আমার  কণ্ঠ হতে গান কে নিল ভুলায়ে,
সে যে  বাসা বাঁধে নীরব মনের কুলায়ে॥

মেঘের দিনে শ্রাবণ মাসে
যূথীবনের দীর্ঘশ্বাসে
আমার-প্রাণে সে দেয় পাখার
ছায়া বুলায়ে॥

যখন  শরৎ কাঁপে শিউলিফুলের হরষে
নয়ন  ভরে যে সেই গোপন গানের পরশে।

গভীর রাতে কী সুর লাগায়
আধো-ঘুমে আধো-জাগায়,
আমার  স্বপন-মাঝে দেয় যে কী দোল
দুলায়ে॥





আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।
খেলে যায় রৌদ্র ছায়া,
বর্ষা আসে বসন্ত ॥

কারা এই সমুখ দিয়ে
আসে যায় খবর নিয়ে,
খুশি রই আপন মনে--
বাতাস বহে সুমন্দ ॥

সারাদিন আঁখি মেলে
দুয়ারে রব একা,
শুভখন হঠাৎ এলে
তখনি পাব দেখা।

ততখন ক্ষণে ক্ষণে
হাসি গাই আপন-মনে,
ততখন রহি রহি
ভেসে আসে সুগন্ধ ॥





আমায় অভিমানের বদলে আজ

আমায়  অভিমানের বদলে আজ
নেব তোমার মালা।
আজ  নিশিশেষে শেষ করে দিই
চোখের জলের পালা॥

আমার  কঠিন হৃদয়টারে ফেলে
দিলেম পথের ধারে,
তোমার  চরণ দেবে তারে মধুর
পরশ পাষাণ-গালা॥

ছিল  আমার আঁধারখানি,
তারে তুমিই নিলে টানি,
তোমার  প্রেম এল যে আগুন হয়ে--
করল তারে আলা।  

সেই-যে  আমার কাছে আমি ছিল
সবার চেয়ে দামি
তারে  উজাড় করে সাজিয়ে দিলেম
তোমার বরণডালা॥




আমায় বাঁধবে যদি কাজের ডোরে

আমায় বাঁধবে যদি কাজের ডোরে
কেন পাগল কর এমন ক'রে ?।

বাতাস আনে কেন জানি
কোন্‌ গগনের গোপন বাণী,
পরানখানি দেয় যে ভ'রে ॥

সোনার আলো কেমনে হে,
রক্তে নাচে সকল দেহে।

কারে পাঠাও ক্ষণে ক্ষণে
আমার খোলা বাতায়নে,
সকল হৃদয় লয় যে হ'রে ॥





আমার দোসর যে জন ওগো তারে

আমার দোসর যে জন ওগো তারে
কে জানে
একতারা তার দেয় কি সাড়া আমার গানে
কে জানে॥

আমার  নদীর যে ঢেউ ওগো
জানে কি কেউ
যায় বহে যায় কাহার পানে।
কে জানে॥

যখন বকুল ঝ'রে
আমার কাননতল যায় গো ভ'রে
তখন কে-আসে-যায় 
সেই বনছায়ায়,
কে সাজি তার ভরে আনে।
কে জানে॥





আমার নাইবা হল পারে যাওয়া

আমার নাইবা হল পারে যাওয়া।
যে হাওয়াতে চলত তরী
অঙ্গেতে সেই লাগাই হাওয়া ॥

নেই যদি বা জমল পাড়ি
ঘাট আছে তো বসতে পারি।
আমার  আশার তরী ডুবল যদি
দেখব তোদের তরী-বাওয়া ॥

হাতের কাছে কোলের কাছে
যা আছে সেই অনেক আছে।
আমার  সারা দিনের এই কি রে কাজ--
ওপার-পানে কেঁদে চাওয়া।

কম কিছু মোর থাকে হেথা
পুরিয়ে নেব প্রাণ দিয়ে তা।
আমার  সেইখানেতেই কল্পলতা
যেখানে মোর দাবি-দাওয়া ॥



আমার  না বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে

আমার  না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে
তোমার ভাবনা তারার মতন বাজে ॥

নিভৃত মনের বনের ছায়াটি ঘিরে
না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে,
আমার  লুকায় বেদনা অঝরা অশ্রুনীরে--
অশ্রুত বাঁশি হৃদয়গহনে বাজে ॥

ক্ষণে ক্ষণে আমি না জেনে করেছি দান
তোমায় আমার গান।
পরানের সাজি সাজাই খেলার ফুলে,
জানি না কখন নিজে বেছে লও তুলে--

তুমি  অলখ আলোকে নীরবে দুয়ার খুলে
প্রাণের পরশ দিয়ে যাও মোর কাজে ॥





আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে

আমার       প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
              তাই হেরি তায় সকল খানে॥
আছে সে    নয়নতারায় আলোকধারায়,    তাই না হারায়--
ওগো         তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
              তাকাই আমি যে দিক-পানে॥

আমি          তার মুখের কথা শুনব ব'লে গেলাম কোথা,
              শোনা    হল না, হল না--
আজ         ফিরে এসে নিজের দেশে এই-যে শুনি
শুনি         তাহার বাণী আপন গানে॥

কে তোরা   খুঁজিস তারে  কাঙাল-বেশে  দ্বারে দ্বারে,
              দেখা    মেলে না মেলে না,--
ও তোরা    আয় রে ধেয়ে  দেখ্‌ রে চেয়ে  আমার বুকে --
ওরে         দেখ্‌ রে আমার দুই নয়ানে॥





আমার প্রাণে গভীর গোপন

আমার প্রাণে গভীর গোপন
মহা-আপন সে কি,
অন্ধকারে হঠাৎ তারে দেখি ॥

যবে দুর্দম ঝড়ে আগল খুলে পড়ে,
কার সে নয়ন-'পরে নয়ন যায় গো ঠেকি ॥

যখন আসে পরম লগন
তখন গগন-মাঝে তাহার ভেরী বাজে।
বিদ্যুত-উদ্ভাসে বেদনারই দূত আসে,
আমন্ত্রণের বাণী যায় হৃদয়ে লেখি ॥





আমার ব্যথা যখন আনে আমায়

আমার  ব্যথা যখন আনে আমায় তোমার দ্বারে
তখন  আপনি এসে দ্বার খুলে দাও, ডাকো তারে ॥

বাহুপাশের কাঙাল সে যে,
চলেছে তাই সকল ত্যেজে,
কাঁটার পথে ধায় সে তোমার অভিসারে ॥

আমার  ব্যথা যখন বাজায় আমায় বাজি সুরে--
সেই  গানের টানে পারো না আর রইতে দূরে।
লুটিয়ে পড়ে সে গান মম  ঝড়ের রাতের পাখি-সম,
বাহির হয়ে এসো তুমি অন্ধকারে ॥




আমার মন কেমন করে

আমার  মন কেমন করে--
কে জানে, কে জানে, কে জানে কাহার তরে॥

অলখ পথের পাখি গেল ডাকি,
গেল ডাকি সুদূর দিগন্তরে
ভাবনাকে মোর ধাওয়ায়
সাগরপারের হাওয়ায় হাওয়ায় হাওয়ায়।

স্বপনবলাকা  মেলেছে পাখা,
আমায়  বেঁধেছে কে সোনার পিঞ্জরে  ঘরে॥





আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়

আমার  ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়
পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন!
তারি গলার মালা হতে
পাপড়ি হোথা লুটায় ছিন্ন ॥

এল যখন সাড়াটি নাই,
গেল চলে জানালো তাই--
এমন ক'রে আমারে হায়
কে বা কাঁদায় সে জন ভিন্ন ॥

তখন  তরুণ ছিল অরুণ আলো,
পথটি ছিল কুসুমকীর্ণ।
বসন্ত যে রঙিন বেশে
ধরায় সে দিন অবতীর্ণ।

সে দিন খবর মিলল না যে,
রইনু বসে ঘরের মাঝে--
আজকে পথে বাহির হব
বহি আমার জীবন জীর্ণ ॥