তাকী মাফ করবেন। আপনার তো আর অজানা নয় আমার ছোট ভাইয়া নূর অল-নীন বিবাগী হয়ে ভিনদেশে পাড়ি দিয়েছে। আমাদের মধ্যে একদিন কথা হয়েছিল, আমার বেটির সঙ্গে তার বেটার শাদী দেব। আমি জেনেছি, তার বেটা বসরাহতে আছে। জোয়ান মরদ হয়েছে। আমার ভাই কিছু দিন আগে বেহেস্তে দিয়েছে। আমি যদি কথার
খিসাফ করি তবে আমার শুনাহ হবে, ঠিক কিনা? ছোট ভাইয়া বেহেস্তে গিয়েও স্বস্তি পাবে না। জাহাপনা আমাকে সাত্য রক্ষা করা থেকে বঞ্চিত করবেন না। আপনি সুলতান, আপনি মনে করলে
তামাম দুনিয়ার খুবসুরৎ লেড়কির হাট বসিয়ে দিতে পারেন প্রাসাদের সামনে।

উজিরের কথার সুলতান রেগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। তাকে প্রত্যাখ্যান করে উজির রীতিমত অপমান করেছে।
কোথায় সানন্দে বেটিকে সুলতানের হাতে তুলে দিয়ে বা’প-বেটির জীবন ধন্য করবে, তা না করে মুখের ওপর প্রত্যাখান!
ক্রোধোম্মত্ত সুলতান রাগে গস্ গস্ করতে করতে তার এক হতকুৎসিত সাহায্যকারীকে তলব দিলেন। একেবারে অষ্টাবক্র চেহারা। সোঁজা হয়ে কোনদিনই সে দাঁড়াতে পারে নি। ভাঙাচোরা কিছু হাড়গোড় জোড়া দিয়ে যেন তার চেহারটিকে গড়ে তোলা হয়েছে।

সুলতানের তলব পেয়ে অষ্টাবক্র লোকটি হন্তদস্ত হয়ে ছুটে এসে কুর্নিশ সেরে দুরু দুরু বুকে দাঁড়ল। ভেবেছে, নির্ঘাৎ কোন অমার্জনীয় কসূর করে ফেলেছে। নইলে খোদ সুলতানের দরবারে
তার ডাক পড়বে কেন?

তাকে দেখেই সুলতান বললেন— 'আজ রাত্রেই তোমার শাদী হবে, তৈরী থেকো।'

শাদীর কথা শুনে অষ্টাবক্র লোকটি মূর্ছা যাবার উপক্রম হ'ল। তার বুকের ভেতরে কলিজাটি বার বার মৌচড় খেতে লাগল। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বারকয়েক ঢোক গিলে বলল- 'জাঁহাপনা, আমার রূপ নিয়ে সবাই মষ্করা করে। নসীবের ফের ভেবে মুখবুজে হজম করি সব অপমান নির্যাতন। আজ 'আপনিও—'

সুলতান ধমকের সুরে বললেন 'বাজে কথা রাখ। আমি পরিচারক পরিচারিকাদের বলে দিচ্ছি তোমাকে গোসল করিয়ে শাদীর পোশাকে সাঁজিয়ে দিতে। ঝটপট তৈরি হয়ে নাও, আজ রাত্রেই শাদী হবে।

সুলতানের প্রাসাদে হাসি-আনন্দের তুফান বয়ে চললো। অষ্টাবক্র লোকটির শদী হবে, আনন্দের ব্যাপারই বটে। মেয়েরা তাকে বরবেশে সাজাতে গিয়ে কত রকমেরই যে মস্করায় মেতে উঠল
বলে শেষ করা যাবেন।


এ-পর্যন্ত বলে বেগম শাহরাজাদ থামলেন। ভোরের
পূর্বাভাস লক্ষিত হ'ল। বাদশাহ শরিয়ার প্রফুল্ল চিত্তে বিবির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্দরমহল ত্যাগ করলেন।


একুশতম রক্তনী


বাদশাহ শাহরিয়ার যথা সময়ে অন্দরমহলে বেগমের কাছে এলেন। বেগম শাহরাজাদ কিসসা শুরু করলেন-- জাহাপন, তারপর সে-জিনিয়াহ কি বলল শুনুন– সে-যুবতীর তুল্য রূপ-সৌন্দর্য দুনিয়ার কারোরই নেই, কথাটি কিন্তু বাড়িয়েই বলছ তুমি। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি নে, তোমার সে নুর-অল-দীন এর বেটা হাসন- এর চেয়ে এ-যুবতী বেশী সুন্দরী। না, কিছুতেই তা সম্ভব নয়।'

– আমার কথা বিশ্বাস কর। এক তিলও বাড়িয়ে বলি নি, তার তুল্য সুন্দরী তামাম দুনিয়ায় ঢুঁরে এলেও দ্বিতীয় কাউকেই পাবে না। আমি তার উপযুক্ত একটি পাত্রের খোঁজেই ঢুঁড়ে বেড়াচ্ছি।
তোমার এ যুবকের সঙ্গে কিন্তু চমৎকার মানাবে।  শোন, আমার সাফ কথা। হতচ্ছাড়া ওই অষ্টাবক্র লোকটি ওর জীবন বরবাদ করে দিক এটি আমি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারব না। তুমি যদি রাজি থাক, এই সুন্দর এ যুবকটিকে নিয়ে আমরা কায়রোর পথে উড়ে যাই।' আফ্রিদি বলল। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হাসানকে বয়ে নিয়ে জিনিয়াছ আর আফ্রিদি কায়রোর পথে উড়ে চলল। বাতাসের মত তীব্র গতিতে তারা আকাশ পথে অগ্রসর হতে লাগল।

কায়রো নগরে উজিরের প্রাসাদে শাদীর তোড়জোড় চলেছে। শানাই বাজছে। খানাপিনা চলছে হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে। মৌলভী শাদীর ব্যবস্থাদিতে ব্যস্ত। নচ্ছার অষ্টাবক্র লোকটি দামী পোশাক গায়ে চাপিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছে। দামী অতরের ধুসবু বেরোচ্ছে তার গা থেকে। জিনিয়াহ রাস্তার ধারের একটি আবছা অন্ধকার
বেদীর ওপর ঘুমন্ত হাসান 'কে শুইয়ে দিল। এক সময় তার ঘুম ভাঙলো, চাখ মেলে তাকাল। জায়গাটি কেমন অপরিচিত মনে হলো। সে গোরস্থান তো এটি নয়। তবে? কোন জায়গা? ধীরে ধীরে উঠে বসতেই সমনে দৈত্যাকৃতি দাড়ি-গোঁফহীন একটি লোককে দেখে চমকে উঠল। অতষ্কে জড়োসড়ো হয়ে চিৎকার করার জন্য সে সব মুখ খুলতে যাবে অমনি দৈত্যাকৃতি লোকটি মুখের কাছে অঙুল নিয়ে ইশারায় তাকে থামতে বলল।

দৈত্যকৃতি লোকটি এবার হাসান এর হাতে একটি জলন্ত মোমবাতি ধরিয়ে দিয়ে তাকে নিয়ে এল সুলতানের প্রাসাদে। অনুচ্চ করে বললো। "নিমন্ত্রিত মেহমানদের ভিড়ে মিশে যাও। আমাকে ভয় কেরো না। আমি এক জীন। তোমার মঙ্গলের জন্যই এখানে এখানে নিয়ে এসেছি। এটা কায়রো নগরের সুলতানের মহল। এক সয়তান কুঁজো, অষ্টাবক্র লোকের সঙ্গে উজির সামস-অল-দিন উজির-এর লেড়কির শদী হবার কথা। তারই রোশনাই চলেছে।
গিয়ে দেখ, ফুলের মত ফুটফুটে লেড়কিটি কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। তুমি মেহমানদের ভিড়ে মিশে যাও | হতচ্ছাড়া কুঁজো অষ্টবক্রটি যখন খচ্চরের পিঠে চাপবে তখন তুমি মোমবাতি হাতে তার কাছাকাছি থাকবে। তোমাকে সবাই বরাত ভাববে। বরের ঘনিষ্ঠ লোক ভেবে মান্য করবে তোমাকে।

ভাল সময় দেখরে জননীরা ওড়না পেতে ধরবে তোমার সামনে তুমি কমিজের পকেটে হাত চালিয়ে দেবে। দেখবে হাতে এক মুঠো সোনার মোহর উঠে আসবে। মায়া করবে না। মোহরগুলো তাদের ওড়নায় ছুঁড়ে দেবে। এমন ভাব দেখাবে যেন
একটি মোহর তোমার কাছে খুবই তুচ্ছ বস্তু। যতবার পকেটে হাত ডুকাবে  ততোবারই মুঠে ভরে মোহর উঠে আসবে। পকেট কখনই খালি হবেনা। হামাম থেকে প্রাসাদের দরজা পর্যন্ত খইয়ের মত
মেহর ছিঁটাতে থাকবে। এবার হতচ্ছাড়া ওই অষ্টাবক্রটিকে নিয়ে যাবে সুসজ্জিত একটি ঘরে। একমাএ বর ছাড়া দ্বিতীয় কোন পুরুষ মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু তোমাকে সে-ঘরে যেতেই হবে। একটু উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগ করবে। তবেই সহজে কাজ হাসিল করতে পারবে। কিছু সোনার মোহর ছড়িয়ে দিলেই তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে। কথা কটি বলেই জিনিয়াহ অদৃশ্য হয়ে গেল।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বরবেশে অষ্টাবক্র লোকটি খচ্চরের পিঠে চাপল। তাকে ঘিরে নাঁচতে নাঁচতে চলল একদল নাচনেওয়ালি। গলায় মুক্তোর মলাটি দেখে মনে হচ্ছে যেন বানরের গলায় মুক্তোর মালা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাসান মোমবাতি হাতে এগিয়ে গিয়ে খচরটির লাগাম দখল করে ফেলল।
হাসানের যৌবনভরা রূপ-সৌন্দর্য দেখে সবাই তো একেবারে থ বনে গেল। প্রাসাদের দরজায় যেতেই একদল জনানা ওড়না পেতে ধরলো হাসান-এর সামনে। জিনিয়াহ-র পরামর্শমত সে বার বার
পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুঠো মুঠো সোনার মোহর বের করে তাচ্ছিল্যের ভাব দেখিয়ে ছিটোতে লাগল। যেন এ-ক'টি মোহর তার কাছে খুবই তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপার।

প্রাসাদের অন্দরমহলে যেতেই হাসান অষ্টাবক্র লোকটির হাত ধরে টানতে টানতে সুসজ্জিত একটি ঘরে ঢুকে পড়ল। মুঠো মুঠো মোহর ছিঁটাতে পারলে কোন কাজই অসাধ্য নয়। একদল লেড়কি অষ্টাবক্র লোকটিকে নিয়ে ফুলমালায় সুসজ্জিত একটি মঞ্চের ওপর বসাল। বরবেশে বসে থাকা তার দিকে কারোই নজর নেই।
নয় থেকে নব্বই সব বিবিরা লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে রূপ যৌবনের জোয়ারলাগা হাসান'কে বার বার দেখতে লাগল। চোখ সরাতে চায় না কেউ। একটি মুহূর্তও নষ্ট করতে সবাই নারাজ। যেন
বিরাট লোকসান হয়ে যাবে। সবার মুখেই এক কথা—‘এমন সুন্দর একটি জোয়ান হাতের কাছে রয়েছে অথচ এমন কদাকার অষ্টাবক্রটির হাতে ফুলেরমত সুন্দর তরতাজা মেয়েটাকে তুলে
দিচ্ছে। এর চেয়ে গলায় কলসী বেঁধে পানিতে ফেলে দেওয়া ঢের ভাল ছিল!'

এমন সময় সে-ঘরে বৃদ্ধ মৌলভী আর শাদীর পাত্রী সিৎ-অল-হুসন প্রবেশ করলেন।

একটি সুসজ্জিত আসনে রূপ-সৌন্দর্যের আকর উদ্ভিন্ন যৌবনা পাত্রী হুসনকে বসানো হ’ল। তার রূপের আভা চোখ ঝলসে দেয়।
যেন সারা বিশ্বের সৌন্দর্য রাশি কুড়িয়ে এনে জড়ো করা হয়েছে এর দেহপল্লবটিতে। এর রূপের জৌলুষের কাছে বেহেস্তের হুরী পরীদের সৌন্দর্যও বুঝি হার মানবে। তার উন্নত বক্ষের ওপর
আলতোভাবে দোল খাচ্ছে মখমলের ওড়নাটি। মনে হবে মুকুলিত যৌবন চিন্হ দুটি দুটো ওড়নার আড়াল থেকে যেন বারবার উঁকি দিচ্ছে।
জানাচ্ছে নিজেদের সজীব উপস্থিতি। সেদিকে আচমকা চোখ পড়ায় হাসান-এর বুকের ভেতরের কলিজাটি আছাড়ি পাছাড়ি করতে থাকে। অসংখ্য হিরে জহরৎ খচিত মাথার টিকলিটি যেন
বাতালের চাপে মৃদু মৃধু দোল খাচ্ছে। তার রূপের আভার ব্যবহৃত অলঙ্করাদির সৌন্দর্য স্নান হয়ে গেছে। মন-পাগল-করা এমন রূপ হাসান আগে কোনদিন দেখেনি।

হাসান মঞ্চের পাশে একটি কুরশি পেতে বসে। হুসন নিজের কুরশি ছেড়ে উঠে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে এল। কোন পুরুষের মধ্যে যে এমন রূপের ঝিলিক থাকতে পারে। তা এর আগে
কোনদিন প্রত্যক্ষ করা তো দূরের কথা কারো মুখে শোনেও নি কোনদিন। সে তার বাবার মুখে শুনেছিল, তার চাচার বেটা নাকি এরকম চাঁদের মত সুন্দর দেখতে। কিন্তু এ কোন যুবক। এ-ই তার
চাচার বেটা নয় তো? হুসন-এর হাত দুটো নিসপিস করতে লাগল। এক অভাবনীয় অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসল। অস্থির হয়ে অকস্মাৎ যুবক হাসান-এর কাঁধে নিজের নিটোল হাত দুটো রেখে মিষ্টি-মধুর স্বরে বলে উঠল- “আমার মেহবুব! এ-ই আমার স্বামী, আমার কলিজা।' তার চোখ দুটো ছলছল করতে লাগল। এবার অপেক্ষাকৃত
ভারি গলায় উচ্চারণ করল- 'হায় আল্লা: মনের মত এমন সুন্দর পাত্র হাতের মুঠোয় থাকতে তুমি কিন্তু আমাকে এই বাঁদর মুখো হতচ্ছাড়া অষ্টাবক্রটির হাতে সঁপে দিচ্ছ। আমার ওপর মেহেরবান
কর, মুখ তুলে তাকাও।

এদিকে অষ্টাবক্র লোকটির লম্ফঝম্ফ দেখে কে! সে রাগে গস্ গস্ করতে করতে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল তার কাণ্ড দেখে লেড়কি-বিবিরা তো হেসে গড়াগড়ি যাবার উপক্রম।

প্রথা অনুযায়ী পাত্রী এবার প্রদক্ষিণ-পূর্ব শুরু করলা। সাতবার প্রদক্ষিণ করতে হবে সুপ্রশস্ত ঘরটিকে। হুসন প্রতিবারে ঝলমলে পোশাক পাল্টে এসে ধরটিকে প্রদক্ষিণ করতে লাগল। উপস্থিত
যুবতিরা হুসন'কে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রদক্ষিণের কাজে সাহায্য- সহযোগিতা করতে লাগল। প্রতিবার প্রদক্ষিণ সেরে হাসান-এর মুখোমুখি করে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়াল। নাচনেওয়ালিরা বিচিত্র অঙ্গ
ভঙ্গি করে নাচতে লাগল। বর-কনের মধ্যে কাম প্রবণতা জাগিয়ে তোলাই তাদের নাচের একমাত্র উদ্দেশ্য। কামভাব জাগিয়ে তুলে তাদের উত্তেজিত করার প্রয়াস।

শাদীর মঞ্চে এবার দু’জন বসে। একজন বরবেশধারী কদাকার অষ্টাবত্রুটি আর দ্বিতীয় জন হাসান।

একটু বাদে শাদীর মঞ্চে হাসান'কে নিয়ে যাওয়া হলো। আর অষ্টাবত্রুটি বিষণ্নমুখে সে ঘর থেকে বেরিয়ে পার্শ্বে ঘরে চালে গেল। এবার শাদীর মঞ্চে বসে থাকা হাসান-এর কাছে বিবির বেশে যাওয়া হ'ল। আর সুসজ্জিত হুসন ধীর পায়ে এগিয়ে এল। স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে সোহাগ কামনা করল।
আবেগ মধুর স্বরে বলল— 'মেহবুব আমার !
আমাকে আদর সোহাগে ভরিয়ে তোল। তোমার কোলে তুলে নাও আমাকে। আমার সতের বছরের যৌবনভর দেহপল্লবটি তোমার হাতে সঁপে দিলাম তুমি একে ভোগ কর, আমাকে দাও সম্ভোগসুখ।

যুবক হাসান-এর শিরা-উপশিরার রক্তের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠল। কেবলমাত্র একখানা চাদরে ঢাকা ছিল-হুসন এর যৌবনের জোয়ারলাগা দেহটি। হেঁচকাটানে সেটাকে শরীর থেকে খুলে ফেলে ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘরের মেঝেতে। ব্যস্ত হাতে
নিজের পাতলুনটিকেও খুলে ফেলে দিল। একটি সাদা ও সাধারণ টুপি মাথায় পরে নিল, হুসুন উবু হয়ে বসে তার ইজেরের রশিটি ধরে আচমকা একটি হেঁচকা টান মারলো। চোকের পলকে
সেটি ছিঁড়ে গেল। কিন্তু হুসন-এর পক্ষে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হল না। চিৎ হয়ে মখমলের চাঁদরের ওপর পড়ে গেল। হাসান সরবে হেসে তাকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরল। সে সাঁড়াশির বাঁধনে
আটকা পড়লো হলন। সেও দু'হাতে জাপটে ধরল তার বহু আকাঙ্ক্ষিত পুরুষটির পেশীবহল নগ্ন দেহটিতে। হাসির তুফানে হুসনও যোগ দিল। সে তুফানে তলিয়ে গেল উত্তাল-উদ্দাম দুই নারী-পুরুষ। পুরুষের বাহুর সকাম অকর্মণ যে এত মধুর হুসন আগে কখনও বোঝে নি। নিজের কুসুম কোমল-মাংসপিণ্ডদ্বয়কে তার বুকের সঙ্গে মিশিয়ে দিল। ক্রমে তার দেহ মন অসাড় হয়ে পড়তে লাগল। অতিশয় আনন্দানুভূতি যে মানুষের মনে এমন করে রোমাঞ্চের সঞ্চার করতে পারে তা সে এই প্রথম বুঝল। ব্যস, তারপরই তারা উভয়েই যেন কোন আনন্দ-সাগরের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ পর তারা ক্লান্ত আচ্চন্ন অথচ প্রসনঞ্চিত্ত পুরু মকমলের চাদরটির উপর গা এলিয়ে দিল। উভয়ের শাসক্রিয়া ঘন ঘন চলতে লগলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। নীরবে সদ্য লব্ধ সুখটুকু উপলব্ধি করতে লাগলো। অখন্ড নীরবত ভঙ্গ করে হাসন নিশ্চল-নিথর পাথরের মূর্তির মত হুসন-এর সরু কটি দেশে আলতো করে একটি হাত রেখে বল্‌ল— 'আমি নিঃসন্দেহ, তোমার জীবনে আমিই প্রথম পুরুষ।

হুসন জীবনের প্রথম পুলকানন্দের মাধ্যমেই অন্তঃসত্ত্বা হ'ল। সে মধুযামিনীতে তারা পনেরবার সঙ্গম-সুখ ভোগ করল। তারপরই তাদের চোখগুলো ক্রমে বিশ্বাসঘাতকতা করতে শুরু
করল। ঘুমে বারবার জড়িয়ে আাগতে লাগল চোখের পাতা। আর নয়। আর সম্ভব নয়। মানুষের শরীর তো বটে। এত ধকল সইবে কেন ? তারা ঘুমে ঢলে পড়ল। গভীর ঘুমে এক সময় আচ্ছন্ন হয়ে পড়াল।

জিনি এগিয়ে এল। জিনিয়াহ্-র সঙ্গে দেখা। তাদের সুখনিদ্রা দেখছে। জিনি অনুচ্চকণ্ঠে বললো আর দেরী নয়, একটু বাদেই ভোবের আলো ফুটে উঠবে। যুবকটিকে গোরস্থানের যে-জায়গা
থেকে তুলে এনেছিলাম সেখানেই আবার রেখে আসতে হবে।'

জিনিয়াহ ঘুমন্ত হাসান ’কে নিজের পিঠে তুলে নিয়ে শূনো উঠে গেল পাখার ঝাপটায় বাতাস কেটে এগিয়ে চলল বাঞ্ছিত সে--- গেরস্থানের দিকে। জিনি উড়তে থাকে পাশাপাশি কাছাকাছি।
হঠাৎ জিনি-র মধ্যে কামভাব জাগ্রত হয়। জিনিয়া-র ওপর বলৎকার করার জন্য উদাত্ত হয়। পিঠে তার ঘুমন্ত যুবক হাসান। তাকে তো আর ফেলে দিয়ে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। অন্য
সময় হলে সে তার বাঞ্ছা পুরণে বাধা দিত না। কিন্তু জিনি-র কাম প্রবৃত্তি একবার জাগ্রত হলে আর রক্ষা নাই। প্রলয় কাণ্ড বাঁধিয়ে দেয় ভয়াল-ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। কিন্তু আল্লাহ তো আর অন্ধ নন।
তিনিই পরিস্থিতি সঙ্গীন দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। হঠাৎ দেখা গেল জিনি- দেহটি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। তারপরই অতিকায় জ্বলন্ত দেহটি মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল।
দাউ দাউ হাউ হাউ করে জ্বলতে লাগল সিরিয়ার অন্তর্গত দামাস্কাস নগরীর এক পথের ধারে। জিনিয়াহও নামল সেখানে। পিঠের ঘুমন্ত যুবকটিকে পথের ধারে শুইয়ে দিল। ব্যস, একেবারে উধাও হয়ে গেল সে। একেই বলে বরাত। হাসান একা পড়ে রইল।

সকাল হলে নগরের দ্বার খুলে দেওয়া হ’ল। শুরু হ’ল মানুষের যাতায়াত। সবাই বিস্ময়ভরা চোখে অনিন্দ্য সুন্দর যুবক হাসান-এর দেহকান্তি দেকে যারপর নাই মুগ্ধ হ'ল। গায়ে কেবল রাত্রের পোশাক। আর মাথায় অতিসাধারণ একটি টুপি।

এক সময় হাসান-এর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে তাকাল। সম্পুর্ণ অজানা-অচেনা এক দেশের পথের ধারে সে শুয়ে। আর তাকে ঘিরে রয়েছে একদল কৌতূহলী নগরবাসী। সে চিৎকার করে বলে উঠলো- আমি কোথায়? এ কোন দেশ? আমি এখন কোথায় আছি? তোমরাই বা কারা?

পথচারীদের একজন বলল – তোমাকে আমরা এখানে, এভাবেই পড়ে থাকতে দেখেছি। এ নগরের নাম দামাস্কাস। তুমি এখানে এলেই বা কি করে? কে তুমি? থাক কোথায় ?

—'আমিও তো একই কথা ভাবছি। কাল রাতে আমি তো কায়রো নগরে ছিলাম! আর এখন দামাস্কাসে??

হাসান-এর কথায় পথচারীরা হো হো করে হেসে উঠল। হাসবার মতো কথাই বটে। কায়রো আর দামাস্কাসের মধ্যেকার ফারাকটুকুর কথা ভেবেই তাদের হাসির উদ্রেক হয়েছে। কেউ কেউ তাকে বদ্ধ পাগল ভেবে রসিকতা শুরু করে দিল।

এক প্রবীণ এগিয়ে এসে বলল – বাপু সত্যি করে বল তো ব্যাপারটি কি? তোমার কথাবার্তা আমাদের মনে কেমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।'

—'গত সন্ধ্যায় আমি বসরাহতে ছিলাম। মাঝরাত্রে ছিলাম কায়রো নগরে। আর এখন দেখছি দামাস্কাসের রাস্তার ধারে পড়ে রয়েছি।' হাসান কথা বলতে বলতে উঠে হাঁটতে লাগল। তার পিছন পিছন চলল একদল ছেলে বিভিন্ন কৌশলে রঙ্গ-তামাশা করতে করতে।

এদিকে কায়রো নগরের প্রাসাদে সদ্য বিবাহিত। রূপসী-যুবতী সিৎ-অল-হুসনর ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখে তার স্বামী হাসান অনুপস্থিত। উদ্ভ্রান্তের মত ঘরের চারদিকে সে তাকাতে পগল। না, সে ছাড়া ঘরে দ্বিতীয় কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। তার দু'চোখ
বেয়ে পানির ধারা নেমে এল।

সামস্-অল-দীন এসব ব্যাপার কিছুই জানে না। সে সারারাতি নিজের প্রাসাদের ছোট্ট একটি ঘরে কেঁদে কেঁদে কাটিয়েছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, সুলতান ক্রোধের বশবর্তী হয়ে সে হতচ্ছাড়া অষ্টাবক্র লোকটর সঙ্গেই তার একমাত্র পরমা সুন্দরী, আদরের দুলালী হুসন-এর বিয়ে দিয়ে গায়ের ঝালা মিটিয়েছেন। তাই সে বেটির কথা বিশ্বাসই করতে চায় না। বিশ্বাস করার মত কথাও নয় যে, এখন একটি গাঁজাখুরি গল্পকে সত্যি বলে মেনে নেবে। মনে ধন্ধ জমাট বাঁধল।

সামস্-অল-দীন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল—'কী সব বাজে বকছিস বেটি। তা-ই যদি হয় তবে তোর সে খুবসুরং বরটি গেল কোথায়?'

এমন সময় প্রসাদের বাইরের বাগিচায় পাখির কলধ্বনি শোনা গেল। ভোরের পূর্বাভাস। বেগম শাহরাজাদ কিস্সা বন্ধ করলেন।


বহিশতম রজনী

বাদশাহ শারিয়ার অন্দরমহলে এলেন। বেগম শাহরাজাদ তাঁর কিস্সার পরের অংশটুকু শুরু করতে গিয়ে বলেন—
'জাঁহাপনা, বৃদ্ধ উজির তাঁর কিস্সা ব'লে চলেছেন 'আর খলিফা হারুণ-অল্-রসিদ মন্ত্রমুগ্ধের মত একাগ্রচিত্তে শুনছেন। সদ্য বিবাহিতা হুসন তার
স্বামীর খোঁজে ছোট-ঘরের দিকে এগোতেই হতচ্ছাড়া অষ্টাবক্রের মুখোমুখি হ'ল। অষ্টাবকের চোখে মুখে ভীতির ছাপ ফুটে উঠল। সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল। তার মনে হল হতচ্ছাড়া জিনি বুঝি আসছে। উজিরের সুন্দরী লেড়কিকে তো পেলই না। তার ওপর সারা রাত্রি যে অত্যাচার তাকে সইতে হয়েছে তা সারা জীবন মনে থাকবে। এ-জন্মের মত শদীর সাধ তার মিটে গেছে।

হুসন স্বামীকে না পেয়ে কোন কথা না বলে পিছন ফিরে হাটতে লাগল। এমন সময় সেখানে এল উজির সামস্-আল-দীন। থাকে দেখেই অষ্টাবক্র কাঁপতে কাঁপতে করজোড়ে ব'লে উঠল, জিনি
মহাশর, দোহাই তোমার, আর আমাকে শক্তি দিও না কথা দিচ্ছি, আর কোনদিন ভুলেও বিয়ের আসরমুখো হ’ব না।

সামস্ আল-দীন ধমকের সুরে বল- 'চুপ কর হারামজাদা! জিনিটিনি কাউকে আমি চিনি না। আমি সুলতানের উজির।' অষ্টাবক্র লোকটি এবার উজিরকে চিনতে পেরে তড়পানি শুরু করে দিল—'ও আপনি? আমি আরও ভাবলাম বুঝি সেই জিনি।
চলে যান এখান থেকে। আপনি আর সুলতান একজোট হয়ে আমাকে মিছিমিছি এমন হেনস্থা করেছেন। আমার জীবনটিই একেবারে বরবাদ করে দিয়েছেন। বেশ তো ছিলাম। শাদীর লোভ
দেখিয়ে— পালান এখান থেকে। জিনি আফ্রিদি এসে পড়লে মজা কাকে বলে আপনাকেও টের পাইয়ে দেবে।

উজির বলল –'এসো, এদিকে এসে।'

--'ক্ষেপেছেন মশাই! জিনি আফ্রিদির আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত আমি এক পা-ও এখান থেকে নড়ছি না। সারারাত্রি ধরে যে শাস্তি ভোগ করেছি ভাবলে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। রোদ
না ওঠা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকব।'

এবার উজির তার কাছে জানতে চাইল—'আফ্রিদি তাকে কিভাবে হেনা করেছে, কি কি বলেছে।'
অষ্ট্রাবক্রা তাকে সারা রাত্রির ঘটনা এক এক করে সবই খুলে বলল।

উজির এবার পুবদিককার একটি জানালা খুলে দিয়ে বলল—– 'শোন, সকাল হয়ে গেছে অনেক আগেই। ওই দেখ, ঝলমলে রোদ। এবার তুমি এখান থেকে পালাও।'

ব্যস্, অষ্টাবক্র এবার এক দৌড়ে বাইরে চলে গেল। হাঁপাতে  হাঁপাতে একেবারে সুলতানের সামনে এসে দাঁড়াল। সুলতানকে তার সারারাত্রির দুর্ভোগের কথা সবিস্তারে বললো।

আবার এদিকে উজির সামস্-অল-দীন তার বেটি সিৎ-অল-হুসন’র কাছে ফিরে এল। বলল—'বেটি, সব কিছু শুনে আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। আমি কি তবে পাগলই হয়ে গেলাম। এমন তাজ্জব ব্যাপার তো বাপের জন্মে কোনদিন শুনিনি। আসল
ব্যাপারটি কি খুলে বল তো শুনি।'

--আব্বাাজান, এ আবার খুলে বলার কি আছে? সে-সুদর্শন যুকটি গত রাত্রে সবারই মন কেড়ে নিয়েছিল। তার সঙ্গেই আমি গতরাত্রি কাটিয়েছি। তুমি আমার আব্বাজান, বলতে শরম লাগছে,
তবু বলছি, গতরাত্রেই আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছি।' এবার প্রমাণস্বরূপ তার স্বামীর বাদশাহী টুপি, পাতলুন আর মোহরের থলি প্রভৃতি দেখিয়ে বলল
— 'আব্বাজান, সবকিছুই তার।

উজির বদশাহী টুপিটি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন—'বেটি, এ টুপি তো বসরাহর আমিররা ব্যবহার করে বলে জানি।

এবার পাতলুনটি হাতে তুলে নিয়ে ব্যস্ততার সঙ্গে তাঁর কোমরের সেলাইটি খুলে ফেললেন। একটি তুলোট কাগজ বেরিয়ে এল। কাগজটির ভাজ খুলেই উজির সামস্-অল-দীন সোল্লাসে
চিৎকার করে উঠলেন— বেটি, এই দেখ আমার নুর-অল-দীন-এর স্বাক্ষর যুক্ত দলিল।'

উজির টাকার থলেটিতে এক হাজার সোনার মোহর দেখতে পেল। সে বণিকের দেওয়া স্বর্ণমুদ্রা এগুলো। সে জাহাজ ক্রয়ের দলিল এটি এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে হাসান-অল-দীন-এর
কাছ থেকে একটি জাহাজ ক্রয় করেছে, বণিকটি। সবকিছু প্রমাণ পেয়ে ও দলিলটি পড়ে সামস্ অল দীন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবার জোগাড় হলেন। কথা বলতে বলতে সে হঠাৎ বুক চাপড়ে
কান্না জুড়ে দিল— 'ভাইয়া, আমার ওপর অভিমান করে তুমি বিবাগী হয়ে ভিনদেশে পাড়ি দিয়েছিলে। জন্মের মত চলে গেলে। আজ তুমি আমাদের সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে!’ এবার লেড়কির
দিকে ফিরে বললেন— 'বেটি হাসান বদর-অল-দীন তোমার চাচাতো ভাইয়া। ওর সঙ্গেই তোমার শাদী হওয়ার কথা ছিল। সামান্য- খুবই তুচ্ছ একটি ব্যাপার নিয়ে আমাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছিল। ব্যস তাতেই আমার ভাইয়া দেশ ছেড়ে বিবাগী হয়ে
গেল। যাক বেটি, আঠারো বছর পর আমার বাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ার কী যে আনন্দ হচ্ছে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমি এক হাজার সোনার মোহর এর কাছে বিয়ের যৌতুক হিসেবে চেয়েছিলাম,
তাই সে রেখে গেছে।'

উজির আর বৃথা কালক্ষয় না করে ব্যস্ত পায়ে সুলতানের দরবারে উপস্থিত হ'ল। তুলেটি কাগজটি তার হাতে দেয়। সবকিছু সবিস্তাবে বর্ণনা করে। সবকিছু শুনে সুলতান একে আল্লাহ্ র লীলা
বলেই মনে করেন।

উজির আবার তেমনি ব্যস্ততার সঙ্গে লেড়কি হুসন-এর কাছে ফিরে আসেন। হাসান এখনও ফেরে নি। বেলা বেড়ে চলে। কিন্তু তবু সে না ফেরায় খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।

হুসন সবিনয়ে বলল– আব্বাজী, সে ঘর ছেড়ে কি করে যে বেরলো তাই তো আমি ভাবছি। আমি ঘুমে অচৈতন্য ছিলাম। দরজা জানলা সবই বন্ধ। অথচ ঘুম থেকে জেগে দেখি, সে ঘরে নেই। আশ্চর্য ব্যাপার তো।'


বেগম শাহরাজাদ ভোরের পূর্বাভাস পেয়ে তাঁর কিস্সা বন্ধ করলেন। খানিক বাদে বাদশাহ শারিয়ার দরবার কক্ষের উদ্দেশে পা বাড়ালেন!


ভেইশতম রজনী

বাদশাহ শাহরিয়ার অন্দরমহলে বেগম শাহরাজাদ-এর কাছে এসে তিনি আবার কিসসা শুরু করলেন—
'জাঁহাপনা, আশা করি আপনার অবশ্যই খেয়াল আছে উজির জাফর, খলিফা হারুণ-অল-
রসিদ কে গল্প শেনচ্ছেন।’

উজির সামস্-অল-দীন নিঃসন্দেহ হ’ল যে, তার ভ্রাতুষ্পুত্রই তার বেটি হুসনকে শাদী করেছে। শাদীর রাত্রেই তার জামাতা উধাও হয়ে গেছে। আর কবে যে সে ফিরবে তা একমাত্র আল্লাতাল্লাই বলতে পারেন। শাদীর বাসর সজ্জা ভেঙে ফেলার
আগে তার খুঁটিনাটি সব বিবরণ উজির একটি কাগজে লিখে রাখল।
বলা তো যায় না, ভবিষ্যতে এটি কোন কাজে হয়ত লেগে গেলেও যেতে পারে।

এদিকে উজিরের সদ্য বিবাহিতা লেড়কি যা অনুমান করেছিল তা-ই সত্যি হ'ল। শাদীর প্রথম রাত্রে তারা যে সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছিল
তাতেই সে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। নয় মাস পরে ফুটফুটে এক লেড়কা প্রসব করল সে। আব্বাজীর মত অপরূপ। এক ঝলক তাকালেই চোখ ঝলসে দেয়। নবজাতকের নামকরণ করা হ'– আজীব।
আজীর শব্দের অর্থ চমৎকার! সাত বছর বয়সে তাকে কায়রোর এক বিখ্যাত মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেওয়া হ'ল। পাঁচ বছর বাদে অর্থাৎ বারো বছর বয়সে সে মাদ্রাসার পাঠাভ্যাস সাঙ্গ করে।

এ-মাদ্রাসায় পাঠাভ্যাসকালে একদিন আজীব-এর সঙ্গে তার সহপাঠীদের বচসা হয়। শেষে তা তুমুল ঝগড়ার রূপ নেয়। সবাই জোট বেঁধে মৌলভীর শরণাপন্ন হয়।
মৌলভী তাদের একটি ফন্দি শিখিয়ে দেন।

মৌলভীর ফন্দিটিকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে আজীব-এর সহপাঠীদের একজন বলে, আজ আমরা ভারি মজার একটি খেলা করতে চাই। তোমরা যদি রাজি থাক তো বল, খেলাটি শুরু করি। ছাত্রটির কথায় সবাই একবাক্যে সম্মতি জানাল। আজীবও সোল্লাসে সম্মতি দিল।

শুরু হ’ল সে-মজার খেলাটি। এক ছাত্র বলল – 'তোমরা জানো আমার নাম নবী। আমার আব্বার নাম ঈজ-অল-দীন আর আমার আম্মার নাম নবীয়াহ।'

অন্য আর এক ছাত্র বলল – আমার নাম নাজীব। আমার আব্বার নাম মুস্তাফা আর আম্মার নাম জামিনাহ।

এবার এল আজীব-এর পালা। সে সগর্বে নিজের নাম বলতে গিয়ে বলল আজীব। আম্মার নাম বলল সিৎ-অল-হুসন। আর আব্বার নাম বলল মিশরের উজির সামস্-অল-দীন।

তার কথা শেষ হওয়া মাত্র সহপাঠীরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল ‘ধ্যুৎ। তিনি তোর আব্বা কি করে হবেন রে! যত্তসব তাপ্পিমারা কথা! তিনি তো তোর আম্মার আব্বাজী। তুই আব্বার নাম জানিস
না। তোর সঙ্গে আজ থেকে আমাদের মেলকুদ বন্ধ।

এমন সময় মৌলভী এসে বললেন— 'বেটা, ওদের কথাই ঠিক বটে। উজির তোমার আব্বা নন। তোমার দাদা মশাই হন। তোমার আব্বা যে কে তা আমাদেরও সঠিক জানা নেই। এক অদ্ভুত দর্শন
অষ্টাবক্র লোকের সঙ্গে তোমার আম্মার শাদী হয়েছিল, সবাই জানে। কিন্তু সে নাকি আদৌ তোমার আম্মার সঙ্গে সহবাস করেনি। সে সবার কাছে প্রচার করে বেড়াতে লাগল, এক জীন এসে
নাকি তোমার আম্মার গর্ভে সন্তান পয়দা করে গিয়েছিল। অতএব তোমার দোস্তরা যা বসেছে, সবই সত্য। এরকম লেড়কাকে আমরা 'জারজ' বলি। তাই তোমাকে আমি একটি মাত্রই উপদেশ দিচ্ছি, তোমার অহঙ্কার একটু কমাও বেটা। স্বভাব-চরিত্র একটু নম্র কর।

মাদ্রাসা-ছুটি হলে আজীব সোজা বাড়ি এসে তার আম্মাকে সরাসরি প্রশ্ন করল—'আমার আব্বা কে? কি নাম তার ? কোথায় থাকেন তিনি?

—'উজির। তোমার বাবা তো উজির।
—-ঝুট! বাজে কথা! উজির শমস-জল-দীন তো আমার আব্বা নন। তিনি তো তোমার আব্বা। আমার আব্বার নাম কি?

উপায়ান্তর না দেখে। সিৎ-এল মুখে কলুপ এঁটে বসে থাকে। কিন্তু কি’ই বা জবাব দেবে? আজীব এবার রীতিমত ক্ষেপে গিয়ে বলল- 'তাড়াতাড়ি বল, নইলে এক্ষুণি তরবারি দিয়ে আমার গুলা
কেটে ফেলব, বলে দিচ্ছি।'

চমকে উঠে সিং-অল বলল—'বলছি শোন বেটা, আমার শাদীর রাত্রে তার সঙ্গে আমার প্রথম ও শেষ দেখা। সে অপরূপের রূপের আগুনে আমার দেহ মন, আমার সব শঙ্কা ও সঞ্চয় সবই জ্বলে পুড়ে হাই হয়ে যায়। তাকে আমার মন-প্রাণ-দেহ সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছি। আমার সবকিছু নিয়ে সে উধাও হয়ে যায়। তারপর অনেক শীত-বসন্ত একে একে পার হয়ে গেছে। তবু সে ফেরেনি। আজও তার পথচেত্রে দিন গুণছি।'

কথা বলতে বলতে সিৎ-অল ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। বালক আজীবও তার আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।

উজিরের কাছে খবর যায়, আজীব তার পিতৃ-পরিচয় জানার জন্য ব্যাকুল।

উড়ির খবর পেয়ে বাস্ত হয়ে লেড়কি হুসন-র ঘরে ছুটে আসে৷ চোক মুছতে মুছতে সিৎ-অস বলে— আব্বাজী, বেটা আমার কাছে তার পিতৃ পরিচয়, বংশ-পরিচয় জানতে চায়। তার মাদ্রাসার
দোস্তরা নান্তি এ নিয়ে অনেক মন্দকথা তাকে বলেছে। তাই হয়ত মনে ব্যাথা পেয়েছে, উদ্বেল হয়ে উঠেছে।'

উজির এবার একমাত্র নাতিকে কোলে বসিয়ে এক এক করে বলতে লাগল—তার ছোট ভাইয়া নূর-অল-দীন কেন বিবাগী হয়ে দেশত্যাগী হয়েছে। বসরাহ-তে গিয়ে সেখানকার উজিরের লেড়কিকে শাদী করে ঘর সংসার পাতে। তাদের সন্তান হাসান।
তারপরই নুর বেহেস্তে চলে যায়। তোমার আম্মার শাদীর রাতে তার আকস্মিক ও অলৌকিক আবির্ভাব ঘটে। ভোর হবার আগেই আবার একই অলৌকিক উপায়ে অন্তর্ধান করে। ব্যাপারটি আজও রহস্যের আড়ালেই রয়ে যায়। মুহূর্তকাল নীরবে ভেবে এবার বলল – চল আমরা বসরাহ-তে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি। এখানে আমাদের কাছে নিয়ে আসি। আমরা সামনে গিয়ে দাঁড়ালে
আর অপত্তি করতে পারবে না।'

উক্তির দুপুরের কিছু আগে দরবারে সুলতানের সঙ্গে দেখা করল। সব বৃত্তান্ত তাঁর কাছে নিবেদন করল।

সুলতান খুশি হয়ে বললেন—“উজির তোমাকে বরং কিছুদিনের জন্য ছুটি দিচ্ছি, বসরাহ-তে গিয়ে খোঁজ করে দেখ। আমার বিশ্বাস, বসরাহ বা তার কাছাকাছি কোন না কোন জায়গায় তার দেখা
পাবেই।'

উজির সুলতানের পরামর্শ ও নিজের ঐকান্তিক আগ্রহে আজীব ও কয়েজন নফরকে নিয়ে বসরাহ-র পথে পা বাড়াল। পৌঁছল দামাস্কাস নগরে, দামাস্কাস সুপ্রাচীন ও সুপ্রসিদ্ধ নগর। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ও সুন্দর মসজিদ এখানেই অবস্থিত।

সবাই যখন মসজিদ দেখে বেড়াচ্ছে তখন আজীব উজিরের ভূত সাইদকে নিয়ে নগর দেখতে বেরলো। বিপদ হ’ল এখানেই। পথচারীরা ভিড় করে সুদর্শন আজীব'কে দেখতে লাগল। রূপ-
সৌন্দর্যের এমন সমাবেশ কোন পুরুষের দেহে সচরাচর দেখা যায় না। ক্রমে মহিলারাও দরজা ও জানালা খুলে তাকে দেখে জীবন ধন্য করতে উৎসাহী হয়ে উঠল। সে এক অদ্ভূত কান্ড।

কৌতূহলী জনতার তাড়নায় অতিষ্ট হয়ে সাইদ উপায়ান্তর না দেকে আজীবকে নিয়ে একটি মিঠাইয়ের দোকানে গিয়ে মাথা গুজল। এ-দোকানেই একদিন হাসান-বদর-অল-দীন পথের বদমায়েশ যুবকদের তাড়া খেয়ে ঢুকে পড়েছিল। আর প্রায় বারো বছর ধরে এ-দোকানেই আশ্রয় নিয়ে সে বাস করছে। তিন বছর
আগে দোকানি সংসারের মায়স কাটিয়ে বেহেস্তে চলে গেছে। এখন হাসানই দোকানের মালিক বলে গেছে। বেদনার হালুয়া এ দোকানের মিঠাইয়ের মধ্যে সবথেকে নাম করা খাবার। তামাম দামাস্কাস নগর টুড়ে এলেও এমন সুন্দর হালুয়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না। হাসান-এর তৈরীর কৌশল তার মায়ের কাছ থেকে শিখেছিল।

আজীব অকস্মাৎ দোকানের ভেতর ঢুকে গেলে হাসান অবাক বিস্ময়ে তাকে দেখতে লাগল। চেয়ে রইল অপলক চোখে। প্রথম দর্শনেই কেমন যেন ভালবেসে ফেলল ছেলেটিকে। এক সময়
বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে— 'বেটা, তোমাকে কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকছে। কোথায় তোমাকে দেখেছি, বল তো? আমার নিজের হাতে তৈরী একটু মিঠাই তোমাকে খাওয়াতে চাই, আপত্তি
নেই তো?

আজীব তার সঙ্গী সাইদ-এর দিকে তাকিয়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল—‘লোকটিকে খুবই দুঃখী মনে হচ্ছে। কিসের যেন একটি অভাব তার ভেতরটিকে মরুভূমি করে দিয়েছে। একদিন হয়ত আমারই মত তার একটি লেড়কা ছিল। হয়ত সে দুনিয়া ছেড়ে
চলে গেছে। আমি আমার আব্বার খোঁজে ঢঁড়ে বেড়াচ্ছি, আর অভাগা লোকটি হয়ত তার লেড়কাকে ফিরে পেতে ব্যাকুল।' কথা বলতে বলতে সে নিঠাইয়ের জন্য হাত বাড়াল।

সাইদ সঙ্গে সঙ্গে তার হাতটি টেনে নিয়ে বলল –'আরে করছ কি? উজির সাহেব শুনলে গোসা করবেন যে! আমার গর্দান নিয়ে ছাড়বেন তুমি উজিরের বেটা। তোমার কত ইজ্জত। এরকম একটি দোকানে দাঁড়িয়ে মিঠাই খেলে তোমার ইজ্জত থাকবে কেথায়, শুনি?

হাসান এবার ছল ছল চোখে ব'লে ওঠেলো—তোমার মত বিশ্বস্ত ও অনুরক্ত নফর তামাম দুনিয়া ঢুঁড়ে এলেও দ্বিতীয়টি আর মিলবে না। তাই তো নিজের মনিবের মনির ভুল্য অন্তরের ধনকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে তিনি নিশ্চিত হতে পেরেছেন।'

দাওয়াইয়ে কাজ হয়েছে। নফর সাইদ -এর তিড়িক্কি মেজাজ কিছুটা শস্ত হ'ল। সে আজীবকে দিয়ে দোকানের বাঁশের মাঁচাটায় বসল।
হাসান প্রফুল্লচিত্তে কিছু গরম বেদনার হালুরা এনে আজীব এর হাতে দিল। আজীব আর সাইদ পরম তৃপ্তিতে মুখরোচক হালুয়াটুকু আহার করল।

এদিকে হাসান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আজীব'কে দেখতে লাগল। যত দেখছে ততই যেন ওজ্ঞাতকুলশীল বালকটির ওপর তার মায়া বেড়ে যাচ্ছে।

হাসন আজীব-এর পাশে, একেবারে গা-ঘেঁষে বসল। তার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে সস্নেহে বলল—'বাছা, তোমার কথা শোনার জন্য আমার মন খুবই চঞ্চল হয়ে উঠেছে। যা হোক কিছু বলে আমার ভৌতূহল নিবৃত্ত কর।'

আজীব চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল – আমার কথা আর কিই বা শুনবে? আমি বড়ই দুঃখী, আমার বাবা আজ কোথায়, কিভাবে আছেন কিছুই আমি জানি না। আম্মা আর দাদু দেশ-দেশস্তরে
খোঁজে ঢুঁড়ে বেড়াচ্ছেন। হয়ত খুঁজতে খুঁজতে তামাম দুনিয়া ঢুঁড়ে ফিরতে হবে থাকে। খোদাতালার মর্জি নসীবে কি আছে তিনিই জানেন' কথাটি বলেই বালক আজীব চাপা দীর্ঘশ্বাস
ফেলল।

হাসান তার কথায় ব্যথিত মর্মাহত হ'ল বটে কিন্তু আজীব যে তারই লেড়কা ধারণাও করতে পারল না।

সাঈদ এবার হাসান এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আজীব-এর হাত ধরে পথে নামল। কয়েক পা গিয়েই থমকে দাঁড়াল। দেখে, হাসান তাদের পিছন পিছন আসছে। ভাবল, লোকটির মাথায় কোন
কদমতলা নেই তো? নইলে পিছু নেবে কেন?

হাসান্ মুচকি হেসে বলল—'নগরের বাইরে একটু জরুরী কাজ রয়েছে, তাই ভাবলাম, তোমাদের সঙ্গেই চলে যাই। কথা বলতে বলতে পথ পাড়ি দেওয়া যাবে।

সাইদ এবার একটু বেশ উত্তেজিত কণ্ঠেই বলল— “তুমি কি আমাদের তিষ্ঠোতে দেবে না? একটু হালুয়া খাইয়ে রাজ্যি জয় করে নিয়েছ মনে হচ্ছে!'

হাসান তার আকস্মিক কথাটিতে ফুটা বেলুনের মত চিপসে গেল। কণ্ঠস্বরে উষ্মা প্রকাশ করে বলল— এমন বাজে কথা বলছ কেন? পথ তো আর কারো একার নয়।

আজীব তাকে সমর্থন করে বলল- 'ঠিকই তো, খোদার তৈরী পথে সব মুসলমানেরই সমান অধিকার। আমাদের তাবুর দিকে গেলে না হয় আচ্ছা করে সাজা দিয়ে দেওয়া যেত।'

কিছুদূর গিয়ে তারা হাসবার-এর পথ ধরল। হাসবার-এ তাদের তাঁবু ফেলা হয়েছে। হাসানও মোড় ঘুরল তাদের সঙ্গেই।

আজীব এবার ভাবল, লোকটির মতলব নির্ঘাৎ ভাল নয়। কোন ধান্দায় পিছু নিয়েছে। সে একটি পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল। সেটি হাসান-এর কপালে আঘাত হানল। খুন বেরিয়ে এল। সাইদ আজীব-এর হাত ধরে এক দৌড়ে তাঁবুতে হাজির হয়ে গেল।

হাসান নিজের বোকামির জন্য অনুতপ্ত হ’ল। দোকান বন্ধ করে তাদের পিছু নেওয়াটাই কাল হয়েছে। ফিরে এসে হতাশা জর্জরিতভমনে আবার সে দোকানে বসল।

উজির সামস-আল-দীন দু'দিন দামাস্কাস নগরীতে কাটিয়ে তাঁবু গোটাবার নির্দেশ দিলেন। পথে ছোট-বড় ও অখ্যাত-অবজ্ঞাত বহ নগরী পেরিয়ে তারা এক সময় বসরাহতে হাজির হ'ল।

বসরাহতে সুলতানের দরবারে মেহমান হয়ে উঠল। সুলতানকে কুর্নিশ করে বলল— 'জাঁহাপনা, আমি আপনার প্রাক্তন উজির নূর-অল-দীন-এর বড় ভাই, সম্প্রতি মিশরের সুলতাদের উজিরের
পদে বহাল রয়েছি।'

সুলতান দীর্ঘস্থাস ফেলে বললেন—'আমার নসীব মন্দ তাই নূর-অল-দীন-এর মত একজন সাচ্চা উজিরকে হারাতে হয়েছে, আহা! বড় ভাল লোক ছিল। আর তার বেটা হাসান সে-ও ছিল আমার চোখের মনির মতই অদরণীয়। আল্লাহর বিচিত্র মর্জি। সেও আজ আমাকে ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছে। তবে নূর-অল-দীন-এর বিধবা বিবি এখানে এ-বসরাহ নগরেই রয়ে গেছে। বেটা যদি
কোনদিন ফিরে আসে সে আশায় আশায় দিন গুণে চলেছে।

সুখতানের মুখে নূর-এর বিবির কথা শুনে সামস-অল-দীন তার সঙ্গে একবরটি মোলাকাৎ করার জন্য ব্যাগ্র হয়ে উঠল, সুলতান তাকে সেখানে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করলেন সামস-অল-দীন নূর-এর প্রাসাদ তুল্য সুবিশাল ইমারতে উপস্থিত হ'ল। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করল। সামনেই একটি ঘরের বন্ধ দরজায় কড়া নাড়ল। এক
রূপসী দরজা খুলে, ওড়নায় মুখ ঢেকে দরজার এক ধারে নতমুখে দাঁড়িয়ে রইল। হাসন নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে দরজা বন্ধ করে সে শেকজ্বালায় জর্জরিত হচ্ছে। ঘরের কেন্দ্রস্থলে একটি তাজিয়া সাজিয়ে রেখেছে। হাসন আর ইহজগতে নেই এ-বিশ্বাসের বশবর্তিনী হয়েই সে এর আয়োজন করেছে। তার স্মারক হিসাবেই
এটি নির্মাণের উদ্দেশ। তাজিয়াটির সামনে বসে সে অহর্নিশি চোখের পানি ফেলে আর বলে- 'তাজিয়া, সে কি ইহজগৎ ত্যাগ করে তোমার কোলেই চিরশান্তি লাভ করেছে? তাকে কি আর কোনদিন আমার চামড়ার চোখ দুটো দিয়ে দেখতে পাব না?
সে এক নওজোয়ান। শাদীর রাত্রের সাজে সজ্জিত হয়ে সে তো আসমানের তারার মেলায় তোমার কোলে শুয়েই বিশ্রাম করছে।

নূর-এর স্ত্রী, হাসান-এর মায়ের মুখে এরকম বিলাপ শুনে সামস-অফ-দীন দরজা থেকে এক পা-ও নড়তে পারল না। স্থবিরের মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।

এক সময় হাসান-এর মা চোখ মুছতে মুছতে আবার দরজার কাছে এল। অগস্তক সামস-আল-দীন নিজের পরিচয় দিল, হাসান-
এর মা তাকে অভ্যর্থন করে ঘরের ভেতরে নিয়ে কুরশি এগিয়ে দিল বসার জন্য।

কুরশিটি টেনে বসে সে সব ঘটনা খুলে বলল – তার বেটির শাদীর রাত্রে কিভাবে সুকৌশলে ঘরে ঢোকে, কিভাবে বেটির সঙ্গে শাদী হয়, কিভাবে তারা সহবাস করে আর কিভাবেই বা ভোর
হওয়ার আগেই বাসর ঘর থেকে সে উধাও হয়ে যায় সবই এক এক করে সবিস্তারে বর্ণনা করে। এবার আজীবকে সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে—'তোমার নাতি। তোমার বংশের একমাত্র সন্তান। একে বুকে নিয়ে শোক-তাপ লাঘব কর।'

নুর-এর বিবি সামস-অল-দীন-এর মুখে সব ঘটনা শুনে নিঃসন্দেহ হ'ল, তার কলিজার সমান পুত্র হাসান তবে আজও জীবিত, ধারে কাছেই, কোথাও না কোথাও আছে।

এদিকে আজীব এবার দাদীর কোলে মুখ ওঁজে ঢুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল।

সামস-অল-দীন বলল — 'এখন বসে কাঁদার সময় নয় বহিন, কামিজ বদলে নাও। যত শীঘ্র সম্ভব আমরা মিশরের দিকে যাত্রা করব। যে করেই হোক হাসানকে খুঁজে বের করতেই হবে আমাদের।

তারা আবার দামাস্কাস নগরে পৌঁছল। তাঁবু গাড়লো আগের সে জায়গাতেই তারা এবারও বাস করতে লগল, দু'তিনদিন এখানে থাকার ইচ্ছা।

পরদিন সকালে উজির হাটের দিকে গেল। কিছু কেনাকাটা করা দরকার। আজীব এবার সইদকে নিয়ে সে হালুইকর লোকটিকে একবারটি দেখে আসার জন্য পা বাড়াল।

নগরের এখানে-ওখানে ঘুরে, কতসব মজার মজার জিনিস দেখতে দেখতে তারা সে-হালুইকরের দোকানে গেল।

আজীব’কে দোকানে ঢুকতে দেখে হালুইকর হাসান অবাক হয়ে গেল।

আজীব বলল—'আমার সেদিনের সে কাজের জন্য আমি খুবই দুঃখিত । পরিণামে কি হবে চিন্তা না করেই আমি তোমাকে লক্ষ্য করে পাথরের টুকরোটি ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। আজ মাফ চাইতে
এসেছি।

—'আমার কিছু হয় নি। সেরে গেছে। যাক গে, একবারটি ভেতরে আসবে কি বাছা?'

আজীব দোকানের ভেতরে গিয়ে বাঁশের তৈরী বেঞ্চে বসল। একটি রেকাবিতে কিছু বেদানার হালুয়| এনে তার সামনে ধরে বলল--- 'মেহেরবানী করে এটুকু খেয়ে নাও বাছা। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত আমি কেবল তোমার কথাই ভেবেছি।'

আাজীব হাসতে হাসতে বলল– তুমি তো যে সে লোক নও হে! সেদিন আদর করে হালুয়াও খাওয়ালে আবার সর্বনাশের ধান্দা করতেও ছাড়লে না। চুপি চুপি আমাদের পিছু নিয়েছিলে। আমার কাছে হলফ কর, আর পিছু নেবার ধান্দা করবে না। যদি করই তবে কিন্তু আর কোনদিন তোমার দোকানমুখো হ’ব না।

-'ঠিক আছে, কথা দিচ্ছি, আর তোমার পিছু নেব না।'

আজীব এবার হাসনের হাত ধরে টেনে তার পাশে বসিয়ে বলল – আমাদের সঙ্গে আল্লাতাল্লার কাছে প্রার্থনা কর, আমার হারিয়ে যাওয়া আব্বাজীকে যেন খুঁজে বের করতে পারি।'

হাসান কিন্তু নির্নিমেষ চোখে আজীব-এর মুখের দিকেই তাকিয়ে রইল। কোনদিকে তার ভ্রক্ষেপমাত্রও নেই।

আহারাদি শেষ হবার পরও তারা প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় ধরে টুকরো টুকরো অনেক কথাই আলোচনা করল।
তাঁবুতে যখন তারা ফিরল তখন দেখল সবাই আজীব-এর জন্য পথ চেয়ে তাঁবুর বাইরে বসে, মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।

এবার উঠে গিয়ে একটি রেকারিতে কিছুটা বেদানার হালুয়া এনে আজীবকে খেতে দিল। বসরাহতে থাকাকালীন প্রায়ই এরকম মুখোরোচক খাবার তৈরী করে সবাইকে খাওয়াত। হাসান-এর
আম্মী বলল— ‘এর তৈরীর কৌশল আমার নিজস্ব আবিষ্কার।

তোর বাবা খুবই পছন্দ করত নিজেও এরকম হালুয়া তৈরীর কৌশল আমার কাছ থেকে শিখে নিয়েছিল। তামাম দুনিয়াটি ঘুরে এলেও এরকম বেদানার হালুয়া আর কোথাও পাবি না।

– কি যে বলছ দাদি, নিজেই জান না! একটু আগেই আমি আর সাইদ বাজারের এক দোকানে কী সুন্দর বেদয়ার হালুয়া খেয়ে এলাম। আল্লাহ-র নামে কসম খেয়ে বলছি, এর এক বিন্দুও ঝুটা নয় হালুয়ার কী সুন্দর খুসবু, বলে বোঝাতে পারব না।'


এমন সময় বেগম শাহরাজাদ দেখল ভোর হয়ে আসছে। তিনি কিসসা থামালেন।


ছাব্বিশতম রজনী

বাদশহ শাহরিয়ার যথা সময়ে অন্দরমহলে বেগমের কামরায় এলেন, বেগম শহরাজাদ কিসসার অবশিষ্ট অংশ শুরু করতে গিয়ে
বললেন—
'জাহাপনা, আজীব এর কথা শুনে তার দাদি রেগেমেগে একেবারে কাঁই হয়ে গেল। সাইদ কে বলল – হতচ্ছাড়া কোথাকার বাজারের যে-সে দোকানে নিয়ে গিয়ে একে ঢুকিয়েছিলি, সহস তো কম নয়, তোর।

—অল্লাহর দোহাই বিশ্বাস করুন, আমরা কোন দোকানে ঢুকিনি। এক হালুইকরের দোকানের পাশ দিয়ে গিয়েছিলাম মাত্র।

তাই বলে—।'
তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই আজীব বলল—'সাইদ মিথ্যে কথা বলিস নে। আচ্ছা, তুই বুকে হাত দিয়ে বল তো আমরা সকালে হালুইকরের দোকানে গিয়ে বেদানার হালুয়া খেয়ে আসিনি?

আজীব-এর দাদি এবার ব্যস্ত পায়ে উজিরের কাছে গিয়ে নালিশ জানায়। সাইদ আজীব'কে নিয়ে যেখানে-সেখানে যাওয়া শুরু করেছে।

সাইদ উজিরের কাছেও মিথ্যা কথা বলে। আজীবকে নিয়ে যে সে হালুইকরের দোকানে গিয়েছিল, উভয়েই বেদানার হালুয়া খেয়ে এসেছে—পুরো ব্যাপারটি অস্বীকার করে।

কিন্তু আজীব বার বার নিজের কথাই বলতে থাকে। উজিরের বুঝতে বাকি রইল না, সাইদ নিজের কসুর চাপা দিতে গিয়ে । পুরো ব্যাপারটিই অস্বীকার করছে।

আজীব এর মুখে হালুইকরের তৈরী হালুয়ার ভূয়সী প্রশংসা শুনে তিনি সাইদ কে বার বার ধমকাতে লাগলেন।

আজীব-এর নানি এবার একটি রেকাবি এনে সাইদ-এর হাতে দিয়ে বলল— 'এতে করে আধ দিনার দিয়ে ওই দোকান থেকে বেদনার হালুয়া নিয়ে আয়। আজীব-এর দাদুকে আমার তৈরী
হালুয়া এবং দোকানের হালুয়া দুটোই খেতে দেব। তিনি খেয়ে, বিচার করে বলবেন কোন হালুয়া বেশী সুস্বাদু।

দোকানি রেকারিতে হালুয়া দিয়ে তার ওপরে কিছু গুল্যাব পানি ছিটিয়ে দিয়ে সাইদ-এর হাতে তুলে দিল। সাইদ তাঁবুতে ফিরে হালুয়ার রেকারিটি আজীব-এর দাদির হাতে দিল। সে সঙ্গে সঙ্গে
রেকারিটি থেকে এক টুকরো হালুয়া তুলে মুখে ফেলতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়ার যোগাড় হল। সে নিঃসন্ধেহ হ'ল, এ-হালুয়া নির্ঘাৎ তার বেটা হাসানের হাতের তৈরী। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে সংজ্ঞা
হারিয়ে ফেলল। উজির খবর পেয়ে ছুটে এল। জল-বাতাস দিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলল।

সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে হাসান-এর মা আর্তনাদ করে
উঠস-'হাসান! হ্যাঁ এটি আমার বেটা হাসান-এর হাতের তৈরী হালুয়াই বটে। আমার বেটা হাসান-এর হাতের তৈরী হালুয়া না হয়েই যায় না।'

উজির জনা বিশেক নফরকে সঙ্গে দিয়ে সাইদ'কে পাঠাল মিঠাই ওয়ালাকে ধরে নিয়ে আসার জন্য।

এতেও উজ়ির আশ্বস্ত হতে পারল না। নিজে একটি টাট্টুর পিঠে চেপে মিশরের সুলতানের দেওয়া পরোয়ানাটি নিয়ে হুকুমদারের সঙ্গে দেখা করলেন।

হুকুমদার জিজ্ঞাসা করল— 'কাকে কয়েদ করতে চান আপনি বলুন তো?'

‘বাজারের এক হালুইকরকে আমার হাতে তুলে দিন।

ঠিক আছে, আমি এখুনি সিপাহী পাঠাচ্ছি।'

হুকুমদারের হুকুম পেয়ে একদল সশস্ত্র সিপাহী ছুটল হালুইকর হাসান'কে ধরে আনার জন্য।

উজির তাঁবুতে ফিরল।

হুকুমদারের সৈন্য সামন্তর হৈ হৈ করতে করতে হালুইকর হাসান-এর দোকানে ঢুকল। পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলল।

বন্দী হাসান পথে আসতে আসতে ভাবছে— হায় খোদা! এক রেকাবি হালুয়া শেষ পর্যন্ত এমন পরমাদ ঘটাতে পারে, স্বপ্নেও ভাবিনি।'

চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বন্দী হাসান উজির কে বলতে লাগল— ‘হুজুর মেহেরবান, আপনার কাছে কী এমন গুনাহ করেছি যে, আমাকে কোমরে রশি পরতে হ'ল?’

–সত্যি করে বলবে, বেদানার হালুয়া কি তুমিই কে
বানিয়েছিলে?'

‘জী হুজুর । কাজটি কি বে-আইনী?’

--- বে-আইনীর চেয়ে বড় কিছু যদি থাকে তবে তুমি তা-ই করেছ। আমাদের সঙ্গে তোমাকে কায়রো নগরে যেতে হবে।'

উজির হাসান-এর মাকে এসব কিছুই জানাল না।

উজির তাঁবু গুটিয়ে সদলবলে কায়রো নগরের উদ্দেশে যাত্রা করল।

পথে আহারের জন্য হাসান-এর হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হল। খানাপিনার পর আবার পিঠমোড়া করে বেঁধে উটের পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হল। কেটে গেল বেশ কয়েকটি দিন। উজির এক সকালে নতুন করে যাত্রা করার আগে হাসান'কে আড়ালে নিয়ে
গিয়ে জিজ্ঞাসা করল- 'এখনও সময় আছে, সত্যি করে বলবে।

বেদানার হালুয়া কি তুমিই নিজে হাতে বানাও। ঝুট বললে জিব কেটে নেব বলে দিচ্ছি।'

– হুজুর, আমি নিজের হাতেই রোজ বানাই।'

আবার উটের পিঠে তোলা হল কয়েদী হাসান'কে।
কায়রোর সীমানায় পৌঁছে উজির ছুতোর মিস্ত্রিকে তলব করল। সে এসে কুর্নিশ করে সামনে দাঁড়াল। উক্তির বলল– “যত শীঘ্র সম্ভব বন্দীর মাপে একটি ক্রশচিহ্ন বানিয়ে আন, তাতে এ কয়েদী হতচ্ছাড়াটিকে রশি দিয়ে আচ্ছা করে বেঁধে মোষের গাড়ীর পিছনে বেঁধে দাও।

হাসান হাউমাউ করে কেঁনে বলল –'হুজুর মেহেরবান, আমি শাস্তি ভোগ করতে চলেছি, কিন্তু কি যে আমার গুনাহ তা-ই আজ অবধি জানতে পারলাম না।'

'গুনাহ? গুনাহ, অবশ্যই তোমার হয়েছে। ওগুলো কি হালুয়া বানিয়েছিলে? মরিচের গুড়া পরিমাণ মত ব্যবহার করতে পার নি।

—'হুজুর' এরকম একটি সামান্য ব্যাপারে এমন গুরুদণ্ড- একেবারে ফাঁসির হুকুম। এরজন্য আপনি আমাকে রশি দিয়ে পিঠমোড়া করে বেঁধে রেখেছেন! দিন-রাত্রি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে একবার মাত্র খানা দিয়েছেন। এত কষ্ট দিয়েও শান্তি পাননি? আবার হুকুম দিয়েছেন আমাকে ফাঁসি দিয়ে মারার জন্য। কথা বলতে বলতে হাসান-এর দু'চোখে পানির ধারা নেমে এল। মাথায় হাত
দিয়ে পথে মাঝে বসে পড়ল। ভাবতে পাগলে নিজের নসীবের কথা।

উজির মুচকি হেসে বলল-- কি হে, অমন করে কি ভাবছ?’

-কি আবার ভাবব! ভাবছি, আপনার মত একটি উর্বর মস্তিষ্কের অধিকারীর ওপর একটি রাজ্যের দায়িত্ব দিয়ে সুলতান কি করে যে নিশ্চিন্ত থাকেন। ভেবে অবাক হচ্ছি। বেদানার হালুয়ায় মরিচের গুঁড়ার পরিমাণ ঠিক হয়নি বলে একটি লোককে ফাঁসি কাঠে বুলিয়ে দেওয়ার হুকুম দেওয়া হয়েছে। চমৎকার। চমৎকার বিচার। কাজীর বিচারকেও আপনার হুকুমনামা হার মানিয়ে দিচ্ছে।'

– আমি তোমার মত আহাম্মকের সঙ্গে তর্ক করে সময় নষ্ট করতে চাই না। আমার কাজে ফাঁকি না দাও এ-ই সবার আগে আমাকে বিচার করে দেখতে হবে।'

মুখে বিষাদের হাসি ফুটিয়ে তুলে হাসান বলল— কিন্তু কি করে? আমাকে খুন করার পর আমার কাজের বিচার করবেন নাকি বাঁচিয়ে রেখে, কাজ করিয়ে নিয়ে তবে সত্যি ফাঁকি দেই কিনা
দেখবেন?”

—‘দেখাদেখি সব সারা; রোজই তো এরকম হালুয়া তৈরী করে কাজে গালতি করছ। রোজ গুণাহ করে করে পাহাড় বানিয়ে ফেলেছ। সত্যি বলতে কি মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও বড় কোন সাজা দেখছি তোমার জন্য বরাদ্দ করা দরকার ছিল।’

--ঠিক আছে। আপনার যা দিল চায় করতে পরেন। উম্মাদের সঙ্গে বচসায় ফল তো কিছু হয় না বরং অশান্তি বাড়ে।'

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে। উজির তার নফরণের হুকুম দিল, হাসান কে কাঠের বাক্সে ভরে তার তাঁবুতে রেখে দিতে।

উজির ঘরে ফিরল। সে প্রথমেই হাসান-এর আম্মা আর সিং-অল-হুসন-এর সঙ্গে মোলাকাৎ করল। লেড়কিকে ডেকে বলল—'বেটি তোর দুঃখের দিন হয়ত এতদিনে ঘুচল।বভাল করে সেজেগুজে আয়। তাকে এক্কেবারে সাথে নিয়ে এসেছি।
শাদীর রাতের সাজগোছের কথা খেয়াল আছে তো? ঠিক সেভাবেই পরিপাটি করে সাজবি। ভাল কথা, সিন্দুকের কাগজটিতে তে সেদিনের সাজের বিবরণ লেখাই আচ্ছ। একবারটি না হয় চোখ বুলিয়ে নে।'

মন-এর অন্তরের অন্তঃস্থলে অনলের তুফান বয়ে চলল। তার ঘরটিকে হুবহু সেরকম করে বাসর ঘর সাজিয়ে তুল্ক শালীর রাত্রে যেমন করে সাজানো হয়েছিল। তাজ্জব বনে যাওয়ার মত ব্যাপারই
বটে।

উজির এবার সিন্দুক খুলে হাসানের বিয়ের রাত্রের ইজের, পাতলুন, টুপি আর তার মোহরের থলিটি কুর্শির ওপরে রাখল। মোহরের থলিটিতে এক হাজার সোনার মোহর এবং ইহুদি বণিকের লেখা জাহাজের দলিলটি রয়েছে। এবার পাতলুনটির
জেবের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল নূর-অল-দীন-এর স্বাক্ষরযুক্ত পত্রটি।

উজির হুসনকে বল্‌ল—'বেটি, শাদীর রাত্রে পালঙ্কের ওপর ঠিক যে কারদায় তুমি ওয়েছিলে হুবহু সেভাবে শুয়ে পড়। আমি যাচ্ছি, হাসান'কে তোমার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

উক্তির লেড়কির কাছ থেকে এবার জামাতা হাসান-এর কাছে এল। হাসান ঘুমে বিভোর। উজিরের নির্দেশে দু'জন নফর তার পাতলুন, কামিজ যা কিছু রয়েছে,  খুলে একেবারে বিবস্ত করে ফেলল। এবার কেবলমাত্র একটি রেশমী চাদর লুঙ্গির মত করে জড়িয়ে দিল তার কোমরে। আর মাথায় একটি টুপি পরিয়ে দিল। এবার ধরাধরি করে হুসন-এর ঘরের গালিচার ওপর শুইয়ে দিয়ে চুপিসারে ঘরছেড়ে বেরিয়ে এল।

বেশ কিছুক্ষিণ বাদে হাসান-এর ঘুম টুটল। চোখ মেলে তাকাল। চোখের মণি দুটো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারদিকে তাকাল। বিস্ময়ে হতবাক হ’ল। যত দেখছে ততই যেন সে বিস্ময়ের ঘোরে তলিয়ে
যাচ্ছে। এবার পালঙ্কটির দিকে আবার চোখ ফেরাল। চিনতে পারল! হ্যাঁ, সেদিনের সে পালঙ্কটিই তো বটে। আর পালঙ্কের ওপর যে শুয়ে সে-ই তো তার মনময়ূরী হুসন। এ কী স্বপ্ন, নাকি
বাস্তব? সে তো কত দিন আগেকার কথা। সবকিছু যেন তার কাছে তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। সে সবিস্ময়ে ভাবল, তাকে তো পিঠমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছিল। উজিরের হুকুম ছিল ক্রুশবিদ্ধ করে মারা হবে। কিন্তু তার পরিবর্তে একেবারে স্বপ্নরাজ্যে নিয়ে এসে ফেলা হয়েছে তাকে।

হাসান অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে তাকাতেই তার বহুপরিচিত ও বহুদিনের সাথী বসরাহর নকসাযুক্ত চমৎকার টুপিটি চোখে পড়ল। এবার দেখল মোহরের থলিটাকে। ব্যস্ত হাতে খুলে দেখল এক
হাজার সোনার মোহর আর সে-বণিকের স্বাক্ষরযুক্ত জাহাজ বিক্রির দলিলটি। খাটের কোনায় তার পাতলুনটি পরিপার্টি করে
রাখা, জেবের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল নূর-অল-দীন-এর স্বাক্ষরযুক্ত ঠিকুজী-পত্রখানা। এক নজর চোখ বুলিয়ে
নিঃসন্দেহ হ’ল, সেটিই বটে। সে আরও বেশী ধন্ধে পড়ে গেল। কোন কিছুকেই অস্বীকার করতে পারছে না। আবার মেনে নিতেও উৎসাহ পাচ্ছে না। এ কী সমস্যা রে বাবা!

এবার হুসন-এর দিকে চোখ ফেরাল। হ্যাঁ, কিছুমাত্রও ভুল হয়নি তার। এ তার সে বহু আকাঙ্ক্ষিতাই বটে। তার সে-মেহবুবা। তার জীবনের প্রথম আনন্দ-সুখ প্রদায়িনী। গুটি গুটি এগিয়ে গেল পালঙ্কের দিকে। কাছে একেবারে পালঙ্কের গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার যৌবনের জোয়ারকে নতুন করে চাক্ষুষ করতে লাগল।

হাসান দুরু দুরু বুকে পালঙ্কের ওপর উঠে বসল! মেহবুবার গালের কাছে হাতটি নিয়ে গিয়েও আবার টেনে নিয়ে এল। হুসন ঘুমের ভান করে বিছানায় আগের মতই এলিয়ে পড়ে রইল।
দু'চারটে ছোট ছোট কোঁকড়ানো কুচকুচে কালো চুল হুসন-এর কপালের ওপর পড়েছে। এগুলো তার ঘুমের সৌন্দর্যকে আরও অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।

হাসান বিস্ময় বিস্ফরিত কামাতুর চোখ দুটো মেলে হুসন-এর আধফোঁটা পদ্মের মত মুখটির দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।

তারপর দ্বিধাজড়িত হাত দিয়ে আলতো করে তার কপালের ওপর জড়ো হওয়া চুলগুলোকে সরিয়ে দিল। হাসান-এর হাতের ছোঁয়া পেয়ে হুসন ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। এমনই কোন এক সুযোগের প্রতীক্ষায় ঘুমের ভান করে পড়েছিল এতক্ষণ। এবার আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসল। হাত বাড়িয়ে হাসান'কে বুকে জড়িয়ে ধরে আবেগ-মধুর স্বরে বলল—'মেহবুব, অমন করে কি দেখছ? কি আছে আমার মুখে? সারারাত ধরে তো প্রাণ ভরে খেলে। এতেও আশ মেটেনি তোমার? আরও মন চাইছে? কিন্তু আর কি করে সম্ভব, বল তো?
ভোর হয়ে এল যে। আমার যা কিছু সম্পদ আঠারো বছর ধরে কামাতুর মানুষগুলোর কাছ থেকে আগলে আগলে রেখেছিলাম সবই তো তোমাকে উজাড় করে দিয়েছি।' কথা বলতে বলতে
কামবিকারে দু’হাতে তাকে বুকের মধ্যে সজোরে চেপে ধরে বলল— 'আমার দেহের গোপন সম্পদগুলো তোমার মনকে কি তুষ্ট করতে পেরেছে বল তো মেহবুব?’ এবার আচমকা নিজের
ঠোঁট দুটো দিয়ে হাসান-এর ঠোঁট দুটো আঁকড়ে ধরল। আলতো -একটি কামড় দিয়ে বলল – “সারা রাত্রি ধরে আমাকে ময়দা ডলার মত পেশাই করেছ। কামড়ে কামড়ে ঠোঁট দুটোতে রক্ত জমাট
বাঁধিয়ে দিয়েছ। আর যেটুকু বাকি ছিল পূরণ করে দিলাম, এবার পিয়াস মিটেছে তো?'

সোনা মানিক আমার, এখন আর নয়। ভোরবেলা লোকে দেখে ফেললে লজ্জার ব্যাপার হবে। আমার যা কিছু সম্পদ সবই তো তোমার কাম-জ্বালায় শান্তিবারি সিঞ্চন করার জন্যই। সবই তো তোমার। শুধু তোমার, থাকবেও শুধু তোমারই জন্য।'

হাসান এবার হুসন-র বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল— 'আমি কি তবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? হালুইকর সেজে দোকানদারি করেছিলাম খোয়াবের মধ্যে? সন্ধ্যাবেলা ফুটফুটে একটি লড়কা আর তার ন্যর কে আমার নিজের হাতে তৈরী হালুয়া খাইয়েছিলাম। ব্যস, খানিক বাদে একদল ষন্ডামার্কা লোক এসে আমার দোকানটি ভেঙেচুরে লণ্ডভণ্ড করে নিয়ে গেল।
উজিরের হুকুমেই নাকি তারা আমার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে। উজিরের অজুহাত হালুয়াতে নাতি মরিচ পরিমাণ মত দেওয়া হয় নি।

হুসন তার একটি হাত টেনে নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে বলল— 'হাতদুটো আবার কেটেটেটে যায়নি তো?

হাসান তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে বললো- তোমার মাথাটাথা খারাপ হ'ল নাকি! থোয়ারের মধ্যে হাত বাঁধলে কাটাকাটি হয় নাকি কখনও। সত্যি সত্যি বাঁধলে না হয় সম্ভাবনা থাকত। তারপর আরও
আছে। পিঠমোড়া করে বেধেও খুশী হতে পারে নি। আবার বলে কিনা ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করবে!

হুসন আঁতকে উঠে বলল-- ওমা, সে কি কথা গো। আমার সোনা মানিককে মারবে, কার এমন সাধ্য ??

— 'আরে তুমিও যেমন। বলছি না, সবই খোয়াবের ব্যাপার।'

– হাঁ' গো, ঠিকই বলেছ। খোয়াবের মধ্যে অনেক কিছুই হতে পারে বটে।' আচমকা কপালের দিকে হাসান-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে হুসন ব'লে উঠল—হ্যাঁ গা তোমার কপালে কিসের দাগ দেখা যাচ্ছে যেন?

কপালে হাত বুলাতে বুলাতে হাসান বলল—'তাই তো, তবে তো খোয়াব টোয়ার মিথ্যে! ছেলেটির পিছন পিছন হাঁটার সময় সে রেগে গিয়ে একটি পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল। অব্যর্থ লক্ষ্য। কপালে লেগে কেটে গেল। খুন ঝরল বহুত। দাওয়াই লাগিয়ে ক্ষতটি শুকোতে হয়। মুহূর্তকাল নীরবে ভেবে এবার সে বলল— 'কী ঝ'কমারিতেই না পড়া গেল! একবার ভাবি খোয়াব, আবার মনে হয় কিছুতেই খোয়াব হতে পারে না। সবকিছু কেমন জট পাঁকিয়ে যাচ্ছে।

—'আমার কথা শোন সোনা মানিক, ওসব উদ্ভট ব্যাপার স্যাপার নিয়ে ভেবে মিছে মনটিকে বিষিয়ে তুলো না। কথা বলতে বলতে হুসন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। মন-প্রাণ উতলা করা হসন-এর আঠার বছরের নিটোল স্তন দুটোর ফাঁকে মুখ গুঁজে পরমতৃপ্তির স্বস্তিতে এলিয়ে পড়ে রইল। না, আর কিছুই ভাবতে পারছে না সে। ভাবা সঙ্গতও নয়। অতীতের জের হিসাবে বর্তমানকে কল্পনা করে মন-প্রাণ বিষিয়ে তোলা নিতান্তই বোকামি।

পরম স্বস্তিতে হাসান-এর চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। কখন যে ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারে নি। ঘুম ভাঙার পর হাসান যখন চোখ মেলে তাকাল তখন সূর্য গুটি গুটি আকাশের গা-বেয়ে অনেকখানি ওপরে উঠে গেছে। চোখ
মেলে তাকিয়েই সামনে উজিরকে দেখতে পেল। সচকিত হয়ে তার দিকে সভয়ে তাকাল। উজির সেই অত্যাচারী উজির।

উজির সামস-অল-দীন একটি কুর্শিতে বসল। এবার মুচকি হেসে বলল— 'বাপজান, তুমি আমার ছোট ভাইয়া নূর-অল-দীন- এর বেটা তোমাকে আমি বহুত দুঃখ দিয়েছি। তুমি যে আমার বেটির স্বামী আর আজীব এর আব্বা সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্যই আমাকে কিছু চাতুরীর আশ্রয় নিতেই হয়েছে। গতকাল রাত্রে তোমার টুকরো টুকরো কথাবার্তা শুনে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত
হতে পেরেছি। আসলে আমার ভাইয়া নূর-এর সঙ্গে আমার সামান্য ভূল বোঝাবুঝির জন্যই এতসব কেলেঙ্কারী হয়েছে।'

উজির দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পরমুহূর্তেই আজীব ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকল। হুসন হেসে বলল ‘বেটা, তোর আব্বাজীর কথা জিজ্ঞেস করছিলি না? এই যে তোর আব্বাজী।'

আজীব দেখল, সে হালুইকর। কি ভাবল, কে জানে! তারপরই ছুটে গিয়ে হাসান-এর গলা জড়িয়ে ধরল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসান-এর মা-ও সেখানে উপস্থিত হ'ল। ‘বেটা। মেরে লাল!' ব'লে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল। এ-পর্যন্ত ব'লে বেগম শহরজাদ কিস্সা বন্ধ করলেন।