বড় লেড়কিটার নির্দেশে প্রথম কালান্দার তার কিস্সাটা শুরু করতে গিয়ে বলল—
আমি সবার আগে বলছি কেন আমার মুখ
দাঁড়ি গোফ শূন্য। আর আমার বাঁ চোখটা কেন কা’না তা-ও আপনা’র কাছে ব্যক্ত করব। আমি এক বাদশাহের ছেলে ছিলাম। অন্য অর এক দেশের বাদশাহ ছিলে আমার চাচা। অতএব বুঝতেই পারছেন আমি হেলা-ফেলার মতো ছিলাম না। যাকগে, অমার আব্বাজী আর চাচাজীর  মধ্যে খুবই মনের মিল ছিল। একটা ঘটনার দ্বারাই এর পরিচয় কিছুটা পেতে পারবেন। আমার জন্মের দিনই চাচাজীরও এক লেড়কা জন্মাল।

আমরা দু'ভাই কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে পা দিলাম। আমাদের পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী কিছুদিন বাদে বাদে আমরা চাষীর কাছে গিয়ে কিছুদিন করে থেকে আসতাম। শেষবার সেখানে যখন গিয়েছিলাম তখন আমার ভাইজান আমাকে
বলল, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। আশা করি অবশ্যই অমত করবে না। কথা দাও, না বলবে না।

আমার পেটে তখন সরাব। গলা পর্যন্ত। নেশায় বিভোর। আমি টলতে টলতে বল্লাম— খোদাতায়ালার নামে হলফ করে বলছি, তুমি
যা বলবে আমি হাসিমুখে সে 'তা-ই করব। বল কি তোমার কথা।

—এক কাজ কর, তুমি একে নিয়ে গোরস্তানের চালাটায় গিয়ে বোসো। আমি একটু বাদেই যাচ্ছি। আমার হাতে এক যুবতীকে তুলে দিয়ে কথাটা ছুঁড়ে নিল।

আমি খোদাতাল্লার নামে কসম খেয়েছি। কথা রাখতেই হ'ল। যুবর্তীটির হাত ধরে গোরস্তানে হাজির হলাম। চালাঘরটায় বসে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ বাদে সে-ও সেখানে গেল। তার এক হাতে কিছু প্লাস্টার আর অন্য হাতে জলের পাত্র। আর বোগলে ছিল একটা কুড়াল। চালাঘরটার অদূরে অভিকায় একটা পাথরের চাঁই পড়েছিল। সে কুড়াল দিয়ে পথরটাকে টুকরো করতে গিয়ে তাতে একটা সুড়ঙ্গের দেখা পেল। তারপর নিচের একটা পাথর সরিয়ে ফেলতেই সুদৃশ্য এক প্রাসাদ চোখে পড়ল।
আমার ভাইজান যুবতীটাকে নিয়ে সে সুড়ঙ্গ পথে নেমে গেল।

যাবার আগে তামাকে বলে গেল, ভাইজান, তুমি এ-জায়গা ছেড়ে যাবার আগে পাথরের টুকরোগুলো সুড়ঙ্গের মুখে দিয়ে প্লাস্টার দিয়ে লেপে দিয়ে যেয়ো। কেউ যেন বুঝতে না পারে এর তলায় কিছু আছে।

আমি তার অনুরোধে পাথর চাপা দিয়ে সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ করলম। প্লাস্টার দিয়ে লেপে যেমন ছিল ঠিক তেমনটি করে রেখে চাচাজীর প্রাসাদে ফিরে এলাম।

প্রাসাদে ফিরে শুনি চাচাজী শিকারে বেরিয়েছেন। সারা রাত্রি শুয়ে-বসে অস্থিরভাবে কাটালাম। আমার চাচা বা চাচাতো ভাইয়া কেউ-ই ফিরল না। বিশেষ করে চাচাতো ভাইয়া না ফেরায় আমার
মনটা বড্ড চঞ্চল হয়ে পড়ল। শেষ রাত্রের দিকে আমার গোরস্তানের সে পাথরটার কাছে গেলাম। তার খোঁজ করলাম, কোন হাসিই মিল না। বিষণ্ণ মনে প্রাসাদে ফিরলাম।

পর পর সাতটা দিন আমি নিদারুণ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে কাটালাম। কিন্তু আমার চাচাতো ভাইয়া তবু ফিরল না। শেষ পর্যন্ত হতাশ আর হাহাকার সম্বল করে আমি নিজের দেশে ফিরলাম।

আমাদের নিজের শহরে পা দিতেই আমাকে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হ'ল। একদল সশস্ত্র লোক অতর্কিতে আমাকে ঘিরে ফেল । আমি দেশের বাদশাহের ছেলে — শাহজাদা।
আর যারা আমাকে বন্দী করেছে সবাই আমার আব্বাজীর অনুগত কর্মচারী। নিজের দেশে, নিজের আব্বাজীর সৈন্যরা আমাকে বন্দী করায় বিস্মিত হবারই তো কথা।

আমার নিজের দুরবস্থার চেয়ে আব্বাজীর অমঙ্গল আশঙ্কার আমার বুকের মধ্যে কলিজাটি উথালি পাথলি করতে লাগল। ভাবলাম, তবে আব্বাজীর নির্ঘাৎ কিছু ঘটে গেছে। তিনি হয়ত ইহুলোকে আর নেই।

আমার ধারণা অমূলক নয়। এক সহাদয় সৈনিক আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে  বললেন— 'তোমার আব্বামী জানে বেঁচে নেই। উজির আর সেনাপতি চক্রান্ত করে তাকে নিকেষ করে দিয়েছে। উজির এখন মসনদে বসেছেন তাঁরই হুকুম তামিল করতে আমরা তোমার হাতে শেকল পরাতে বাধ্য হয়েছি।

আমি আব্বাজীর শোকে চোখের পানি ফেলতে লাগলাম। তারা আমাকে শেকল পরিয়ে উজিরের সামনে হাজির করল।

আমার ওপর উজিরের অনেক দিনের খার ছিল। উজির একদিন বাগানে পায়চারি করছিলেন। আমি পাখি শিকার করতে গিয়ে তীর ছুঁড়েছিলাম। তীরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। উজিরের চোখে গিয়ে বিধল।
ব্যস, একেবারে কানা। কিন্তু আমার বাবার ভয়ে আমার উপর কোন প্রতিশেধই নিতে পারলেন না!

শেকলবাঁধা অবস্থায় আমাকে উজিরের সামনে দাঁড় করানো হল।

উজির গর্জে উঠলেন—'কোতল কর। গর্দান নাও, খতম কর।

আমি সচকিত হয়ে বললাম— আগে আমাকে বলুন, আমার কি অপরাধ। তারপর আমার গর্দান নেন আপত্তি করব না।

এবার শান্তস্বরে উজির আমাকে কাছে যেতে বলেন। আমি এগিয়ে গিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়ালাম। তিনি আচমকা নখের আঘাতে আমার বাঁ চোখটা গায়েল করে দিলেন। গলগল করে খুন
বেরিয়ে এল। এতেও সন্তুষ্ট হতে পারল না। ঘাতকদের হুকুম দিলেন—
একে একটা কাঠের বাক্সে ভরে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাও। সেখানে টুকরো টুকরো করে কেটে মাঠের মধ্যে ফেলে রেখে দিয়ে আসবে। শেয়াল-কুকুর আর শকুন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাক একে। যা, নিয়ে যা।

বাক্সবন্দী অবস্থায় আমাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে এল।
আমাকে বাক্সটা থেকে টেনে হিচড়ে বের করল! চোখের যন্ত্রণায় আমি তখন ছটফট করছি। ভাবলাম, এরকম অসহ্য যন্ত্রণায় একদিন তো উজিরও কাৎরেছিলেন। একটা মানুষের চোখ কানা করে দেওয়া যে কী মর্মান্তিক কাজ। তা তখন আমি বেশী করে উপলব্ধি করলাম। তাই তিনি আমার চোখ কনা করেও তৃপ্ত হলেন না, মৃত্যু দন্ড দিয়ে পুরোপুরি প্রতিশোধ নিলেন।

ঘাতক আমার আব্বাজীর খুবই বিশ্বস্ত। অব্বাজীর কাছ থেকে উপকৃতও হয়েছে বহুবার। তাই আমাকে ছেড়ে দিল।তবে বার বার সাবধান করে দিল, আমি যেন ভুলেও দেশের মাটিতে কোনদিন পা না দিই। দিলে তার মৃত্যু অবধারিত।

আমাকে বাঁ চোখটা হারাতে হ’ল সত্য, কিন্তু জানটা রক্ষা হয়ে গেল।

পাহাড়, জঙ্গল আর মরুভূমি ডিঙিয়ে বহুৎ খুব তখলিফ সহ্য করে ফিরে এলাম চাচাজীর প্রাসাদে। আমার দুর্ভাগ্য এবং অব্বাজীর মৃত্যু সংবাদে তিনি বাচ্চা লেড়কার মত হাউহাউ করে কাঁদলেন, চোখের পানি ঝরালেন।

চাচাজীর মনে তখন লেড়কার শোক জগদ্দল পাথরের মত চোপে বসেছে। কতজনকেই সে লেড়ঙ্কার কথা পুছতাছ করেছেন, তা গল্পগাথা নেই। কিন্তু কেউ তার হদিশ দিতে পারে নি।

চাচার চোখের পানি আর দীর্ঘশ্বাস আমাকে কাতর করে তুললো। অনন্যোপার হয়েই তার লেড়কার সে কাণ্ডকারখানার কথা বললাম।

চাচাজী আমার মুখে সবশুনে ব্যস্ত পায়ে সে গোরস্তানে গেলেন। আমাকে এবং কিছু সৈন্য সামন্তও সঙ্গে নিলেন। অনেক চেষ্টার পর সে রহস্যজনক সুড়ঙ্গটার হদিস মিললো। অতিকায়
পাথরের চাঁইটা সরিয়ে আমরা সুড়ঙ্গটার মধ্যে সিঁধিয়ে গেলাম। সুড়ঙ্গ-পথে সামান্য নামতেই অমরা ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম। জমাট বাঁধা ধোঁয়া কুগুলি পাকিয়ে ওপরে উঠতে
লাগল। চাচাজী আমাকে অভয় দিতে গিয়ে বললেন কিছু ডর নেই। খোদার নাম জপ কর। সব ভয় কেটে যাবে।

ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হতে সুবিশাল এক ঘরে আমরা পৌঁছে গেলাম। এক পাশে একটা পালঙ্ক। আমার চাচাতো ভাই আর সে রহস্যময়ী নারী পরস্পরকে আলিঙ্গন করে গভীর নিদ্রায় মগ্ন।
মশারী টাঙানো ছিল। কাছে গিয়ে মশারীর একটা কোণ তুলতেই আমার সর্বাঙ্গে অভাবনীয় কম্পনের সৃষ্টি হ’ল। শরিলের সব কটা স্নায়ু যেন এক সঙ্গে ঝনঝনিয়ে উঠল। দেখলাম, আমার চাচতো ভাই
আর মেয়েটা উভয়েই ভষ্মীভূত।

আমার চাচাজী, উন্মাদের মত কেঁদে উঠলেন। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে লাগলেন—
তোর উচিত শাস্তি হয়েছে রে হতচ্ছাড়া। খোদাতাল্লা তোর বিচার করবেন। তোর যোগ্য স্থান দোজাক। তুই দোজাকেই যা। কথা বলতে বলতে চাচাজী পা থেকে চপ্পল খুলে উন্মাদের মত মৃত ও ভষ্মীভূত লেড়কাকে পিটাতে লাগলেন।

বেগম শাহরাজাদ কিস্সার এটুকু বলার পর থামলেন। জানলার বাইরের বাগিচায় ইতিমধ্যেই ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটতে শুরু করেছে।


দ্বাদশ রজনী

রাত্রী দ্বিতীয় প্রহর শুরু হতে না হতেই বাদশাহ শাহরিয়ার অন্দরমহলে, বেগমের কাছে এলেন।

শাহরাজাদ কিস্সা শুরু করলেন-  কালান্দর বাদশাহ হারুণ-অল-রসিদ, উজির জাফর, কুলি-যুবক প্রমুখের সামনে তাঁর জীবনের করুণাতম দিনগুলোর কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে
বলল আমার চাচা পায়ের চপ্পল খুলে আমার মৃত চাচাতে ভাইয়ের মাথায় আঘাত করামাত্র মাথাটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে কাট-কয়লার মতো ছড়িয়ে পড়ল। আমি চাচাজীকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করলাম।

চাচাজী চোখ মুছতে মুছতে বললেন—  কার গুণাহের জন্য আমার লেড়কার এ রকম হাল হয়েছে, জান? আর তার পাশে নসিব বিড়ম্বিত লেড়কীটাই বা কে জান? আমার লেড়কী। শৈশব
থেকেই সে বহিনের সঙ্গে অনাচার করছে। কী গুণাহ ভেবে দেখ।
তো খোদা এ রকম গুনাহ কখনও মাফ করবেন ভেবেছ? আমি তাকে বহুভাবে শাসন করেছি, মারধোর করেছি, ভয়ও কম দেখাইনি কিছুতেই কিছু হল না। পরকালে দোজাকেই হবে তার একমাত্র স্থান। এরকম ডরও বহুবার দেখিয়েছি। কিন্তু পরিণতি ভষ্মে ঘি ঢালা।

চাচাজী আবার হাউমাউ করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন— বেটা, তুই আর আমি একই রকম অভাগা তোর আব্বাজী গেছে আর আমার গেছে লেড়কা। আজ থেকে তুই-ই আমার বেটা। আজ থেকে তুই আমাকে আব্বাজী ডাকবি।
আমরা প্রাসাদে ফিরে এলাম।

প্রসাদে পা দিতেই শেনা গেল, সীমান্তে শত্রু সৈনা জড়ো হয়েছে। চাচাজীর রাজ্য আক্রমণ করেছে। আমরা সাধামত যত শীঘ্র সম্ভব সৈন্য প্রস্তুত করে নিলাম। বৃথা চেষ্টা ইতিমধ্যে, শত্রুসৈন প্রবল বিক্রমে নগরে ঢুকে পড়েছে। আকস্মিক প্রবল আক্রমণের মুখে আমাদের সৈনারা খড়কুটোর মত উড়ে গেল।

আমাদের বুঝতে দেরী হ'ল না, আক্রমণকারী আমার আব্বাজীর হত্যকরী।

সে-উজির চাচাজীর রাজ্য আক্রমণ করেছে শুনে আমার মাথায় খুন চেপে গেল। অস্ত্র ধারণ করে লড়াইয়ে নামার জন্য বদ্ধপরিকর হলাম। কিন্তু মুখোমুখি লড়াইয়ে নামা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে আমাকে দেখতে পেলেই তাঁর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য আমি। দাঁতে দাঁত চেপে আমাকে হত্যা করার চেষ্টায় মেতে উঠবে।

অতর্কিতে আমার মাথায় একটা ফন্দি খেলে গেল। ব্যস্ত হাতে ক্ষুর চালিয়ে আমার মুখের দাড়ি-গোঁফ চেঁছে ফেল্লাম। গায়ে একটা ছেঁড়া পশমের চাদর জড়িয়ে নিলাম। এবার ভিক্ষাপাত্র হাতে ভিক্ষা করতে করতে বেরিয়ে গেলাম নগর থেকে।

আমি অশেষ ক্লেশ সহ্য করে বাগদাদ নগরে হাজির হলাম। অনেকেরই মুখেই খলিফা হারুণ-অল-রসিদের কথা শুনেছি। আর তিনি আল্লাহ-র পয়গম্বর। এত বড় নগর বাগদাদ। রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না। কোথায় গেলে সে মহাত্মার দেখা পাবো ভাবছি।
দ্বিতীয় কালান্দার-এর দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে আবার বললো— পথের বাঁকে ওনার দেখা পেয়ে গেলাম। এবার তৃতীয় কালান্দার'কে দেখিয়ে বলল— আমরা দু'জনে যখন কথা বলছি তখনই ইনি
সেখানে উপস্থিত হলেন। আমরা সবাই এখানে পরদেশী। তাই রাত্রিটুকু কাটাবার ইচ্ছায় আপনার বাড়ির কড়া নাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম।

আশা করি আপনারা আমার বাঁ-চোখ কানা হওয়া এবং দাড়ি- গোঁফহীন মুখের কাহিনী শুনে সত্য ঘটনা বুঝতে পারলেন।

প্রথম কালান্দার-এর কথায় প্রীত হয়ে বড় মেয়েটা তাঁকে মুক্তি দিল।