প্রথম কালান্দার ফকির তাঁর কিস্সা শেষ করলে খলিফা হারুণ-অল-রসিদ জাফর-এর কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বল্‌লেন—
কী মর্মান্তিক কাহিনী শোনালেন ফকির সাহেব! এমন অবিশ্বাস্য ঘটন সচরাচর ঘটে না।

প্রথম কালান্দার ফকির তাঁর জীবন কাহিনী শুনিয়ে মুক্তিলাভ করলে দ্বিতীয় কালান্দর ফকির এগিয়ে এসে তার জীবন কথা শুরু করলেন।

আপনারা যে আমার কানা চোখটা দেখছেন, আমি কিন্তু মোটেই কানা চোখ নিয়ে জন্মলাভ করিনি। আর আমার গায়ে যে ফকিরের আলখাল্লা দেখতে পাচ্ছেন তা-ও কিন্তু আমার গায়ে উঠেছে অবিশ্বাস্য ঘটনার মধ্য দিয়েই।

আমার আব্বাজীও বাদশাহ ছিলেন। আমি ছিলাম বাদশাহের পেয়ারের বেটা। আমার আব্বাজান বাদশাহ, অগাধ ঐশ্বর্যের মালিক হলেও
যথেষ্ট বিদ্ধান ও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। আমাকেও উচ্চশিক্ষাদান করতে ত্রুটি করেন নি। পৃথিবীর সেরা সেরা বইয়ের পাহাড় ছিল আমাদের প্রাসাদে। আমি ছিলাম বইয়ের পোকা।

দেখুন, নিজের গুণগান করা উচিত নয়। আমারও সেরকম ইচ্ছা নেই। তবে প্রসঙ্গক্রমে কিছুতো বলতেই হবে। আমার বিদ্যা-বুদ্ধি আর অগাধ পাণ্ডিত্যের কথা কেবল আমাদের রাজ্যেই নয় প্রতিবেশী রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ল।

একবার সমরখন্দের এক বাদশাহ আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি আব্বাজীর অনুমতি নিয়ে বহুমূল উপঢৌকনসহ তাঁর রাজ্যের উদ্দেশে যাত্রা করলাম বাদশাহের ভেট, জাহাজ বন্দর ছাড়লো। একমাস অতিক্রান্ত, তখন এক বন্দরে আমার জাহাজ নোঙর করল। আমার সঙ্গের উট আর ঘোড়াগুলোকে নামিয়ে দেওয়া হ'ল। তাদের
পিঠে উপহরগুলে চাপিয়ে রওনা হলাম। মাত্র ঘণ্টা খানেকের পথ। হঠাৎ ভীষণ ঝড় উঠল। ঝড় থামলে চারদিকে তাকালাম। অজানা অচেনা মরুভূমিতে আমরা এগিয়ে চলেছি অতর্কিতে
একদল সশস্ত্র মরু ডাকাত আমাদের ঘিরে ফেললো। আমি বল্লাম, বাদশাহের জন্য উপঢৌকন নিয়ে চলেছি। পাত্তা দিল না। তারা আচমকা তরবারির আঘাতে আমার এক ক্রীতদাসকে হত্যা করে বসলো। তার খুন দেখে আমরা যে যেদিকে পারলাম দৌড়ে ভাগতে লাগলাম। কারো কথা ভাবার অবকাশ নেই।

এক সময় ছবির মত সুন্দর এক নগরে হাজির হলাম। শহরের পথে এক দর্জির কারখানা চোখে পড়ল। ছেঁড়া কাপড়ে তাপ্পি মারছে।

আমাকে দেখেই দর্জি মুচকি হাসল। বিদেশী অনুমান করেই হয়ত তার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। আমি পাল্টা হাসিতে তাকে তুষ্ট করলাম। গুটিগুটি তার দোকানে উঠে গেলাম। আমার
পরিচয় নিল। তার মুখে বিষাদের ছায়া নেমে এল। বলল— 'তুমি হয়ত জান না যে, এ দেশের শহেনাহ তোমার বাবার সব চেয়ে বড় শত্রু। তোমাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার পিছনে রহস্য হচ্ছে
তোমাকে খুনের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়া। খবরদার কাউকে তোমার পরিচয় দেবে না। তবে কিন্তু এখানে করো কাছে আশ্রয় পাওয়াই তোমার পক্ষে দুষ্কর হয়ে উঠবে।

দর্জি আমার সঙ্গে খুবই ভাল ব্যবহার করল। রাত্রে খানাপিনা করাল। পাটি পেতে শুতে দিল।
তিনদিন দর্জির আশ্রয়ে রইলাম।

একদিন দর্জি কাজ করতে করতে বললো— এমন কোন কাজ জান কি যা দিয়ে তুমি রুটির জোগাড় করতে পারবে?

– কিন্তু কোন বিদ্যা যে এখানে আমার রুটি রোজগারের কাজে লাগতে পারে তা তো জানি না ভাই। তবে আইন বিষয়ে আমার পাণ্ডিত্য রয়েছে। দর্শন আর সাহিত্যেও যথেষ্ট দখল রয়েছে। আর
হিসাবশাস্ত্রে নিজেকে একজন বড় পণ্ডিত বলেই আমি মনে করি।

দর্জি ব্যাজার মুখে বলল— ভাইজান এ সব বিদ্য এখানে অচল।
অর্থেউপার্জনই এখানকার মানুষের একমাত্র লক্ষ্য।

আমি হতাশার স্বরে বললাম— কিন্তু এসব ছাড়া যে অন্য কোন কাজই আমি রপ্ত করতে পারিনি।

মুহূর্তকাল গম্ভীর মুখে ভেবে বলল— ঠিক আছে, ব্যাপারটা খোদাতাল্লার ওপরেই ছেড়ে দেওয়া যাক। তিনিই দয়া করে যা হোক একটা বিহিত করে দেবেন।

দু'দিন বাদে দর্জি একটা কুড়াল এনে আমার হাতে দিয়ে বলল— ভাইজান, জঙ্গল থেকে কাঠ নিয়ে এসে নগরে বিক্রি করলে রুটির জোগাড় হয়ে যাবে। যাও, তাই কর।

দর্জির পরামর্শ মত জঙ্গল থেকে কাঠ এনে নগরে বিক্রি করে পেটের জোগাড় করতে লাগলাম। অশ্রয় দর্জিই দিল। এক বছর কেটে গেল।

এক সকালে গভীর জঙ্গলে ঢুকে একটা বিশাল মরাগাছ কাটতে লাগলাম। কয়েক কোপ দিতেই গাছের গোড়া থেকে কুড়োলের সঙ্গে একটা তামার বালা উঠে এল। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম !
মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে উন্মানের হত মাটি কাটাতে লাগলাম। কিছুটা মাটি কাটতেই আমার চোখের সামনে একটা কাঠের মাচা ভেসে উঠল অবাক মানলাম ব্যস্ত-হাতে মাচাটা সরিয়ে ফেলতেই আরও বেশী অবক মানলাম। আচমকা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল—'হায় আল্লা!’ এক সুরমা অট্টালিকা দেখে আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। তর তর করে নিচে নেমে গেলাম। আরও অবাক মানলাম, যখন একটা বিশালায়তন ঘরের দরজায় পৌঁছলাম।
নিজের চোখ দুটোর ওপরও যেন আস্থা হারিয়ে ফেলাম। দেখি এক অষ্টাদশী সুসজ্জিত একটা পালঙ্কের ওপর শুয়ে। অপরূপা, খুব-সুরৎ! রূপের আভায় চোখ দুটো ঝল্‌সে দিচ্ছিল। মনে হ’ল
বেহেস্তের পরীদের সৃষ্টি করার পর অবশিষ্ট সৌন্দর্যটুকু অপরূপার গায়ে সযত্বে লেপে দেওয়া হয়েছে।

আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে অপরূপা চোখ মেলে তাকাল।
মিষ্টি-মধুর সুরেলা কণ্ঠে উচ্চারণ করল—'তুমি কি মানুষ নাকি কোন দৈত গো?

আমি বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বল্লাম— আমি মানুষ। সত্যিকারের মানুষ।

মেয়েটি সবিস্মরে বলল— মানুষ! কি করে এখানে এলে? বিশ বছর আমি মানুষ তো দূরের কথা মানুষের ছবি পর্যন্ত দেখতে পাইনাই।

—সবই আল্লাতাল্লার মর্জি। তিনিই আমাকে তোমার এখনে নিয়ে এসেছেন। এতদিন ধরে নসীবের ফেরে যা কিছু তকলিফ সহ্য করেই আজ তোমাকে চোখের সামনে দেখে সব মন থেকে মুছে ফেলেছি।

রুপসী যুবতী ধৈর্য ধরে আমার দুঃখ-দুর্দশার কথা সব শুনল। আমি থামলে সে এবার তার কিস্সা শোনাতে লাগল— শো গো মনের মানুষ, ইফতিমাসের লেড়কী আমি। চাচাতো ভাইয়ের
সঙ্গে আমার শাদী হবে পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল। নসীব মন্দ। শাদীর দিনে আমাকে বাজমূস দৈত্যের লেড়কা জারসিজ চুরি করে নিয়ে যায়। বহু জায়গায় ঘুরে এখনে এনে বন্দী করে। আমার
খা পিনার কোন অভাবই সে রাখে নি। সারা রাত্রি আমার সঙ্গে থাকে আমাকে উপভোগ করে। সুবহ হলেই পরিতৃপ্ত মন নিয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। ব্যস, সন্ধ্যার আগে তার টিকির নাগালও পাওয়া যায় না। আবার কখনোও দীর্ঘদিন সে এমুখো হয় না। চারদিন আগে এসেছিল। আরও ছয়দিন পর আবার আসার কথা। এর পাশেই একটা ছোট্ট কুঠরি আছে। তার দেওয়ালে একটা
লেখা রয়েছে। দু ছত্র মন্ত্র। তার গায়ে হাত রেখে দেত্যটাকে  ডাকলেই মুহূর্তে এখানে হাজির হয়। ছয় দিনের মধ্যে পাঁচদিন তুমি এখানে নির্বিবাদে কাটাতে পার। নিশ্চিন্তে আমাকে সঙ্গদান করতে
পরে। সে ফিরে আসার আগে এখান থেকে কেটে পোড়ো।

আমি রূপসী যুবতীর প্রস্তাবে সম্মত হলাম।
আমার মুখে থাকার কথা শুনে সে রীতিমত উল্লসিতা হয়ে পড়ল। উচ্ছ্বাসে আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে তার বিছানায় বসাল। তার হাতের স্পর্শে আমার সর্বাঙ্গে কেমন
যেন এক অনাস্বাদিত রোমাঞ্চ জাগল। বুকের মধ্যে কলিজাটি। নাচন কোদন জুড়ে দিল। ভাবলাম রূপলী যুবতির স্পর্শে যদি মন এমন পাগলপারা হয়ে ওঠে তবে সম্ভোগে না জানি তার পরিমাণ কত গুণ বৃদ্ধি পায়। অভাবনীয় উত্তেজনার সঞ্চার হ’ল যখন সে আমার সর্বাঙ্গে তেল মর্দন করে গোসল করাল। আর আমিও তার যৌবন ভরা দেহে নিজ হাতে তেল মর্দন করে গোসল করিয়ে দিলাম। তার
চোখে তারায় দুষ্টুমিভরা হাসি আমার কলিজাটাকে উথাল পাথাল করে দিতে লাগল। সে গোসল সেরে ঘাটে উঠে এল। অতর্কিতে নাবালিকামূলভ এক কাজ করে বসল। এক ধাক্কা দিয়ে আমাকে
আবার জলে ফেলে দিল। নিজেও ঝাপ করে জ্বলে পড়ল। ডুব সাঁতার দিয়ে আমার একটা পা চেপে ধরল। দাঁর্ঘ সময় ধরে চললো আমাদের জলকেলী। আমার বুকের উপর চেপে এল। কাঁধে হাত দুটো তুলে দিয়ে আমার বুকের সঙ্গে নিজেকে লেপ্টে নিল। থাকল অনেকক্ষণ। আমার মধ্যে তখন শিহরণের পর শিহরণ ঘটে চলেছে।
অদ্ভুত, অনাস্বাদিত শিহরণ। মনে হল এ সুখ ছেড়ে বেহেস্তে যেতেও আমি রাজি নই।

এক সময় আমরা ক্লান্ত দেহে সায়র থেকে উঠে এলাম। ষোড়ষোপচারে মধ্যাহ্ন ভোজন সারলাম উভয়ে। জলকেলীর ধস্থাধস্তিতে শরীরে অবসাদ অনুভব করছিলাম। দিবানিদ্রার মাধ্যমে ক্লান্তি অপনোদন করে নিলাম। সন্ধ্যার কিছু পরে রূপসীর নরম হাতের স্পর্শে আমার নিদ্রা টুটে গেল। আমি চোখ মেলে তাকালাম। সে তার ভুলতুলে নরম শরীরটাকে আমার ওপর ছেড়ে দিল।
আমার শরীরটাকে নিয়ে শিশুর মত খেলায় মেতে উঠল। আমি হাত বাড়িয়ে ওকে আরও নিবিড় করে নিলাম প্রশস্ত বুকটার মধ্যে। সে চনমনিয়ে উঠল। আমার ঠোটের কাছে নিজের ঠোঁট দুটো নিয়ে
এল। উষ্ণ অনুভূতি। শিহরণ। রোমাঞ্চ। আমার বুঝতে অসুবিধা হ'ল না। সে দলিত মথিত, পিষ্ট হওয়ার জন্য উন্মুখ। আমার যৌবনকে পুরোপুরি উপভোগ করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। রক্তে মাতন জেগেছে। তার পক্ষে নিজেকে সংযত রাখা তো সম্ভবও নয়। আমিও ক্ষুধাতুর নেকড়ের মত চেপে ধরলাম তার যৌবনের জোয়ার লাগা আঠার বছরের তুলতুলে শরীরটাকে। তার ঐকান্তিক
আগ্রহ আর আমার নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেওয়ার আগ্রহ একাকার হয়ে গেল।

গোপন করব না, তার দেহসুধা পান করে আমি যে তৃপ্তি সেদিন পেয়েছিলাম আজও তা আমার মনে রোমাঞ্চ জাগিয়ে তোলে।

রূপসী যুবতী চাওয়া ও পাওয়ার মধ্য দিয়ে তার ক্লান্ত-অবসন্ন দেহটাকে আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে হাঁফাতে লাগল। এক সময় একটু দম নিয়ে বলল-
আমার মন চাইছে আমার কলজেটা ছিঁড়ে এনে তোমাকে দিয়ে দেই।'


আমি বললাম— তোমাকে শয়তান দৈতটার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি কিছুতেই এখান থেকে যেতে পারব না।

সে আমার লোমশ বুকে হাত বোলাতে বোলাতে বললো-- কেন মিছে মিছে অস্থির হচ্ছ নাগর আমার! দৈত্য তো দশদিন বাদে বাদে এখানে আসে।

— 'তা হোক গে। আমি ছাড়া অন্য কেউ তোমার দেহটাকে উপভোগ করুক, তা আমি কিছুতেই বরদাস্থ করতে পারব না। কথা বলতে বলতে আমি উন্মাদের মত ছুটে গেলাম পাশের ঘরের দেয়ালের লেখাটার কাছে। একটা কুড়াল নিয়ে সজোরে আঘাত করতে লাগলাম তার গায়ে।

বেগম শাহরাজাদ দেখলেন প্রাসাদের বাইরের প্রকৃতির গায়ে প্রভাতের আলোর ছোপ দেখা দিয়েছে। কিসসা বন্ধ করলেন।


ত্রয়োদশ রজনী


বাদশাহ শারিয়ার বেগমের কাছে এলেন।
বেগম শাহরাজাদ বললেন—'জাঁহাপনা, দ্বিতীয় কালান্দার তার জীবনের ঘটনা বলতে লাগল।

তারপর আমার জীবনে কি ঘটল শেষ পর্যন্ত ধৈর্য ধরে শুনুন। আমি দেয়ালের লেখাটার গায়ে কুড়াল দিয়ে আঘাত করা মাত্রই যুবতী আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বল—আল্লাতায়ালার দোহাই, তুমি এখান থেকে চলে যাও। হত শীঘ্র পার পালাও। দৈত্য এসে পড়লে। তেমাকে মেরে ফেলবে। আমাকেও ছেড়ে কথা কইবে না! জানে বাঁচতে চাও তো পালাও।

আমি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যে-সিঁড়ি দিয়ে নেমেছিলাম তার দিকে দৌড়োলাম। উদ্ভ্রান্তের মত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। প্রেম আর সম্ভোগের সাধ মন থেকে নিঃশেষে মুছে গেছে।
ভয়ে কলিজা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ। বিপদের ওপর বিপদ। এতদূর এসে হঠাৎ মনে পড়ল, কুড়াল আর জুতো জোড়া তো সে-রূপসীর ঘরে ফেলে এসেছি। লম্বা লম্বা পায়ে ফিরে গেলাম। নসীবের ফের আর কাকে বলে। ফিরে এসেই দৈতোর ফাঁদে পড়ে গেলাম। দৈত্য বীর বিক্রমে, ফিরে আসতে লাগল। বাতাসকে অস্থির চঞ্চল করে তুলল তার হাত-পায়ের আস্ফালনে আর সূতীব্র হুঙ্কারে। পাহাড়ের মত সুবিশাল দেহধারী দৈত্যটা ফোঁস ফোঁস করতে করতে এসে হাজির হ'ল। তার চেহারাটা এক লহমায় দেখামাত্র আমার বুকের
ভেতরে কোন অদৃশ্য হাত যেন হরদম হাতুড়ি পিটতে লাগল। সত্যি যেমন বীভৎস তেমনি কদাকার তাকে দেখতে।

রূপসী-যুবতীটির সামনে এসে দাঁড়িয়ে সে গর্জে
উঠল— এটাকে কি বলে? আমি আরও ভাবলাম কোন অঘটন ঘটেছে, নির্থাৎ কোন বিপদের সম্মুখীন হয়েছ তুমি।


রূপসী যুবতী ভয়ে-ডরে পৌনে মরা হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো– কিছুই তো হয় নি নেশায় টলতে টলতে গিয়ে ওই লেখার গায়ে আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।

দৈত্যটা এত সহজে ভুলবার নয়। তা ছাড়া ঠিক তখনই আমার জুতো জোড়া আর কুড়ালটা তোর চোখে পড়ে গেল। চরম আক্রোশে গর্জে উঠল— শয়তানী কোথাকার। আমাকে ধাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা! এগুলো কার?'

—বিশ্বাস কর। এর আগে আমি এগুলো দেখি নি। তুমি না দেখালে হয়ত আমার চোখেই পড়ত না। আমি তো ভাবছি, তুমিই হয়তো কোন সময় সঙ্গে করে এনেছিলে, খেয়াল নেই।

–চুপ কর শয়তানী। এখনও সময় আছে, বল কার এগুলো?
কথা বলতে বলতে রূপসী যুবর্তীটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রচণ্ড আক্রোশে তার গায়ের জামা কাপড় টেনে ছিঁড়তে ছিঁড়তে তাকে একেবারে উলঙ্গ করে ফেললো। এক ঝটকায় উপুড় করে শুইয়ে দিল। হাত-পা সব মাটির সঙ্গে গেঁথে দিল। তারপর নৃশংস অত্যাচারে মেতে উঠলো ক্রোধোম্মাত্ত দৈত্যটা। সে কী বীভৎস দৃশ্য!

আমি অত্যন্ত সন্তর্পণে পা টেনে টেনে সিঁড়ির কাছে এলাম। নিজের আচরণে অনুতাপ জ্বালায় দগ্ধ হতে লাগলাম। নিজের সামান্য দেহক্ষুধা নিবৃত্ত করতে গিয়ে তাকে বিপদের মুখে ছুঁড়ে দিলাম। এ গুণাহ আল্লাতাল্লা ক্ষমা করবেন কি না জানি না।

বিষণ্ণ মুখে দর্জির কাছে ফিরে এলাম। আমাকে দেখে যেন সে আনন্দে নাচতে লাগল। বললো— সবাই কাঠ নিয়ে ফিরে এল আর তোমার দেখা নেই। আমি সরারাত্রি নির্ঘুম অবস্থায় বসে কাটিয়েছি। ধরেই নিয়েছিলাম, জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে তুমি নির্ঘাৎ খুন হয়েছ।
জানোয়ার তোমাকে ছিঁড়ে-খাবলে খেয়েছে। তোমাকে দেখে ধরে জল এল।

আমি এবার রূপসী যুবতী আর ভয়ংকর ল সে দৈত্যটার কথা তাকে সবিস্তার থাকে বললাম।

হঠাৎ কে যেন দরজা কড়া নাড়ল। দর্জি ব্যস্ত হয়ে উঠে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমার কাছে ফিরে এসে বলল– এক পার্শী এসেছে তোমার জুতো জোড়া আর কুড়ালটা নিয়ে, তোমার সঙ্গে
জন করার জন্য।

ব্যস আমার মাথাটা দপ দপ করে উঠল। গায়ে কাপুনি আর বুকের মধ্যে হাতুড়ির ক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। কিছুতেই দরজায় অপেক্ষমান লোকটার কাছে যেতে উৎসাহী হলাম না।

দর্জি আমাকে পীড়াপীড়ি করতে লাগল যাতে আমি তার সঙ্গে গিয়ে একটিবার অন্ততঃ দেখা করি। সে এবার বলল— পার্শি লোকটি নাকি বনের ধারে কাঠুরেদের আস্তানায় গিয়েছিলেন তোমার খোঁজে। তারা তোমার স্কুতোজোড়া দেখেই চিনতে পারে। তারপর ঠিকানা দিয়ে আমার এখানে পাঠিয়ে দেয়।

আমি আল্লাতায়ালার নাম করতে করতে প্রাণ হাতে নিয়ে পার্শি ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমি দরজটি সামান্য ফাঁক করে আগন্তুক পার্শিটাকে ভাল করে দেখার জন্য দরজাটা একটু
ফাঁক করতেই সে চোখের পলকে আমার একটা হাত খপ্ করে ধরে ফেললো। বুঝলাম দৈত্যের হাত। মানুষের হাত কখনো এমনটি হয় না। এক হেঁচকা টানে আমাকে বাইরে বের করে নিল। এবার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ধপাস করে পাতাল পুরীতে ফেলে দিল। আমার সামনে পড়ে সে রূপসী-যুবতী। রক্তাপ্লুত তার দেহটা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

দৈত্যটা গর্জন জুড়ে দিল— তোর পিরিতের নাগরকে নিয়ে এসেছি। দেখ তো চিনতে পারিস কিনা?

—'আমি কাউকেই চিনি না। আমার কোন নাগরটাগর নেই।

তারপর আমাকে এক লহমায় দেখে নিয়ে বললো— কই, একে তো আমি দেখিও নি কোনদিন।

-চিনিস না? দেখিস নি কোনদিন? মিথ্য! কথা বলার আর জায়গা পাস নি! তুই একে নিয়ে মজা লুটিস নি, বল শয়তানি? এই নে তরবারি। যদি তোর নাগর না-ই হয়ে থাকে তবে আমার সামনে
একে কেটে দু’টুকরো করে ফেল।

মেয়েটা তরবারিটা নিয়ে আমার দিকে এক পা এগিয়ে এল। আমি চোখের মণিতে সকরুণ মিনতি জানালাম। তা দেখে সে কেমন যেন হকচকিয়ে গেল। -তোমার জন্যই আজ আমার কলিজাটা
টুকরো টুকরো হচ্ছে! কথাট বলতে বলতে হাতের তরবারিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল।

বুদ্ধির ঢেকি দৈত্যটা তার কথার মারপ্যাচ বুঝল না। সে এবার তরবারটা কুড়িয়ে নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বল— তোমার পিয়ারি দোস্তের গর্দানটা নামিয়ে নিতে পারলে বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে। যাও, ওর গদনিটা ধড় থেকে নামিয়ে দাও।

আমি ভাবলাম, নিজের জানের বিনিময়ে তার গর্দানটা নামিয়ে দিয়ে বিশ্বাসগতকতা করাটা মোটেই সম্মত নয়। এত অত্যাচার সহ্য করেছে তো কেবল মহব্বতের খাতিরেই। কিন্তু করি-ই ব’কি? চোখ দিয়ে পানি পড়াতে লাগলো। পারলাম না। তরবারিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। এবার দৈত্যের দিকে ফিরে বল্লাম— তুমি দৈত কুলের সম্রাট।  তোমার কটাক্ষে দুনিয়া থরথরিয়ে কাঁপে। তুমি তো নিজের চোখেই দেখলে, আমি তার তিলমাত্রও ক্ষতি কোনদিন করিনি বলেই তো সে আমার জান নিতে পারল না। আমিই বা বিনা অপরাধে তার
গর্দান নিতে কি করে 'উৎসাহী হই, তুমিই বল?

দৈত্যটা এবার বিশ্রী স্বরে গর্জে উঠে বলল—'বুঝেছি, তোমাদের মহব্বত খুবই গাঢ় হয়ে উঠেছে। কেউ-ই কাউকে ছাড়তে পারছ না?

নিষ্ঠুর দৈত্যটা বিকট চিৎকারে চারদিক কাঁপিয়ে তুলে আমার মেহবুবর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তীব্র আক্রোশে তার হাত- পাগুলো কেটে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। হাতের তরবারিটা আর একবার তাঁর মাথার ওপর উঠে গেল। আমার মেহবুবা আর্তনাদ করে উঠল। আমি চোখ বন্ধ করলাম। যখন চোখ মেলে তাকালাম, দেখি তার দ্বিখণ্ডিত দেহটা জমাট বাঁধা খুনের মধ্যে
গড়াগড়ি খাচ্ছে।

হিংস্র দৈত্যটা হাতের খুন জড়ানো তরবারিটা প্রচণ্ড বিদ্বেষে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এবার আমার দিকে তাকিয়ে, হাড়িতে মুখ ঢুকিয়ে কথা বলছে এরকম গলায় বললো– শোন মনুষের বাচ্চা, আমাদের দৈত্য-সমাজের নিয়ম ব্যাভিচারিণীর একমাত্র শান্তি জান নেওয়া। মৃত্যু। হতচ্ছাড়ি লোচ্চার মাগীটাকে বিয়ের রাতে চুরি করে এখানে লুকিয়ে রেখেছিলাম। বিশ সাল সে আমাকে সঙ্গ দিল। আমি দিলাম দেহের সুখ। কিন্তু সে সুখ তার দিলটাকে ভরিয়ে দিতে পারল না। আমি বিশ বিশ্টা সাল ধরে যা পারি নি, একদিনেই তুমি তা পেরে
গেলে। তার দিলটাকে ধরতে পারলে। আমি অবাক মানছি বটে। কিন্তু নিজের চোখে তো কিছু দেখি নি। তোমাদের লোচ্চামি তো আর চোকের সামনে দেখতে পাই নি। কিন্তু আমার মন কইছে কি, আমার ধারণাই ঠিক বটে কিন্তু শুধুমাত্র ধারণার বশে তোমার জান আমি নিতে চাই না। তবে তোমাকে একেবারে রেহাই ও দেব না।
আমার যাদুবলে তোমাকে একটা জানোয়ার বানিয়ে দেব। তুমি নিজেই বল, কোন জানোয়ার তুমি হতে চাও?

নাই মামার চেয়ে কানা মামা তাও ভাল। ভাবলাম, তবু জানটা তো বাঁচলো। বাঘ, সিংহ, গাধা, খচ্চর—কোনটা হলে যে আমর সুবিধা হবে বুঝতে পারলাম না।

আমাকে ইতস্ততঃ করতে দেখে শয়তান দৈত্যটাঁ শোঁ শোঁ শব্দে বাতাসে ভর দিয়ে ভেসে গেল। পাহাড় থেকে এক মুঠো ধুলো নিয়ে ফিরে এল বিড়বিড় করে কি যেন সব বলে সেগুলো দিল আমার ওপর ছড়িয়ে । বাস, মুহূর্তে আমার বুকের তীব্র আলোড়ন শুরু হয়ে গেল। আমি মনুষ্যদেহ ছেড়ে বানরে পরিণত হয়ে গেলাম।
ছোটখাটো দেহ, চারটে পা আর বড় বড় লোমে জামার সর্বাঙ্গ ছেড়ে গেল। নচ্ছর দৈতাটা বিশ্রি সুরে হেসে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হায় আম'র নসীব। অগাধ বিদ্য, বুদ্ধি আর জ্ঞান নিয়ে আমি বানর জীবন যাপন করতে লাগলম। একেই বলে নসীবের ফের। মনের দুঃখে সমুদ্রের তীরে গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

একদিন গাছের ডালে বসে লম্বা লম্বা আঙুলগুলো দিয়ে গা চুলকাচ্ছি। এমন সময় একটা জাহাজকে তীরের কাছ দিয়ে যেতে দেখে তার মাস্তলে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। এক সময় নেমে গেলাম ডেকের ওপর। আমাকে দেখেই জাহাজের নাবিক আর লস্কর সাবাই লাঠি নিয়ে তেড়ে এল। একজন তরবারি উড়িয়ে ধরল। আমি কৌশলে তার হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে নিলাম। লোকগুলো হঠাৎ
ঘাবড়ে গেল আমি গালে হাত দিয়ে কাঁদতে লেগে গেলাম। তারা বুঝলো আমি আশ্রয়প্রার্থী।

জাহাজের ক্যাপ্টেন আমার মনের কথা বুঝলেন। আমি যে তাদের কোন ক্ষতি করতে চাইছি না, আশ্রয় ভিক্ষা করছি বুঝতে পারলেন। দেখা করলেন। আমাকে ডেকে নিজের কেবিনে নিয়ে
গেলেন। অমাকে তিনি যা যা বলেন, বুঝতে পারলাম সবই। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারলাম না। কিচির মিচির শব্দ করে, ঘাড় কাৎ করে, ইঙ্গিতে মাধ্যমত তাঁর কথার জবাব দিলাম।

ক্যাপ্টেনের অনুগ্রহে আমি তার ব্যক্তিগত নোকরের পদে নিযুক্ত হলাম। আমার কাজকর্মে কোন খুঁত রাখতাম না। ক্যাপ্টেন তো মহাখুশি।

পঞ্চাশ দিন এক নাগাড়ে জাহাজ চালিয়ে এক বন্দরে জাহাজ নোঙর করছেন।

দেশের সুলতানের আমিররা এসে ক্যাপ্টেনকে কুর্নিশ করলো। খাতির করল খুবই। তারা জানাল, দেশের উজির কিছুদিন হল বেহেস্থে যাত্রা করেছেন। দু'-চারদিন রোগভোগেই মারা গেছেন।
নানা বিদ্যায় বিশারদ একজন উজিরের খোঁজ করছেন সুলতান। তেমন কাউকেই পাচ্ছেন না, জাহাজে কোন সর্বগুণান্বিত ব্যক্তি থাকলে তিনি সুলতানের কাছে হাজির হতে পারেন।

কথা বলতে বলতে আমির ওমরাহর একটা জড়ানো কাগজ খুলে সুলতানের ইচ্ছার কথা ক্যাপ্টেনকে দেখালেন। ব্যস, জাহাজের ক্যাপ্টেন থেকে শুরু করে প্রত্যেক কর্মী আমার নাম লিখে তাতে সানন্দে স্বাক্ষর দান করলেন।

সুলতানের অমির ওমরাহরা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমার যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে আমি যাতে তাদের দ্বিধা দূর করতে পারি তার জন্য তাড়াতাড়ি দোয়াত কলম এনে আমার
সামনে রাখলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন।

আমি সুন্দর হস্তাক্ষরে কিছু শায়ের লিখে ফেলায়! আমার পণ্ডিত্যে তারা মুগ্ধ হ’ল। বিস্ময়বোধ করলো যার পর নাই। আমাকে নিয়ে হাজির করল সুলতানের সামনে। সুলতান আমার পাণ্ডিত্যে
মুগ্ধ হলেন। চকমকা পোশাক পরতে দিলেন। আমাকে উজির পদে বহাল করলেন। আর জাহাজের ক্যাপ্টেনকে প্রচুর মোহর ইনাম স্বরূপ পাঠিয়ে দিলেন। আমি ভূমিতে দু'হাত ছুঁইয়ে সুলতানকে সালাম জানালাম।

আমার জন্য সুন্দর একটা কুরশি বন্দোবস্ত করা হল। দেওয়া হ'ল কাগজ-কলম। আমি শায়ের লিখে লিখে সুলতানের হাতে তুলে দিতে লাগলাম। সুলতান তো পড়ে মহাখুশি। স্তম্ভিতও কম হন নি।

আমার অগাধ পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানগম্যির কথা সুলতান তার আদরের লেড়কীকে না জানানো পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। তাকে ডাকালেন। সে ঘরে ঢুকেই তাড়াতাড়ি ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল—
আব্বাজান, এক বিদেশীর সামনে আমাকে আচমকা হাজির করিয়ে তুমি ঠিক কাজ কর নি। তুমি যাকে বানত দেখছ, তিনি প্রকৃতপক্ষে বানর নন। এক বাদশাহের লেড়কা। ফার দেশের বাদশাহ। তার আব্বাজানের
নাম বাদশাহ ইফতি মারাস! আফ্রিদি দৈত্য জারসিজ যাদুবলে একে বানরে পরিণত করেছে। এর জ্ঞান বুদ্ধির তুলনা একমাত্র সাগরের সঙ্গেই চলতে পারে। নসীবের ফেরে আজ এ হেয় জীবন যাপন করছে, লোকের করুণার পাত্র হয়ে দিন গুজরান করছে।

সুলতান সব গুনে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি ঘাড় কাৎ করে জানালাম, যা শুনেছেন সবই সত্যি। আমার বিড়ম্বিত জীবনের কিস্সা শুনে সুলতান তো একেবারে থ বনে গেলেন। তিনি এবার লেড়কিকে জিজ্ঞেস করলেন, বেটি এত সব কথা তুমি কি করে জানলে, বল তো?

—যাদুবলে। আমার শৈশবে আমাকে দেখভাল করার জন্য যে বুড়ি পরিচারিকাকে রেখে দিয়েছিলে তিনি যাদুবিদ্যা খুবই ভাল জানতেন। আমাকে তাঁর বিদ্যার কিছু কিছু দান করেছিলেন। তারপর থেকে চৰ্চা চালিয়ে যাচ্ছি সবার অলক্ষ্যে। আব্বাজান, তুমি মন করলে, আমি এক লহমার তোমার এ সুবিশাল মহলটাকে অদৃশ্য করে দিতে পারি। আবার তোমার নগরটাকে বানিয়ে দিতে পারি বিশাল এক মরুভূমি। এক গন্ডুষ পানি কেবল দরকার। ব্যস, যা খুশি আমি করে ফেলতে পারি।

—ভারি তাজ্জব ব্যাপার দেখছি। তোমার যাদুবিদ্যার কথা বিন্দু বিসর্গও তো আমি জানতাম না। তবে এক কাজ কর, যাদুবিদ্যা প্রয়োগ করে তুমি এর আসল দেহ ফিরিয়ে দাও। আদমির দেহ দান কর। তার মত জ্ঞানী-গুণী তামাম দুনিয়ায় খুব বেশী আছে বলে মনে হয় না। আমি দরবারে তাকে পাকাপাকিভাবে উজির করে রাখতে চাচ্ছি।

সুলতানের লেড়কি রাজি হ'ল। আমার বুকটা খুশি-আনন্দে ভরপুর হয়ে গেল।

এমন সময় প্রাসাদের বাইরে, বাগিচায় পাখিদের ছুটোছুটি আর কিচির মিচির শুরু হয়ে গেল। বেগম শাহরাজাদ তার কিস্সা বন্ধ করলেন।


চতুর্দশ রজনী


রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে বাদশাহ শাহরিয়ার বেগমের কাছে ফিরে এলেন।

বেগম শাহরাজাদ তাঁর কিস্সা শুরু করতে গিয়ে বললেন—
শুনুন জাঁহাপনা, বড় মেয়েটার কাছে দ্বিতীয় কালান্দার নিজের জীবন কথার অবশিষ্ট অংশ বলতে গিয়ে বললেন-
শাহজাদী একটা ছুরি এলে তার ফলা দিয়ে মেঝেতে হিব্রুভাষায় কি যেন লিখল। এবার ছুরির ফলাটা দিয়েই তার চারদিক একটা বৃত্ত অঙ্কন
করল। তারপর অবোধ্য ভাষায় অনুচ্চ কণ্ঠে কি সব বলতে লাগল। ব্যস, দেখতে দেখাতে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। ভয়ানক দূর্যোগ। সারা বাড়িটা দুলতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে অন্ধকার কেটে গিয়ে স্বাভাবিকতা ফিরে এল। সবার চোখের সামনে দেখা দিল ভয়াল আফ্রিদি দৈত্য। নাম তার জারসিজ। শাহজাদী নির্বিকার, আর আমরা সবাই ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম।

আফ্রিদি জারসিজ কর্কশ স্বরে গর্জে উঠল - তোমার কাণ্ড আমাকে অবাক করেছে। যে-বিদ্যা আয়ত্ব করেছিলে তাকে তুমি ধরে রাখতে সক্ষম হলে না। আমাদের মধ্যে শর্ত হয়েছিল, কারো
কাজে আমরা প্রতিবন্ধকতা করব না, ক্ষমতাও জাহির করব না কারো বিরুদ্ধে। তুমিই কথা রাখলে না। এর জন্য উচিত শিক্ষা তোমাকে
পেতেই হবে।

কথা বলতে বলতে আফ্রিদি দৈত্য জারসিজ এক অতিকায় হিংস্র সিংহের রূপ পরিগ্রহ করল, আর শুরু করে দিল তীব্র গর্জন। সে কী গর্জন! আমার বুকের ভেতরে কলিজাটা তো দাপাদাপি শুরু করে
দিল।

শাহজাদীর জন্য আমি কম ভাবিত হয় নি! ভাবলাম হিংস্র জানোয়ারটা বুঝি এক্ষুণি তাঁর হাড়-মাংস চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।
কিন্তু সে-ও কমতি কিসে? মুহূর্তে নিজের মাথার একটা চুল ছিঁড়ে
নিয়ে বারকয়েক অনুচ্চকণ্ঠে কি যেন বললো। হাতের চুলটা সুতীক্ষ্ণ একটা তরকারিতে পরিণত হয়ে গেল। এক কোণে সিংহের মুণ্ডুটাকে ধড় থেকে নামিয়ে দিল। এবার ঘটল আরও অত্যাশ্চর্য এক
ঘটনা। সিংহের কাটা মুণ্ডুটা বিশাল একটা কাকড়া বিছের রূপ ধারণ করল। শহজাদীও যাদুর খেল দেখাতে লাগল। ইয়া বড় একটা বিষধর কালনাগিনীর রূপ পরিগ্রহ করে ফেললো। শুরু হ'ল কঁকড়া বিছে আর কালনাগিনীর তুমুল লড়াই। বেগতিক দেখে কাঁকড়া বিছেটা শকুনিতে পরিণত হ’ল আর কালনাগিনীটা ঈগলের রূপ পরিগ্রহ করল। আবার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শুরু হল। এতেও আফ্রিদি সুবিধা করতে পারল না। শকুনি বনবিড়ালে পরিণত হ'ল আর ঈগলটা নেকড়ে বাঘের রূপ ধারণ করল। এবার লড়াই করতে
গিয়ে বনবিড়ালটা বেশ বেকায়দায় পড়ে গেল। উপায়ান্তর না দেখে বিড়ালটা ইয়া পেপ্লাই একটা ডালিমের রূপ ধরে প্রাচীরের ওপর চলে গেল। নেকড়েটা প্রচিরের উপর উঠতেই ডালিমটা শুন্যে উঠে যেতে চেষ্টা করল। পারুল না; প্রাসাদের কার্নিশের গায়ে ধাক্কা খেয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। আর নেকড়ে বাঘটা? মুহূর্তে মুরগীর রূপ ধারণ করে ডালিমের দানাগুলো ঠোঁট দিয়ে টুকরে
ঠুকরে খেতে লাগল। একটামাত্র দানা বাদ দিয়ে বাকি সবগুলিই উদরস্থ করল। কিন্তু শেষ দানাটা মেঝের একটা ফাঁটলে সিঁধিয়ে গেল। ঠোঁট নিয়ে বের করার চেষ্টা করল। পারল না। আমাদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কি যেন বলতে চাইল। তার মনেরবকথা আমরা কেউই অনুধাবন করতে পারলাম না। পরে অবশ্য অনুমান করেছিলাম, শেষ দানাটা খাওয়ার জন্য পাথরটাকে আমাদের ভেঙে দিতে বলছিল। আর তারই ফলে আফ্রিদি দৈত্য জারসিজকে পুরোপুরি হজম করে ফেলতে পারত। কিন্তু নসীবেরভফের কে রুখবে।

দীর্ঘ নিরলস চেষ্টার পর পাথরের ফাটল থেকে যাও ডালিমের দানটিকে বের করে আনল তাও সেটা মুরগীটার ঠোঁট থেকে চৌবাচ্চার জলে ছিঁটকে পড়ল। ব্যস, সেটা সঙ্গে সঙ্গে একটা মাছে পরিনত হয়ে গেল। তবুও ছাড়া নেই। মুরগীটা এবার পানকৌড়ীতে পরিণত হয়ে মাছটাকে ধরার চেষ্টা করতে লাগল। আবার চললো তুমুল লড়াই। প্রায় ঘণ্টা থানেক পরে পানকৌড়ীটার আর দেখা
মিলল না। জল থেকে উঠে এল সেই অতিকায় আফ্রিদি 'দৈত্য জারসিজ। কিন্তু তার সেই বীভৎস রূপ আর নেই। জলন্ত অঙ্গার।
ধিক্‌ধিক্ করে আঙ্গার বলছে। আর নাক, মুখ আর চোখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে।

আমরা সবাই নীরবে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম সবার মনেই একই জিজ্ঞাস, শাহজাদীর কি হ'লা! আরও কয়েক মুহূর্ত পরে সে ধীরে ধীরে জল থেকে উঠে এল। সেই রূপ। রূপসী কুমারী যুবতীর সে রূপ নিয়ে জল থেকে উঠে এল। আগুনে দগ্ধ।

তারা উভয়েই আমাদের দিকে এগোতে লাগল। ভয়ে আমাদের কলিজা চিপসে গেল। কোথায় পালাব? পথ যে বন্ধ। কয়েক পা এগিয়েই অফ্রিদি দৈত্য জারসিজ ধড়াস্ করে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শাহজাদী তার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। আবার শুরু হ'ল তুমুল লড়াই। অতর্কিতে এক টুকরো অঙ্গার ছুটে এসে আমার বা চোখটাকে কানা করে দিল। আর একটা টুকরো এসে লাগল সুলতানের মুখে। কিছুটা অংশ পুড়ে গেল। কিছুক্ষণ বাদে আর একটা অঙ্গারের টুকরো এসে সুলতানের হারেমের খোজার বুকে আঘাত করল। সে মারা গেল।

এক সময় বেকায়দায় পড়ে আফ্রিদি দৈত্য জারসিজ বুকফাটা আর্তনাদ করে আল্লতাল্লার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে লাগল।
তার পরই তার অতিকায় দেহটা বিকট আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অঙ্গারের তেজ ক্রমে স্তিমিত হতে লাগল। তারপরই তার দেহটা ভষ্মে পরিণত হয়ে গেল।

শাহজাদী এবার গণ্ডুষ ভরে পানি নিয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্র আওড়ে আমার গায়ে ছিঁটিয়ে দিয়ে বলল 'তুমি তোমার আগের রূপ ধারণ করো। ব্যস, আমি বানর রূপ থেকে মনুষ্যরূপ ফিরে পেলাম। কিন্তু আমার বরবাদ হয়ে যাওয়া চোখটা ফিরে পেলাম না।
আবার সুলতানের মুখেও রয়ে গেল পোড়া দাগ।

শাহজাদী এবার সুলতানের দিকে সামান্য এগিয়ে এসে বিষাদপূর্ণ কাণ্ঠে বলল– আব্বাজী, এবার আমারও বিদায় নেবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমি যদি ডালিমের শেষ দানটি। উদরস্থ করতে পারতাম তবে আর কোন চিন্তাই থাকত না। আফ্রিদি দৈত্য জারসিয়া এর মৃত্যু ঘটত। হয়ত খোদাতালার এটাই মর্জি ছিল। আমার সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে আফ্রিদি সুবিধা করতে না পেরে
শেষ অস্ত্রটাকে আঁকড়ে ধরল। অগ্নিকুণ্ডের দরজা খুলে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি চাইনি সে আত্মঘাতী হোক। তবে তো তর আংশিক হলেও জয় হবে। তাই আমিও তার পিছন পিছন অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিলাম। আল্লার মর্জিই বটে। নইলে সে আত্মহত্যা করলে তো আমি নিশ্চিন্ত হতে পারতম। আগুনে ঝাঁপ দিতে যাব কেন? কথা  বলতে বলতে শাহজাদী মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ল। মুহূর্তে নিস্তেজ হয়ে গেল তার রূপ লাবণ্য আর আঠারো বছরের যৌবনভরা শরীরটা।

লেড়কীর আকস্মিক মৃত্যুতে সুলতান কেঁদে আকুল হলেন ! দু'চোখের কোল বেয়ে হরদম পানি গড়াতে লাগল। নিজের কাজের জন্য বহুভাবে অনুশোচনা প্রকাশ করতে লাগলেন। কেন সে বানরকে মানুষের রূপ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আকুল হয়েছিলেন সে-কথাই বুক চাপড়ে বার বার বলতে লাগলেন।

সুলতানের দরবারে, প্রাসাদে আর প্রজাদের ঘরে ঘরে নেমে এল শোকের ছায়া। কারো মনে সুখ নেই, নেই এতটুকু শান্তি।

সুলতানের এবার আমার উপর নজর পড়ল। তিনি চোখের পানি মুছতে মুছতে বল্‌লো – 'বাছা, তুমি আসাতেই আমার বুকের একটা পাঞ্জর খুলে গেল। যদিও আমার নসীবেরই ফের এটা, তবু তোমাকে বলছি, এ দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও তুমি বরং চলে যাও। তামার লেড়কী তো তার নিজের জান দিয়ে তোমাকে আফ্রিদি দৈত্য জারসিজ-এর হাত থেকে রেহাই দিয়ে, ফিরিয়ে দিয়েছে তোমার মানুষ্যরূপ। ব্যস, আর নয় তুমি আমার রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র চলে যাও।
দ্বিতীয় কালান্দর এবার বড় মেয়েটার দিকে ফিরে,
চপা ধীর্গশ্বাস ফেলে বললো-
বিশ্বাস করুন, আমার তখন নিজের ওপর খুব রাগ হ'ল। আমার জন্য এমন তরতাজা প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একটা লেড়কি অকালে জান দিল। খোদাতাল্লার দরবারে এখন কি গুনাহইনা আমি করেছি! অনুশোচনার জ্বালায় দিগ্ধ হতে হতে আমি সুলতানের প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। এবার শুরু হ’ল উদ্দেশ্যহীনভাবে পথ চলা। এভাবে এক সময় হাজির হলাম এ বাগদাদ নগরে।

বাগদাদে নাকি কারো কোনরকম দুঃখ নেই। দেশের ছোট-বড় প্রতিটা মানুষের জন্য এখানে যাবতীয় সুখের অঢেল ব্যবস্থা রয়েছে। এক সময় ফকিরের বেশে ক্লান্ত অবসহ দেহে বাগদাদের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এখানে এলাম। বাড়ি-গোঁফ কামিয়ে ইতিমধ্যেই আমি বিলকুল কালান্দর ফকির বনে গিয়েছি। এখন থেকে অদূরবর্তী
মোড়ের কাছে এসে আমারই মত এক কালান্দার ফকিরের সঙ্গে মোলাকাৎ হ'ল। তার দাড়ি-গোঁফ কামানো, বাঁ চোখ কানা। এবার তৃতীয় কালান্দার ফকিরকে দেখিয়ে বললো– একটু বাদে ইনি এসে
আমাদের সঙ্গে মিললেন। তৃতীয় কলান্দর। তারও দাড়ি-গোঁফ কামানো, তার বাঁ চোখ কানা।

অমর তিন কালান্দার মিলে পথ চলতে লাগলাম। এখানে এসে রাত্রের জন্য অশ্রয়ের খোঁজ করতে লাগলাম। সামনে এ-বাড়িটা দেখতে পেয়ে কড়া নাড়লাম।


দ্বিতীয় কালান্দার ফকিব বলল– 'আমার জীবনের সুখ-দুঃখ,বহাসি-কান্নার কথা তো শুনলেনই। আপনারা এবার যদি চান তৃতীয় কালান্দার ফকিরের জীবনের ঘটনাবলী শুনতে পারেন।