আমার মিলন লাগি তুমি
আসছ কবে থেকে!
তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়
রাখবে কোথায় ঢেকে?।

কতকালের সকাল-সাঁঝে
তোমার চরণধ্বনি বাজে,
গোপনে দূত হৃদয়-মাঝে
গেছে আমায় ডেকে ॥

ওগো পথিক, আজকে আমার
সকল পরান ব্যেপে
থেকে থেকে হরষ যেন
উঠছে কেঁপে কেঁপে।

যেন সময় এসেছে আজ
ফুরালো মোর যা ছিল কাজ--
বাতাস আসে, হে মহারাজ,
তোমার গন্ধ মেখে ॥




আমার  মন যখন জাগলি না রে

আমার  মন, যখন জাগলি না রে
ও তোর  মনের মানুষ এল দ্বারে।
তার  চলে যাওয়ার শব্দ শুনে ভাঙল রে ঘুম--
ও তোর  ভাঙল রে ঘুম অন্ধকারে ॥

মাটির 'পরে আঁচল পাতি
একলা কাটে নিশীথরাতি।
তার  বাঁশি বাজে আঁধার-মাঝে,
দেখি না যে চক্ষে তারে ॥

ওরে,  তুই যাহারে দিলি ফাঁকি
খুঁজে তারে পায় কি আঁখি?
এখন  পথে ফিরে পাবি কি রে
ঘরের বাহির করলি যারে?।





আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে

আমার  সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে
ফুল ফুটবে।
আমার  সকল ব্যথা রঙিন হয়ে
গোলাপ হয়ে উঠবে ॥

আমার  অনেক দিনের আকাশ-চাওয়া
আসবে ছুটে দখিন-হাওয়া,
হৃদয় আমার আকুল করে
সুগন্ধধন লুটবে ॥

আমার  লজ্জা যাবে যখন পাব
দেবার মতো ধন,
যখন  রূপ ধরিয়ে বিকশিবে
প্রাণের আরাধন।

আমার  বন্ধু যখন রাত্রিশেষে
পরশ তারে করবে এসে,
ফুরিয়ে গিয়ে দলগুলি সব
চরণে তার লুটবে ॥





আমার যে সব দিতে হবে

আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি--
আমার যত বিত্ত, প্রভু, আমার যত বাণী ॥

আমার চোখের চেয়ে দেখা, আমার কানের শোনা,
আমার হাতের নিপুণ সেবা, আমার আনাগোনা--
সব দিতে হবে ॥

আমার প্রভাত, আমার সন্ধ্যা হৃদয়পত্রপুটে
গোপন থেকে তোমার পানে উঠবে ফুটে ফুটে।
এখন সে যে আমার বীণা, হতেছে তার বাঁধা,
বাজবে যখন তোমার হবে তোমার সুরে সাধা--
সব দিতে হবে ॥

তোমারি আনন্দ আমার দুঃখে সুখে   ভ'রে
আমার ক'রে নিয়ে তবে নাও যে তোমার ক'রে।
আমার ব'লে যা পেয়েছি শুভক্ষণে যবে
তোমার ক'রে দেব তখন তারা আমার হবে--
সব দিতে হবে ॥




আমার মুক্তি আলোয় আলোয়

আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে ॥

দেহমনের সুদূর পারে  হারিয়ে ফেলি আপনারে,
গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে ॥

আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,
দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে।

বিশ্বধাতার যজ্ঞশালা আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা--
জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি-আশে।







আমি কী গান গাব যে

আমি কী গান গাব যে  ভেবে না পাই--
মেঘলা আকাশে উতলা বাতাসে  খুঁজে বেড়াই॥

বনের গাছে গাছে জেগেছে ভাষা   ভাষাহারা নাচে--
মন ওদের কাছে   চঞ্চলতার রাগিণী যাচে,
সারাদিন বিরামহীন   ফিরি যে তাই॥

আমার অঙ্গে সুরতরঙ্গে   ডেকেছে বান,
রসের প্লাবনে ডুবিয়া যাই।
কী কথা রয়েছে আমার মনের ছায়াতে
স্বপ্নপ্রদোষে-- আমি তারে যে চাই॥





আমারে করো তোমার বীণা

আমারে করো তোমার বীণা,
লহো গো লহো তুলে।
উঠিবে আজি তন্ত্রীরাজি
মোহন অঙ্গুলে॥

কোমল তব কমলকরে,
পরশ করো পরান-'পরে,
উঠিবে হিয়া গুঞ্জরিয়া
তব শ্রবণমূলে॥

কখনো সুখে কখনো দুখে
কাঁদিবে চাহি তোমার মুখে,
চরণে পড়ি রবে নীরবে
রহিবে যবে ভুলে।

কেহ না জানে কী নব তানে
উঠিবে গীত শূন্য-পানে,
আনন্দের বারতা যাবে
অনন্তের কূলে॥




আমি কান পেতে রই  ও আমার

আমি  কান পেতে রই  ও আমার
আপন হৃদয়গহন-দ্বারে   বারে বারে
কোন্‌  গোপনবাসীর কান্নাহাসির
গোপন কথা শুনিবারে--  বারে বারে ॥

ভ্রমর সেথা হয় বিবাগি
নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে,
কোন্‌ রাতের পাখি গায় একাকী
সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে  বারে বারে ॥

কে সে মোর কেই বা জানে,
কিছু তার   দেখি আভা।
কিছু পাই অনুমানে,
কিছু তার বুঝি না বা।

মাঝে মাঝে তার বারতা
আমার ভাষায় পায় কি কথা রে,
ও সে আমায় জানি পাঠায় বাণী
গানের তানে লুকিয়ে তারে  বারে বারে ॥



আমারে বাঁধবি তোরা

আমারে  বাঁধবি তোরা সেই বাঁধন কি তোদের আছে।
আমি যে  বন্দী হতে সন্ধি করি সবার কাছে॥

সন্ধ্যা আকাশ বিনা ডোরে বাঁধল মোরে গো,
নিশিদিন বন্ধহারা নদীর ধারা আমায় যাচে।
যে কুসুম  আপনি ফোটে, আপনি ঝরে, রয় না ঘরে গো--
তারা যে  সঙ্গী আমার, বন্ধু আমার, চায় না পাছে॥

আমারে  ধরবি ব'লে মিথ্যে সাধা।
আমি যে  নিজের কাছে নিজের গানের সুরে বাঁধা।
আপনি যাহার প্রাণ দুলিল, মন ভুলিল গো--
সে মানুষ  আগুন-ভরা, পড়লে ধরা সে কি বাঁচে।

সে যে ভাই,  হাওয়ার সখা, ঢেউয়ের সাথি, দিবারাতি গো
কেবলই  এড়িয়ে চলার ছন্দে তাহার রক্ত নাচে॥





আমারে  পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়ায়

আমারে  পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়ায়
কোন্‌ খেপা সে!
ওরে  আকাশ জুড়ে মোহন সুরে কী যে বাজে
কোন্‌ বাতাসে ॥

গেল রে গেল বেলা,
পাগলের কেমন খেলা--
ডেকে সে আকুল করে, দেয় না ধরা।
তারে  কানন-গিরি খুঁজে ফিরি,
কেঁদে মরি কোন্‌ হুতাশে॥




আমারে ডাক দিল কে ভিতর পানে

আমারে ডাক দিল কে ভিতর পানে--
ওরা যে ডাকতে জানে ॥

আশ্বিনে ওই শিউলিশাখে
মৌমাছিরে যেমন ডাকে
প্রভাতে সৌরভের গানে ॥

ঘরছাড়া আজ ঘর পেল যে,
আপন মনে রইল ম'জে।
হাওয়ায় হাওয়ায় কেমন ক'রে
খবর যে তার পৌঁছল রে
ঘর-ছাড়া ওই মেঘের কানে ॥