বেগম শাহরাজাদ এবার বললেন— 'বহিনজী, এর চেয়ে আরও অনেক ভাল ভাল কিস্সা আমার ঝোপায় রয়েছে। এবার শোন, এক কুলি আর তিন লেড়কির কিস্সা।'

বাগদান নগর।
কোন এক সময়ে বাগদাদ নগবে এক সুদর্শন যুবক একাকী বাস করত। তার পেশা হিল কুলিগিরি। সে ছিল একদমই একা। তিনকুলে তার ছিল না বলতে কেউ-ই ছিল না। শাদীও করেনি।

এক সকালে কুলি যুবকটা একটা খালি ঝুড়ি নিয়ে রাস্তায় বসেছিল। যদি কোন আমির মালপত্র বয়ে দেবার জন্য তাকে তলব করে, এ আশাতেই তার এখানে বসে থাকা।

এমন সময় সে দেখতে পেল এক রূপসী যুবতী তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার রূপের আভা ঠিকরে পড়ছে। কুলিটার কাছে এসে ওড়নাটা সামান্য সরিয়ে বলল “কি গো, যাবে নাকি?”

একে রূপসী-যুবর্তী, তার ওপর এমন মিষ্টি মধুর সুরেলা কণ্ঠে বললো— কি গো, যাবে নাকি?
কথা তো নয়, যেন সুগন্ধি ফুলের মধু কেউ তার কানে ঢেলে দিয়েছে।

যুবক কুলিটা পাশ থেকে ঝুড়িটা হাতে তুলে নিয়ে যুবতীটিকে অনুসরণ করল।

রূপসী যুবতীটা কিছু দূর গিয়ে রাস্তার ধারের এক বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। এক বৃদ্ধা দরজা খুলে দিল। তার হাতে কয়েকটা দিনার দিয়ে রূপসী যুবতীটি বললো– এক বোতল ভাল সরাব নিয়ে
এসো।'

বৃদ্ধা দিনার ক'টা ট্যাঁকে গুজে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই এক বোতল সরাব নিয়ে বৃদ্ধা ফিরে এল। রূপসী যুবতীর হাতে তুলে দিল সেটা।

যুবতীটা সরাবের বোতলটাকে ঝুড়িতে দিয়ে আবার ব্যস্ত পয়ে হাঁটতে লাগল। কুলিটা তাকে অনুসরণ করে পথ চলতে লাগল।

কিছুটা পথ গিয়ে ফলের দোকান থেকে বহুরকম ফল কিনে কুলির ঝুড়িতে তুলে দিল। ফলওয়ালাকে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়ে আবার হাটা জুড়ল। কিছুটা পথ পাড়ি দিতে না দিতেই এক মস্ত মাংসের দোকানে ঢুকে পাঁচ সের মাংস কিনে ঝুড়িতে বোঝাই করল। তারপর মিষ্টির দোকানে ঢুকে ভাল কিছু মিষ্টি কিনে কুলির ঝুড়িতে দিল। তার সওদা করার রকমসকম দেখে কুলিটা রীতিমত অবাক হয়ে গেল।

কুলিটা এবার তার মনের বিরক্তিটুকু নিজের কাছে জমা রেখেই মুচকি হেসে বলল– আগে যদি এরকম হবে শুনা থাকত, তবে না হয় একটা খচ্চর ভাড়া করে দিতাম। তুমিই বল, এত সব মালপত্র কি একজন মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব?

কুলির মজার কথা শুনে রূপসী যুবতী ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটিয়ে কেমন নীরবে মিটি মিটি হাসলো। মুখে কিছুই বললো না।

আবার হাঁটতে শুরু করলো যুবতিটি। কুলিটা ঝুড়ি মাথায় তাকে অনুসরণ করতে লাগল। যুবতীটা এবার একটা আতরের শিশি, গোলাপ পানি আর দশ বোতল পরিষ্কার দামী মদ কিনে ঝুড়িতে
রাখল। এবার একটি বড় সড় পিচকিরি কিনল সে। সব শেষে কিনল আলেকজান্দ্রিয়ার সুন্দর সুন্দর কিছু মোমবাতি।

কুলিটা এবার মালবোঝাই ঝুড়িটা মাথায় নিয়ে সেই যুবতীর পিছন পিছা ইঁটতে লাগল। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এক সুরমা অট্টালিকার সামনে এসে দাঁড়াল। দরজায় টোকা দিল বার কয়েক। দরজাটা হাট হয়ে খুলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে এক কিশোরী। উদ্ভিন্না কিশেরী। তার গা থেকে রূপের আভা যেন ছিটকে বেরোচ্ছে। দেহে যৌবনের সমাগম ঘটলে নিঃসন্দেহে এক রূপ- সৌন্দর্যের আকরে পরিণত হবে। কুলিটা মাথা থেকে ঝুড়িটা নামাতে নামাতে
আড়চোখে কিশোরীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নিল। তার কোমর স্বাভাবিকের চেয়ে সরু। সুগঠিত স্তন দুটো সবে একটু একটু করে উঁকি দিচ্ছে। ঘাসের ফাঁক দিয়ে ছোট ছোট ফুল যেন উঁকি দেয় ঠিক তেমনি এ দুটোকে মনে হ’ল কুলি যুবকটার চোখে। চোখ দুটো হরিণীর মতই টানা টানা। উন্নত নাসিকা। আপেলের মত লালচে আভা গাল দুটোতে সুস্পষ্ট। সব মিলিয়ে তার কুসুম কোমল সেই পল্লবটি পুরুষের দেহ-মনকে কাছে টানে। দেয় শাস্তি- সুখের প্রতিশ্রুতি।

কুলিটা বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে আপন মনে বলে উঠল— 'সাত সকালেই এমন অপরূপা যুবতী কিশোরীর মুখোমুখি দাঁড়ানোর সৌভাগ্য খোদাতাল্লার আশীর্বাদ ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। হায় খোদা! তোমার মেহেরবানীর হদিস মানুষের অজানা।

যুবতী এবার তুলতুলে কোমল সুদৃশ্য পা দুটো ধীর-মন্থর তালে ফেলে ফেলে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। কুলিটা তাকে অনুসরণ করল। সুসজ্জিত এক বিশালায়তন ঘর। ঘরের একধারে মনলোভা
কারুকার্য শোভিত পালঙ্কের ওপরে মখমলের চাদর বিছানো। তারই উপরে শুয়ে আর এক অপরূপা। ঘুমে অচৈতন্যা। তার কামিজটা পায়ের দিকে একটু বেশী রকমই উঠে গেছে। মেয়েটা পিছন ফিরে
শুয়ে। তার ভারি ও চওড়া নিটোল নিতম্ব দুটো যেন ছাঁচে গড়া। কোন সুদক্ষ শিল্পী যেন নিপুণভাবে গড়ে তুলেছে। দুটো পাহাড়ের ঢেউ যেন বার বার বাঁধা পেয়ে নেমে এসেছে পাদদেশের দিকে।
সরু কোমরটা ধীর- মন্থর গতিতে, সবদিকে সমতা বজায় রেখে ক্রমে চওড়া হতে হতে নিতম্ব দুটোর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আবার ওপরের দিকেও সৃষ্টিকর্তা একই নির্মাণ-কৌশল
প্রয়োগ করেছেন। কোমর থেকে ক্রমে চওড়া হতে হতে বুক আর পিঠটাকে মনলোভা করে তৈরী করা হয়েছে। নিতম্বের ও পরের অনাবৃত কটিদেশ আর গ্রীবার অংশ বিশেষের অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে যুবক–কুলিটা যেন নিজেকে নিঃশেষে হারিয়ে ফেললো। এমন সময় তার বরাত আরও খুলে গেল এক ঝটকায়। মেয়েটা ঘুমের ঘোরেই অধিকতর স্বস্তির প্রত্যাশায় পাশ ফিরল। কুলিটার বুকের ভেতরে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চের আবির্ভাব ঘটল।

মনে হ’ল কলিজাটা বুঝি উসখুসানি শুরু করে দিয়েছে। এক লাস্যময় তার কুসুম-কোমল মুখাবয়ব প্রত্যক্ষ করা মাত্রই তার বুকের ভেতরে
এমন অভাবনীয় তোলপাড়ানি শুরু হয়ে গেছে, রোমাঞ্চে মন-প্রাণ আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। বিস্ময়াভিভূত কুলিটা আপন মনে বলে উঠল
- ‘মুখ নয় তো যেন শিশিরে ভেজা আধ– ফোটা পদ্ম, মেঘমুক্ত প্রভাতের শুকতারা। আর--- না, আর ভাবতে পারল না সে। তার সর্বাঙ্গ যেন কেমন শিথিল হয়ে আসছে।

রূপসী তন্বী যুবতীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। চকিত চপল চোখ দুটো মেলে তাকাল। সুরেলা কন্ঠে বললো
মূর্তির মত দাঁড়িয়ে যে!’ এবার তার বহিনজীর দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল ‘ওর মাথায় অতবড় একটা বোঝা, নামিয়ে দাও!'

কথা বলতে বলতে অপরূপা বিছানা ছেড়ে নেমে এল। দু’জনে ঝুড়িটা ধরাধরি করে কুলির মাথা থেকে নামাল। বড়জন দুটো দিনার কুলিটার দিকে এগিয়ে দিল। কিন্তু বিদায় জানিয়ে ঘর থেকে বেরনো তো দূরের কথা কোন কথাও বলতে পারল না। কেবল বিস্ময় মাখানো দৃষ্টি মেলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বহু বাঞ্ছিতা অপরূপাদ্বয়ের মুখের দিকে।

বড় লেড়কিটা বললো- 'কিগো, তোমার প্রাপ্য তো বুঝেই পেয়েছ, তবে আবার দাঁড়িয়ে যে বড়? মজুরি আরও কিছু চাচ্ছ কি?
ঠিক আছে, এই নাও আর এক দিনার।
কুলিটা যেন এবার সম্বিৎ খুঁজে পেল। সে ব্যস্ত হয়ে বললো—
‘না, মজুরির ব্যাপার নয়। আমার মজুরি মাত্র এক দিনার। তোমরা এমনিতেই দু'দিনার দিয়েছ। আবার কেন দিতে যাবে?'
- ‘তা-ই যদি হয় তবে যে এখনও দাঁড়িয়ে?’

— 'দেখ, যদি কিছু মনে না কর একটা কথা জিজ্ঞেস করি। তোমাদের কারো দেহেই রূপ বা যৌবন কোনটারই অভাব নেই, যে কোন যুবকের মন জয় করার পক্ষে যথেষ্ট। তবু তোমরা একা
থাক কেন, ভাবছি! কোন পুরুষ তোমাদের সঙ্গে নেই কেন? কোন কিছু যদি ভোগ করাই না যায় তবে তা থাকা আর না থাকা তো সমান কথাই। তোমাদের দেহের এ অঢেল রূপ আর অফুরন্ত
যৌবনের কি-ই বা মূল্য? আর রূপ থাক আর না-ই থাক যৌবন যখন আছে তার ভাড়না তো কম-বেশী থাকতে বাধ্য। মানুষ কামনা আর লালসার বশ, কথাটা তো মিথ্যা নয়। কোন পুরুষকে যদি নারী
তার দেহসুধা পান করাতে না পারে, তবে তার জীবই তো বৃথা।
নিজেকে পুরুষের কাছে মেলে ধরা, নিঃশেষে বিলিয়ে দেয়ার মাধ্যমেই তো লেড়কিদের কামতৃষ্ণা নিবৃত্ত করার একমাত্র উপায়।

— 'আমরা! কুমারী, আজও কুমারীত্বকে সযত্নে পোষণ করছি। পর-পুরুষের সান্নিধ্য আমাদের বিপদ ঘটাতে পারে। মজা লুঠে পালিয়ে যাবে। আর তার কৃতকর্মের দায় ভার বইতে হবে আমাদের। এরকম আশঙ্কাতেই আমরা সতর্কতার সঙ্গে পুরুষদের এড়িয়ে চলেছি, আজও চলছি।'
বড় লেড়কিটা বললো।

—তোমরা আমার ওপর আস্থা রাখতে পার। বিশ্বাসঘাতকতার লেশমাত্রও পারে না। অরও এমন সব কথা বলতে লাগল যাতে করে স্পষ্টই বুঝা গেল, খোদাতালার মর্জিতে কুলিগিরি করে বটে কিন্তু কালির অক্ষর কিছু পেটে আছে।

কুলি যুবকের কথা ও আচরণে! যুবতী তিনজনই খুব মুগ্ধ হ'ল। মেজো লেড়কিটার মধ্যে একটু দুষ্টুমি বুদ্ধি ভর করল। সে বড়টার কানে কানে বল – একে নিয়ে একটু রঙ্গ তামাশা করলে কেমন হয়?' বড় লেড়কিটা এবার কুলিটাতে বলল– কি গো, সঙ্গে মালকড়ি আছে কিছু? খালি হাতে তো আর মজা লোটা যায় না।'

—সে আমি পাব কোথায়, বল তো! কুলিগিরি করে দিন চালাই, দেখতেই তো পাচ্ছ। আর যেটুকু আছে তা তোমাদের কাছে হাতের ময়লার সামিল। কি ই বা তোমাদের কাজে লাগবে, বল?
ঠিক আছে– ‘কথা বলতে বলতে সে ঝুড়িটা হাতে তুলে নিয়ো এবার বেরোবার উদ্যোগ করল। ঠিক তখনই মেজো লেড়কিটা আচমক! তার একটা হাত ধরে ফেলল। ছিঃ! পুরুষ মানুষের এত গোসা করলে কি চলে! আর পয়সা ছাড়া মেয়েদের খুশি করা যায়, শুনেছ কোথাও? পত্তি ফেল, মজা লুঠো।' কথাটা বলেই সে মন মাতাল করা হাসিতে ফেটে পড়ার জোগাড় হ’ল। বড় লেড়কিটাও
তার সঙ্গে যোগ দিল।

বড় বহিনদের কাণ্ড দেখে ছোট লেড়কিটা বেশ রাগত স্বরেই বলল-
'তোমরা একে সোজা-সরল পেয়ে কী আরম্ভ করেছ, বলতো? সওদা করতে গিয়ে তো নোটের বান্ডিল উড়িয়ে এলে।

তোমাদের কাছে যদি পয়সাটাই বড় হয় তবে এর হয়ে আমিই তোমাকের চাহিদা পূরণ করে দেব। কেমন পেশীবহুল এর শরীল আর কেমন চওড়া ছাতিটা। এ একাই আমাদের তিনজনের পিয়াস
মেটাতে পড়বে।

মেজো মেয়েটা বললো- “কি রে, তুই যে একেবারে মজে গেছিস দেখছি! যাক গে, চুলোয় যাক এর টাকাকড়ি : পাত্তির দরকার নেই।' এবার সে কুলি যুবকটার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলল এসো গো মনের মানুষ, আমরা এবার একটু মন খোলসা করে গল্পটল্প করি।'

অন্য দু'বহিনও এবার তাকে সমর্থন করল। সুরার পাত্র আর পেয়ালা নিয়ে এল। পেয়ালার পর পেয়ালা সুরা উজাড় হতে লাগল। আর সে সঙ্গে হাসি ঠাট্টা-মস্করার জোয়ার বয়ে চললো।

কয়েক পেয়ালা সুরা গলায় ঢেলে কুলি যুবকটা খোশ মেজাজে গান ধরল। তার কিন্নর কণ্ঠের গানে তিন বোন তন্ময় হয়ে গেল আর এক পেয়ালা সুরা এনে ছোট লেড়কিটা তার ঠোটের কাছে
ধরল। এক নিঃশ্বাসে পেয়ালটা উজাড় করে দিয়ে সে এবার গানের তালে তালে নাচতে লেগে গেল।

লেড়কি তিনটাও আর নিজেদের সামলে রাখতে পারল না। তারা পালা করে যুবকটার কোমর ধরে নাচতে লাগল। তার কিন্তু বড় লেডবিটার দিকেই আকর্ষণ বেশী। বার বার তাকে জড়িয়ে ধরেই নাচতে থাকে। ব্যাপারটা তার মনঃপুত হল না। ঈর্ষা চেপে রাখতে পারল না। মুখ পোড়া করে দাঁড়িয়ে রইল। দু চোখ দিয়ে দাবানল ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল। ছোট লেড়কিটা অস্থির হয়ে পড়েছে। সে মাথা ঠিক রাখতে না পেরে কুলি-যুবকটাকে দমাদ্দম কিল-চড় মারতে আরম্ভ করল! আর রাগে ফুলতে লাগল।

কুলি যুবকটা বাধ্য হয়ে পালা করে তিন বহিনকেই জড়িয়ে ধরে নেচে আনন্দ দিতে লাগল। কিছুক্ষণ এভাবে সুখদান ও সুখলাভের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে এক সময় সে মেজো লেড়কিটাকে আলতো করে
কাঁধ্যে ওপর তুলে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। বারান্দা পেরিয়েই ফুল বাগিচা। হাজারো রূপ আর গন্ধের বিচিত্র সমাবেশ ঘটেছে বাগিচার গাছে গাছে। যেন কোন দৈত্য সবার অলক্ষ্যে স্বর্গোদ্যানটাকে ভুলে নিয়ে এসে এখানে বসিয়ে দিয়েছে।

কুলি যুবকের আচরণে ছোট লেড়কি রেগে একেবারে কাঁই হয়ে গেল। সে উন্মাদিনীর মত ছুটে গিয়ে তার চুল ধরে টানতে লাগল, দয়াদম কিল-চড় ঘুষি মেরে আনন্দের ঘাটতিটুকু পুরণে প্রয়াসী হ'ল। তার নরম হাতের স্পর্শ গুসি যুবকটির মধ্যে ক্রোধের পরিবর্তে পুলকের সঞ্চারই করল।

এদিকে দীর্ঘ সময় ধরে কুলি যুবকের পৌরুষ দীপ্ত দেহের ছোঁয়া পেয়ে পেয়ে মেজো লেড়কিটার মধ্যে এক অনাস্বাদিত ভাবান্তর ঘটাতে থাকে। সে নিজের দেহ পল্লবটাকে তার কাঁধ থেকে নামিয়ে নিয়ে এসে প্রশস্থ বুকের সঙ্গে নিজেকে লেপ্টে নিল। গলাটা জড়িয়ে ধরে আবেগে উচ্ছ্বাসে অভিভূত হয়ে পড়ল। মাদকতায় পরিপূর্ণ চোখ দুটো মেলে অপলক দৃষ্টিতে তার ভরা যৌবনকে দেখতে লাগলো । তুলতুলে নরম ও রক্তাভ ওষ্ঠ দুটোকে এগিয়ে নিয়ে গেল কুলি যুবকটার পৌরুষ ভরা ওষ্ঠ দুটোর কাছে। কখন যে উভয়ের উষ্ঠ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তারা কেউ বুঝতেও পারে নি। কামোন্মাদনা বশত লেড়কিটা যুবকের নিচের ওষ্ঠটা কামড়ে ধরল। জোরে.. আরও জোরে। দাত প্রেম বোঝে না, মায়াও নেই তার। দাঁতের কাজ দাঁতগুলো করল। যুবকের নিচের ওষ্ঠটায় দাঁত বসে গেল। তিরতির করে রক্ত বেরোতে লাগল। কিছুমাত্র হুঁস কারো নেই। পুরুষের ওষ্ঠের রক্তের স্বাদ সে এই প্রথম পেল!
আরও শক্তি প্রয়োগ করে সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরল যুবকটার নগ্ন ও প্রশস্ত বুকটাকে। একজন পুরুষ মানুষের শরীরে এত শান্তি-সুখ যে লুকিয়ে থাকতে পারে তা সে এর আগে কোনদিন বোঝে নি।

যুবকটার বুকের মধ্যে ইতিমধ্যে মহাসাগরের তুফান শুরু হয়েছে। সে তাঁকে আঁকড়ে থাকা মেজে লেড়কিটাকে নিয়ে মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়ল। আর ছোটটাকে নিচে শুইয়ে দিল।
তার সদ্য উঁকি দেওয়া যৌবনের দিকে অপরুক চোখে তাকিয়ে রইল। লেড়কিটার চোকের তারায় কাছে টানার ইঙ্গিত! ঠোটে দুষ্টুমি ভরা হাসি। অসহ্য যন্ত্রণা। বুকের ভেতরে জ্বলন্ত আগুন। আর বাইরে
পিষ্ট হবার দুরন্ত বাসনা। যুবকটা কখন কৃপা করবে সে প্রতীক্ষায় থাকা' তার পক্ষে সাধ্যাতীত। অধৈর্য হাতটা দিয়ে তার পেশীবহুল লাঞ্চিত হাতটাকে জড়িয়ে ধরল। অস্থিরভাবে নিজের বুকের ওপরে
রাখল। দু' হাতে জাপ্টে ধরে শরীরের সর্বশক্তি নিয়োগ করে চাপ প্রয়োগ করল। দলন-পেষণের জন্য সে একেবারে মাতোয়ারা।

উদ্যানের কেন্দ্রস্থলে এক মনোরম সরোবর। সাদা আর লাল পদ্মের বিভিন্ন সমরোহ ঘটেছে সরোবরের পানিতে। ফুরফুরে হাওয়ার তালে তালে আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছে তার স্বচ্ছ পানি। বড়
লেড়কিটা সরোবরের ধারে এসে দাঁড়াল। তার চোখের তারায় অবর্ণনীয় মাদকতা ভর করেছে। বাতাসে তিরতিরকারে দুলছে তার গায়ের ওড়নাটা। না, বৃথা কালক্ষয় করতে রাজি নয় সে। এক ঝটকায় গা থেকে উড়নটা খুলে নিয়ে ঘাসের ওপর ছুঁড়ে ফেললো। এবার খুব ব্যস্ত হাতে খুলে ফেলল কামিজের বোতাম ক'টা। শরীর থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেললো সেটাকে। ভেতরের সরু একফালি অস্ত্রবাস ছাড়া আর কিছুই রইল না তার যৌবনভরা দেহপল্লবে। উন্মাদিনী প্রায় সে নেমে গেল জ্বলে। অঞ্জলিভরে জল নিল। যুবকটার গায়ে
বার বার ছিটিয়ে দিতে লাগল। আর চোখের ভাষায় বলতে লাগল-
ওগো, মনময়ূর, সরোবরের জল আমার কলিজার জ্বালা নিভাতে অক্ষম। চলো, তুমি নেমে এসো। একমাত্র তোমার উষ্ণবক্ষই আমার দেহ-মনের জ্বালা নেভাতে পারবে।

কিন্তু কে যাবে? কি করেই বা যাবে তার পিয়াস মেটাতে। যুবকটার দেহ-মন যে অসার হয়ে পড়েছে। ভেজা পোশাক পরিচ্ছদ গায়ে নিয়েই অলস অবশ হয়ে সরোবরের তীরে সে পড়ে রয়েছে।

মেহবুবার দিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে নগ্ন প্রায় বড় লেড়কিটা জল থেকে উঠে এল। এক চিলতে কাপড় যা তার ভরা যৌবনটাকে কোনরকমে সামলে-টামলে রোখেছিল, জলে ভিজে যাওয়ায় তা-ও যেন অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। তাই উদ্ভিগ্ন
যৌবনচিহ্ন এখন স্পষ্টতর হয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠেছে। বাঁধনমুক্ত হয়ে ফুটে উঠেছে।

জল থেকে উঠে এসেই বড় লেড়কিটা আছাড় খেয়ে পড়ে অচৈতন্য প্রায় যুবকটার ওপর। মুহূর্তে যুবকটার মধ্যে সংজ্ঞা ফিরে আসে। সে তার সুদৃঢ় হাত দুটো বাড়িয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কমোম্মাদিনী বড় লেড়কিটাকে তার বক্ষের ঊষ্ণতা ভেজা কাপড়ের চিলতেটার শৈত্যকে লোপ করে দিয়ে যুবকের প্রশস্ত বক্ষের আড়ালে ডুব দিল। যেন হারিয়ে যেতে, নিজেকে নিঃশেষে উজাড় করে দেওয়াতেই তার যত আনন্দ, যত সুখ। মেয়েটা যুবকের পেশীবহুল হাতের পেষণে বার বার কুঁকিয়ে উঠতে থাকে। তবু তার বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে উৎসাহী নয় মোটেই। পুরুষের
হাতের পেষণ, দলন তার নির্যাতনের মাধ্যমেই যৌবন জ্বালা, দেহের কামনা - বাসন পরিতৃপ্তি লাভ করে।

এক সময় বড় লেড়কিটার অবসন্ন দেহপল্লবটা যুবকের বুকের ওপর ঢলে পড়ে।

মেডো লেড়কি এবার নিজেকে বসনমুক্ত করে বাঁপিয়ে পড়লো সরোবরের জলে। কিছু সময় অস্থিরভাবে সাঁতার কাটলো। তারপর ব্যস্ত পায়ে উঠে এল জল থেকে। ঝাপিয়ে পড়লে কামোম্মাদনা লাঘবের উদ্দেশে যুবকটার ওপর। আবার শুরু হ’ল দলন, পেষণ, মাতন, সম্ভোগ।

এবার আসন্ন যৌবন ছোট লেড়কিটা সরোবরের পানিতে কয়েক মুহূর্ত কাটিয়ে উঠে এল। ঘাসের ওপর এলিয়ে পড়ে থাক যুবকটার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। শুরু হলো পূর্নরীতি অনুসারে দাপাদাপি ঝাঁপাঝাঁপি দীর্ঘ সময় ধরে যুবকটার কাছ থেকে সঙ্গসুখ নিঙড়ে নিয়ে ঘাসের ওপর এলিয়ে পড়ল তার তাজা ফুলের মত দেহটা।

কুলি-যুবকটা কিছুক্ষণ পরিতৃপ্ত দেহ-মনে ঘাসের ওপর এলিয়ে পড়ে থাকার পর উঠে বসলো, ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নামল সরোবরে। দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করে সাফসুতরা হয়ে উঠে এল।
বড় লেড়কির শিয়রে গিয়ে বসল। তার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললো– 'সুন্দরী, তোমাকে ছেড়ে যাওয়া যে আমার পক্ষে সম্ভব নয়।'

লেড়কিটা তার কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে বললো- তুমি যেতে চাইলেই বা আমি ছাড়ব কেন। একবার যখন তোমাকে বুকে ঠাঁই দিয়েছি তখন আর তোমাকে ছাড়ব, ভাবছ কি করে মেহবুব
আমার?

ভাবাপ্লুত মনে টুকরো টুকরো কথা বলতে বলতে তারা যে কখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল তা নিজেরাই জানে না। আর হবে না-ই বা কেন? কয়েন্ট ঘণ্টা ধরে দেহ ও মন উভয়ের ওপর দিয়ে
যে কী ধকল গেছে তা আর কইতব্য নয়।

সন্ধ্যার কিছু পরে বড় লেড়কিটার ঘুম ভাঙল। অন্য সবাইকে ডাকাডাকি করে তুললো।

কূলি যুবকটা ঘুম থেকে উঠে বিদায় নেবার জন্য প্রস্তুতি নিল।

কিন্তু যেতে চাইলেই বা তাকে যেতে দেয় কে? তিন বোনই তাঁর পথ আগলে দাঁড়াল। একটিমাত্র রাত্রি তাদের সঙ্গদান করার জন্য বর বার মিনতি জানাল। তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করা তার পক্ষে
সম্ভব হ'ল না। বাধ্য হয়েই সেখানে তাকে রয়ে যেতে হ'ল।

বড় লেড়কিটা কুলি যুবকটার হাত ধরে ভাবাপ্লুত কণ্ঠে বলল— 'নাগর আমার, চল তোমাকে একটা জিনিস দেখাব। দরজার পাল্লায় কি লেখা রয়েছে, দেখবে চল।'

“দরজার কাছাকাছি গিয়ে বড় লেড়কিট দরজার পাল্লার গায়ের একটা লেখার দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করল। সেখানে লেখা রয়েছে– তোমার কাছে সুখদায়ক কি বিষাদময় তা নিয়ে ভেবো না। যা
করার নির্দেশ দেবে তা-ই নির্বিবাদে পালন করবে। অন্যের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতে যেয়ো না।'

কুলি যুবকটা লেখাটা পড়ার পর বললো-
আমি এর আদেশ অমান্য করবো না, কথা দিচ্ছি।

ইতিমধ্যেই প্রাসাদের বাইরের বাগানে পাখিদের কলরব শুরু হয়ে গেছে। বেগম শাহরাজাদ কিসসা বন্ধ করলেন।



দশম রাত্রি।


বাদশাহ শাহরিয়ার-এর অনুরোধে বেগম শাহরাজাদ তাঁর কিস্সা শুরু করলেন––
এদিকে রাত্রি গভীর হওয়ার আগেই মেয়ে তিনটা
কুলি যুবকটাকে নিয়ে খানাপিনা করতে বসলো। সবে তার খাবারের প্লেটটা কাছে টেনে নিয়েছে এমন সময় দরকার কড়া নড়ে উঠল।

বড় লেড়কিটা উঠে দরজা খুলে দিলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হাসি হাসি মুখে ফিরে এসে বলল– আজ যে কা'র মুখ দেখে সকাল হয়েছিল তাই ভাবছি। তিনজন বিদেশী আমাদের বাড়িতে
থাকতে চাইছে। কারো মুখেই দাড়ি-গোঁফ দেখলাম না। আর সবারই বাঁ চোখ কানা। আর তাতে কলুর বলদের মত ঠুলি বাঁধা। রমদেশের অধিবাসী বলেই মনে হ'ল। ভালই হল। তারা থকলে সারা রাত
ধরে আনন্দে দেহ সুখ মিটিয়ে নেওয়া যাবে।

তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই ছোট লেড়কিটা এক দৌড়ে গিয়ে আগন্তুকদের ভেতবে নিয়ে এল। আগন্তুকরা ভেতরে ঢুকে যুবকটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তাকে ভাল করে দেখে দিল। তারপর নিজেদের মধ্যে অনুচ্চ কণ্ঠে
বলাবলি করল— 'এ-যুবকটাও বোধ হয় আমাদের মতই কালান্দার ফকির, এখানে আশ্রয় নিয়েছে।"

এবার প্রচুর খানা আর কয়েক বোতল মদ দিয়ে তিন বহিন কালান্দার ফরিদের আপ্যায়ন করল।

খানাপিনা সারার পর তিন বহিন কালান্দরদের গান শোনাবার জন্য বায়না ধরল। কালান্দররা গাইবার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। এমন সময় আবার দরজায় কড়া নড়ে উঠলো।


খলিফা হারুন-অল রসিদ নগর পরিক্রমায় বেরিয়েছেন। প্রতিরাতেই এরকম বেরোন। তবে এক একদিন এক এক অঞ্চলে যান। আজকে এদিকের পালা। খলিফা একা নন। তাঁকে সঙ্গদান
করেন উজির, জাফর -অল-বারমাকি, আর যুবক তরবারি বাহক মসরুর। প্রজাদের সুখ-সুবিধা অসুবিধা সমস্যা প্রভৃতি সচক্ষে প্রত্যক্ষ করার জন্যই তাঁর এরকম মহৎ প্রায়াস। এ পথ দিয়ে যাবার সময় বাড়িটার ভেতর থেকে গান-বাজনার শব্দ শুনে ব্যাপার কি জানার জন্য তাঁর কৌতূহল হ’ল। উজির জাফর-অল-বারমাকিকে বললেন— 'বাড়ির ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা কর। তবে আমার
পরিচয় যেন বুঝতে না পারে।'

উক্তির জাফর অল বারমাকি এগিয়ে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লেন। ছোট লেড়কি দরজা খুলে দিল। উজির বললেন—'বাছা, আমরা তিবারিয়া দেশের সওদাগর। স্থানীয় এক সওদাগরের বাড়িতে উঠেছি। সামান্য লটবহর যা ছিল সব তার বাড়িতে গচ্ছিত রেখে নগরটা ঘুরে দেখার জন্য বেরিয়েছিলাম। এখন অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছি। বাড়িটা ঠিক চিনতে পারছিনা। আজকের রাত্রিটা তোমাদের এখানে আশ্রয় দিলে বড়ই উপকার হয়। খোদা তোমাদের ভালই করবেন।'

তাদের দাঁড় করিয়ে রেখে ছোট লেড়কিটা ভেতরে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে ফিরে এল। আশ্রয় প্রার্থীদের অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে গেল।

তাঁরা ভেতরে যেতেই বড় লেড়কিটা দরজার লেখাটা তাঁদের পড়তে বললো। পড়া শেষ হলে তারা বলেন—হ্যা, আমরা এ-শর্ত মেনে নিতে রাজি আছি।'

এবার তাদের নিয়ে গিয়ে কালান্দারদের পাশে বসতে দিল।
খলিফা ও তাঁর সঙ্গীদের জন্য খানা আর দামী সরাব নিয়ে এল!
খলিফা বললেন— 'বাছা, আমি যে হজযাত্রী। এসব স্পর্শ করি না।'
এবার তাঁর জন্য গোলাপ পানির সরবৎ বানিয়ে আনল।
বলিফা দেখলেন কালান্দারদের প্রত্যেকেরই বাঁ চোখ কানা।

এবার বড় লেড়কিটা কুলি যুবকটাকে নিয়ে পাশের ঘরে গেল। দুটো নিকষ কালো কুকুরকে শেকলে বেঁধে নিয়ে এল। দুটোই মাদি কুকুর। এবার কুলি যুবকটাকে একটা চাবুক ধরিয়ে দিয়ে বললো– চালাও চাবুক। এ মাদিটাকে কয়েক ঘা বেশী দেবে। শুরু হল সপাং হাপাং চাবুকের ঘা। মাদি কুকুরটা অসহ্য যন্ত্রণায় কেঁই কেঁই শুরু করে দিল। এবার তাকে কুলি যুবকটার হাত থেকে ছিনিয়ে
দিয়ে এসে দ্বিতীয় কুকুরটাকে চাবুক মরতে বললো। কুলি যুবকটা আবার নিষ্ঠুর ভাবে চাবুক চালাতে লাগল। তারপর তাকে ছিনিয়ে নিয়ে আবার প্রথম কুকরটাকে এগিয়ে দিল। এভাবে পলা করে চাবুকের ঘা মরার ব্যবস্থা করা হ'ল।

হলিফা এবার সবিস্ময়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে উজির জাফরকে বলেন— 'লেড়কিটাকে জিজ্ঞেস করে দেখ তো কুকুর দুটোর ব্যাপার কি?

উজির বল্‌লেন—'জাহাপনা, এ ব্যাপারে কৌতূহল প্রকাশ না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।'

মেজো বহিন এবার ছোট বহিনের হাত ধরে বললো— চল, আমরা প্রতি রাত্রের মত প্রচলিত প্রথা অনুসারে যা যা করা দরকার, সব করি।'

ছোট লেড়কিটা একটু বটুয়া নিয়ে এল। তার ভেতর থেকে একটা বাঁশি বের করল। সুর করে বাজাতে শুরু করল।

কিছুক্ষণ বাজাবার পর মেজো বাইনটা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, থামো থামো বহিন। খোদাতাল্লা তোমাকে কঠোর শাস্তি দিবেন।

এক সময় সে উন্মাদের মত নিজের পোশাক আশাক ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো। সংজ্ঞা হারিয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

লেড়কি তিনটার ব্যাপার দেখে খলিফা হারুণ-অল-রসিদ-এর কেঁদে উঠল।

এবার বড় লেড়কিটা তার চোখে-মুখে জলের ছিটা দিয়ে সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনল। নতুন পোশাক পরিয়ে দিল।

খলিফা হারুণ-অল-রসিদ আবার উজির জাফর-এর কানের কাছে মুখ নিয়ে আগের মতই ফিসফিসিয়ে বলেন— 'লেড়কির সারা গায়ে চাবুকের দাগ। কেমন কালসিটে পড়ে গেছে লক্ষ্য করেছো?

উজির জাফর বলেন—জাঁহাপনা, মুখ বুঝে সবকিছু দেখে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

খালিফা হারুণ অল-রসিদ এবার বলেন – তা না হয় হ'ল। কিন্তু মাদি কুকুর দুটোকে চাবুক মারা আর তার পিঠের কালো দাগগুলো আমার মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করছে। রহস্য! গভীর
রহস্য। এর রহস্যভেদ আমাকে করতেই হবে।'

জাঁহাপনা, দরজার ওই শপথ বাক্যের কথা ভুলে যাবেন না। কেন কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার অর্থ হচ্ছে শর্ত লঙ্ঘন করা।

এবার মেজো লেড়কিটা ওই বাঁশিটা বাজাতে আরম্ভ করল। সেই করুণ মর্মান্তিক সুর' পূর্ব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল; সে তার পোশাক আশাক ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল। বাস, সংজ্ঞা
হারিয়ে ফেললো। সারা গায়ের চাবুকের দাগ খলিফা হারুণ অল-রসিদ-এর চোখের সামনে ভেসে উঠল। বড় মেয়েটা আবার পূর্ব কৌশলে তার চোখে-মুখে জলের ছিটা দিল। সে সংজ্ঞা ফিরে পেল।

একই পদ্ধতি অনুসরণ করে তিন তিনবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটান হ'ল।

খলিফা হারুণ-অল-রসিদ আর কৌতূহল দমন করতে পারলেন না। তিনি আগের মতই অনুচ্চ কণ্ঠে কালান্দারদের বলেন— 'মশাইয়া, রহস্যটা কি বলতে পারেন?'

--'আমরা তো আরও ভাবছিলাম, আপনাকে পুছতাছ করব?
— তাই বলুন, আমাদের মত আপনারাও এখানে প্রথম এসেছেন?
—'আমর মনে হয়, ওই যুবকট! কিছু জানলেও জানতে পারে।'
তাঁদের কথোপকথন কুলি যুবকটা শুনতে পেল। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সে বলে উঠল- 'আমিও আপনাদেরই মতই এখানে প্রথম এসেছি।
আপনারা এসেছেন রাত্রে আর আমি এসেছি দুপুরের কিছু পরে। ব্যাস, এটুকুই যা তফাৎ। এর চেয়ে বরং পথের ধারে শুয়ে রাত্রি কাটনো অনেক ভাল ছিল মশাই।

তারা সাতজন একমত হলেন। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা দরকার, জানা দরকার আসল রহস্যটা কি। তারা সংখ্যার সাতজন পুরুষ মানুষ। আর তারা মাত্র তিনজন। তা-ও আবার মেয়েছেলে। এত ভয়ের কি আছে? তাদের কাছে কৈফিয়ৎ চাইতেই হবে। আর দরজার গায়ে লেখা শর্ত?
কালান্দরদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল—'আমরা শর্ত পালন না করলে লেড়কি তিনটাকে অপমান করা হবে না তো আবার? তার চেয়ে বরং অবশিষ্ট রাক্তিটুকু কোনরকমে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে সুবহ হতে না হতেই আমরা যে যার পথে চলে যাব।'

এবার উজির জাফর বললেন— ঘণ্টা খানেক বাদে আমরা এখান থেকে কেটে পড়ব। আর আপনার কাছে অন্ততঃ ব্যাপারটা অজ্ঞাত থাকবে না। আজ না হয় কাল জানতে পারবেনই।'

—'আমার পক্ষে এত সময় অপেক্ষা করা সম্ভব নয়!

সবাই উসখুস করছে ব্যাপারটা জানার জন্য। সমস্যা দেখা দিল,
পুছতাছ করবে কে? অনেক কথার পর ঠিক হ’ল কুলি যুবকটাই তাদের কাছে এর কারণ জানতে চাইবে।

কুলি যুবকটা বার কয়েক ঢোক গিলে বললো— “তোমাদের কুকুর দুটোর ব্যাপার কি, আমরা জানতে চাইছি। কেন তাদের এরকম নিমর্মভাবে চাবুক মারলে? কেনইবা আবার তাদের আদর করলে?
তোমাদের শরীরে চাবুকের কালসিটে পড়া দাগ কি করে হ'ল?'

—এটা কি তোমার একার, নাকি সবারই কৌতূহল?”
—একমাত্র জাফর ছাড়া আমরা সবাই ব্যাপারটা নিয়ে বড়ই ভাবিত।
——তোমরা শর্ত ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত। আতিথ্য গ্রহণের আগে দরজার লেখা পড়ে শর্ত করেছিলে। তোমাদের শর্তভঙ্গের শাস্তি পেতেই হবে।' কথা বলতে বলতে বড় লেড়কিটি হাতের চাবুকটা
দিয়ে তিনবার মেঝেতে আঘাত করা মাত্রই সাতজন গাট্টাগোট্টা  দৈত্যের মত বিশালদেহী নিগ্রো ঘরে ঢুকল। ক্রোধে তর্জন গর্জন শুরু করে দিল। সবার হাতেই চকচকে তরবারি।

বড় লেড়কি হুকুম দিল—'এদের একটার সঙ্গে আর একটা পিঠমোড়া করে বাঁধ।' চোখের পলকে নিগ্রো দৈত্যগুলো হুকুম তামিল করল।

কুলি যুবকটা কেঁদে কেটে বলল— 'আমায় তোমরা কোতল করো না। সর্বনাশের মূল এক চোখওয়ালা কালান্দর ফকিরগুলো।
তারা এখানে না থাকলে এসব কিছুই ঘটত না।'

বড় লেড়কিটা হো হো করে হাসতে শুরু করল।

বেগম শাহরাজাদ জানলা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই বুঝতে পারল ভোরের আলো ফুটতে আর দেরী নেই। সেবকিস্সা বন্ধ করল। বাদশাহ শাহরিয়ার বেগমের কোলে মাথা রেখে
ঘুমিয়ে পড়লেন।


একাদশ রাত্রি


বাদশাহ শাহরিয়ার যথাসময়ে বেগম শাহরাজাদ-এর ঘরে এলেন।

ছোটবোনের আগ্রহে বেগম শাহরাজসদ কিস্সা শুরু করলেন—
শুনুন জাহাপনা। বড় বোন সরবে হেসে উঠলে সবাই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে উঠল। সবার মনেই এক ভাবনা, কি হয়— কি হয়।' হাসি থামিয়ে সে বললো— তোমাদের অসহায় অবস্থার কথা
ভেবে রাত্রিবাসের জন্য আশ্রয় দিয়েছিলাম। যাগগে। এবার তোমরা সবাই এক এক করে আত্মপরিচয় দাও। তোমাদের কথায় যদি বুঝি
তোমরা সত্যই বিপদে পড়ে আশ্রয় ভিক্ষা করনি তবে তোমাদের মৃত্যু অবধারিত।

বড় মেয়েটা এবার কালান্দার ফকির তিন জনকে লক্ষ্য করে বলল – বল তো, তোমরা কি সহোদর ভাই?'

—'না মালকিন। আমরা তিনজন তিন দেশের বাসিন্দা। আমরা সর্বত্যাগী। বিষয় সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই। কোনরকমে জানটাকে টিকিয়ে রেখেছি।

—“তোমরা কি জন্ম থেকে কানা? নাকি পরবর্তীকালে একটা করে চোখ--
তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই একজন কালান্দার বলে উঠল—'না। আমি কানা হয়ে জন্মাই নি। জন্মের পর এক অবিশ্বাস্য কান্ডের ফলে চোখটাকে হারাতে হয়েছে।'

বাকি দু'জনও একই কথা বললো। তাদের জীবনও বৈচিত্র্যময় ঘটনায় ভরপুর।

বড় লেড়কিটা এবার আগ্রহান্বিত হয়ে বলল- তোমাদের জীবনের বিচিত্র ঘটনাগুলো আমি শুনতে আগ্রহী, তোমরা এক এক করে তোমাদের জীবন কাহিনী আমাকে শোনাও। তোমাদের কথা
শুনে আমি যদি বুঝি তোমরা সত্যই দয়া পাওয়ার যোগ্য তবে মুক্তি দিয়ে দেব। অন্যথায়—

কুলি যুবকটা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠল—
আমি সত্যই গরিব, দীন দুঃখী কিনা তা-তো তোমাদের অজানা নয়। আমার জীবনের অত্যাশ্চর্য ঘটনা বলতে যা কিন্তু সবই আজ দিনের বেলাতেই ঘটেছে। তা-তো তোমরা ভালই জান। আর সে কথা দশ জনের সামনে, এরকম ভরাহাটে বলা সমীচীনও নয়। তাই বলছি কি আমাকে ছেড়ে দাও।

– ভাল কথা, তুমি এখনকার মত রেহাই পেলে, তোমার কথা পরেই না হয় শুনব। যাও, বিশ্রাম করগে।

– না, আমি এ জায়গা ছেড়ে যাব না। অবশ্যই না, এদের কাহিনী শুনব।'