প্রাচ্যের সুলতানিয়তের শাসক শাহেনশাহ, শসন বংশের শাসক। ধীর্ঘাকৃতি, সুদেহী, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এবং দুর্ধর্ষ যোদ্ধা শহেনশাহ সমগ্র প্রাচ্যের দন্ডমূণ্ডের কর্তা ছিলেন।
তাঁর দুই পুত্র ছিলেন। বড়টি ছিলেন সুঠামদেহী ও যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী। আর ছোটটি অপেক্ষাকৃত খর্বকায় তবে বিচক্ষণ।

শাহেনশাহ-র দুই পুত্রই যুদ্ধের কলাকৌশল সম্বন্ধে যেমন অভিজ্ঞ ছিলেন, তেমনি ঘোড়ায় চড়াতেও তাদের সমতূল্য কেউ ছিলেন না।

ছোট ভাইয়ের তুলনায় বড় ভাই যেমন দেহে অমিত শক্তি ধরতেন তেমনি বুদ্ধিও ছিল অতুলনীয়।

দুই ভাই যে কেবলমাত্র যুদ্ধবিদ্যায়ই বিশরদ ছিলেন তা-ই নয়। প্রজাদের প্রতি তাদের দয়া-মায়া মমতাও ছিল অপরিসীম। অবার প্রজাদের কাছেও তাঁরা ছিলেন চোখের মণির মতোই ভালবাসার পাত্র। প্রজারা তাঁদের পিতৃতুল্য জ্ঞান করতেন।

বড় ভাইয়ের নাম ছিল বাদশাহ শারিয়ার। আর ছোট ভাইকে সবাই বাদশা শাহজামান নামে চিনত।

শাহজামান ছিলেন সমরখন্দের অন্তর্গত আল-আজম নামক অঞ্চলের শাসক। তিনি ছিলেন প্রজাদের খুবই হিতাকাঙ্ক্ষী। শাসক হিসাবে তাঁর ছিল অকাশছোঁয়া খ্যাতি।

প্রজাপালন, শাসন এবং প্রতিপত্তিতে উভয় ভাই-ই উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হতে পেরেছিলেন।

বাদশাহ শারিয়ার এবং শাহজামন-এর মধ্যে অভাবনীয় হৃদ্যতার সম্পর্ক বর্তমান ছিল। কেউ কাউকে চোখের আড়াল করতে পারতেন না। দীর্ঘদিন উভয় ভাইয়ের মধ্যে এ হৃদতার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ ছিল। বছর কুড়ি উভয় ভাইয়ের মধ্যে দেখা নেই। তাই একটিবার চোখের দেখা দেখার জন্য বাদশাহ শারিয়ার-এর মন-প্রাণ কেঁদে উঠলো।

বদশাহ শারিয়ার একদিন উজিরকে ডেকে বললেন— ‘তোমাকে একবারটি বাদশাহ শাহজামান-এর কাছে যেতে হবে। তাকে বলবে, তাকে দেখার জন্য আমার মন বড়ই উতলা হয়েছে। আর যত শীঘ্র
সম্ভব তাঁকে আমার কাছে নিয়ে আসবে।'

বাদশাহের নির্দেশে উজির উপযুক্ত প্রহরী নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাত্রা করলেন সমরখন্দের অন্তর্গত আল-আজম প্রদেশের উদ্দেশে। দু’দিন আর দু'রাত্রি নিরবিচ্ছিনভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে চললেন প্রৌঢ় উজির।

উজির যথা সময়ে শাহজামান-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। বাদশাহকে কুর্নিশ করে তার বড় ভাই বাদশাহ শারিয়ার-এর ঐকান্তিক আগ্রহের কথা ব্যক্ত করলেন।
⠀⠀
বড় ভাইয়ের অভিপ্রায়ের কথা শুনে শাহজামান তো মহা খুশি। তিনি উজিরকে বললেন- 'যত শীঘ্র সম্ভব আমি যাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে নিচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমি আজই যাত্রা করবো ľ

বাদশাহের নির্দেশে বেছে বেছে উট, খচ্চর ও কিছু গাধা নেওয়া হ'ল। আর পথে বিশ্রামের জন্য সঙ্গে নেওয়া হ’ল কয়েকটি দামী তাঁবু।

দেশের কয়েকজন বাছাই করা মল্লবীর আর গাট্টা গোট্টা কয়েকজন ক্রীতদাসকে প্রহরী হিসেবে সঙ্গে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হ'ল৷

যাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন হ’লে প্রবীণ উজিরের ওপর রাজ্যরক্ষার ক্ষমতা অর্পণ করে বাদশাহ শাহজামান সুসজ্জিত উটের পিঠে উঠলেন। যাত্রা করলেন বড় ভাইয়ের অভিলাষ পূর্ণ করতে।

রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরের মধ্যে বাদশাহ শাহজামান নিজ রাজ্য থেকে বেশ কিছু দূরবর্তী অঞ্চলে পৌঁছে গেলেন। অকস্মাৎ বাদশাহ সবাইকে থামতে বললেন। সর্বনেশে কাণ্ড, ভয়ানক একটি ভুল করে ফেলেছেন তিনি। বড় ভাইকে যে মূল্যবান জিনিসটি উপহার দেবেন বলে বেছে রেখেছিলেন, সেটিই ব্যস্ততার জন্য সঙ্গে নিতে ভুলে গিয়েছেন।

অনন্যোপায় হয়েই উটের মুখ ঘুরিয়ে আবার নিজ রাজ্যের দিকে যাত্রা করলেন তিনি।
প্রাসাদে ফিরে বাদশাহ শাহজামান সোজা হারেমের উদ্দেশে পা বাড়ালেন। সেখান থেকে সোজা চলে এলেন তাঁর পেয়ারের খাস বেগমের কামরায়।

বেগমের কামরার দরজায় পৌঁছেই বাদশাহ শাহজামান আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। নিজের চোখ দুটোর ওপরও যেন আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন।
বাদশাহ শাহজামান এর খাস বেগম সম্পূর্ণ বিবস্ত্রা। দেখলেন, এক কুচকুচে কালো নিগ্রো ক্রীতদাস যুবকের সঙ্গে তিনি আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন।

বাদশাহ শাহজামান দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর্তনাদ করে
উঠলেন-- 'হায় খোদা, এ কী দৃশ্য দেখছি! তবে কি আমার এতদিনের পেয়ার মহব্বত সবই মিথ্যে, কাঁচের স্বর্গে বাস করেছি আমি! মাত্র তো কয়েক ঘণ্টা আগেই আমি প্রাসাদ ছেড়েছি, এটুকু সময়ের
মধ্যেই এমন অবিশ্বাস্য অপ্রীতিকর জঘন্য কান্ড ঘটে গেল! যদি বড় ভাইয়ের রাজ্যে কিছুদিন থাকতাম তবে তো কত কাণ্ডই না জনি ঘটতো!

অস্থিরচিত্ত বাদশাহ শাহজামান অতর্কিতে কোষবন্ধ তরবারিটি টেনে হাতে তুলে নিলেন। শরীরের সর্বশক্তি নিয়োগ করে কোপ বসিয়ে দিলেন। উভয়ের দেহ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। সব খতম।

ব্যস, আর মুহূর্তমাত্রও দেরী না করে উটের পিঠে চেপে বসলেন অস্থিরচিত্ত বাদশাহ শাহজামান।
যাত্রা করলেন বড় ভাইয়ের রাজ্যের উদ্দেশে।

দু'দিন দু'রাত্রি নিরবচ্ছিন্নভাবে উটের পিঠে বসে বাদশাহ শাহজামান বড় ভাইয়ের প্রসাদে পৌঁছে গেলেন।
দীর্ঘদিন পর দু'ভাইয়ের মিলন ঘটল। ছোটভাইকে এতদিন পর কাছে পেয়ে বাদশাহ শারিয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। তাঁকে বুকে জড়িয়ে বহুভাবে আদর করলেন। লাভ করলেন পরম তৃপ্তি।

শাহজামান-এর মনে কিন্তু এতটুকুও শান্তি নেই। মুখের হাসি নির্বাসিত। চোখের তারায় হতাশার ছাঁপ। তাঁকে নিয়ে বড় ভাই যে আনন্দে মেতেছেন তাতে যোগদান করতে তিনি কিছুতেই উৎসাহ
পাচ্ছেন না। সাধ্যমত সংক্ষেপে তাঁর কথার উত্তর দিয়ে কেবল দায়মুক্ত হবার চেষ্টা করছেন।

একই প্রশ্ন ও নিরবিচ্ছিন্ন চিন্তা শাহজামান-এর ভেতরটিকে কুরে কুরে খেতে লাগল— এ কী করে সম্ভব হ'ল। যাকে আমি মন-প্রাণ দিয়ে পেয়ার মহব্বত দিলাম, সে কিনা তাকে দু'পায়ে মাড়িয়ে
পরপুরুষের সঙ্গে বাড়িচারে লিপ্ত হ'ল। এমন জঘন্য মনোবৃত্তি কি করে তার হ'ল! আমার ফুলের মত পবিত্র মহব্বতের মূল্য সে কি না এভাবে দিল! তবে কি পেয়ার-মহব্বতের কোন মূল্যই তামাম
দুনিয়ার কোথাও নেই? সবই কি মিথ্যা? সবই কি ভূয়ো?

শাহজামান সর্বক্ষণ একান্তে মুখ গোমড়া করে বসে নিজের নসীবের কথা ভাবেন আর থেকে থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

বাদশাহ শাহরিয়ার এর মনে কিন্তু ছোট ভাইয়ের ব্যাপারটি সন্দেহের উদ্রেক করল। ভাবলেন, নিজের রাজ্য আর বেগমকে ছেড়ে এসে হয়ত শান্তি-স্বস্তি পাচ্ছে না। তাই তার চোখে-মুখে নিরবিচ্ছিন্ন উদ্বেগ- উৎকণ্ঠার ছায়া, মনে অন্তহীন হাহাকার। কারো সঙ্গে যেচে কথাবার্তা বলা তো দূরের কথা, খানাপিনাও ছেড়ে দিয়েছে। একেই বলে মহব্বত আর বিবির চিন্তা।

এক সময় বাদশাহ শাহরিয়ার ছোট ভাইয়ের কাছে এসে সমবেদনার স্বরে বললেন— 'ভাইয়া, এখানে আসার পর থেকে তোমাকে কেমন যেন বিষণ্ন দেখাচ্ছে। হতাশা আর হাহাকার সম্বল করে প্রহর কাটাচ্ছ। ব্যাপার কি, আমার কাছে খোলসা করে বল।'

শাহজামান চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন— 'ভাইজান আমার বুকের ভেতরে আগুন জ্বলছে, তারই জ্বালায় আমি প্রতিনিয়ত দগ্ধে মরছি।’

—'সে কী কথা ভাইয়া! হঠাৎ এমন কি ঘটল যার জন্য তোমার মনের কোণে এমন অশাস্তি দানা বেঁধেছে! বল, সবকিছু কিছু খুলে বল আমাকে। ’

শাহজামান অপ্রতিভ মুখে, হতাশ দৃষ্টিতে ভাইজানের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন— 'আমাকে ক্ষমা করবে, আমি
কিছুতেই আমার অশান্তি আর হতাশার কথা মুখ ফুটে তোমার কাছে প্রকাশ করতে পারব না। আমার গোস্তাকি মাফ ক'র ভাইজান।'

বাদশাহ শাহরিয়ার ব্যাপারটিকে নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করতে উৎসাহী হলেন না। ভাবলেন, নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। পীড়াপীড়ি করে কাজ হবে না, উচিতও নয়। মুহূর্তকাল নীরবে ভেবে
বললেন— 'ঠিক আছে, চলো আমরা দু'ভাই শিকারে যাই। এতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনটা হাল্কা হবে।'

---‘ভাইজান, শিকারে যেতে আমি ভেতর থেকে কোনো রকম তাগিদ পাচ্ছি না। তুমি বরং একাই ঘুরে এসো। আমি সঙ্গে থাকলে আমার হতাশা আর নিরানন্দ তোমার শিকারের অনন্দকেই বরবাদ করে দেবে। তার চেয়ে বরং তুমি একাই ঘুরে এসো। আমি প্রাসাদেই থাকি।’

বাদশাহ শারিয়ার আর পীড়াপীড়ি করলেন না। একাই লোক-লস্কর নিয়ে শিকারে বেরিয়ে পড়লেন।

যে ঘরে শাহজামান-এর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তার দক্ষিণ-দিকের জানালা খুলতেই সুন্দর এক বাগিচা। কত সব দেশী বিদেশী ফুল আর ফলের গাছের বিচিত্র সমারোহ সেখানে, জানালা খুললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মনলোভা বাগিচাটি।

সে-রাত্রে শাহজামান জানলার ধারে দাঁড়িয়ে উদাস ব্যাকুল দৃষ্টিতে বাগিচার ফোয়ারাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এমন সময় সম্পূর্ণ অপ্রতাশিত এক দৃশ্য তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল।

আকস্মিক প্রসাদের পিছনের দরজাটি খুলে গেল। ব্যাস, হুড়মুড় করে বাগানে ঢুকে গেল কুড়িটি ক্রীতদাস ও কুড়িটি ক্রীতদাসী। পরমুহূর্তেই দেখা গেল স্বয়ং বেগম সাহেবাকে। তিনিও তাদের সঙ্গে
যোগ দিলেন। সবাই নগ্ন, সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। বাগিচার বিভিন্ন প্রান্তে, নিরালায় গিয়ে বসলো তারা জোড়ায় জোড়ায়।

কৃতদাস-দাসীরা জোড়াবেঁধে যে যার পছন্দমত জায়গায় চলে যাওয়ার পর বেগম সাহেবা গলা ছেড়ে হাঁক দিলেন— ‘মাসুদ! মাসুদ!’

বেগম সাহেবার আহ্‌বান কানে যেতে না যেতেই বিশালদেহী এক নিগ্রো যুবক লম্বা-লম্বা পায়ে বেগমের কাছে ছুটে এল। তাকে পুতুলের মত কোলে তুলে নিয়ে পরম আনন্দে বার কয়েক চুম্বন করল। পুলকে-আনন্দে অভিভূত করে তুলল বেগম সাহেবার দেহ-মন। চোখের তারায় দেখা দিল কাম-তৃষ্ণার সুস্পষ্ট ছাপ। বিবস্ত্র প্রেমাকূল বেগম সাহেবাকে কোলে করে নিগ্রোটি কয়েক পা এগিয়ে
সবুজ ঘাসের আস্তরণের ওপর আলতো করে শুইয়ে দিল। তারপরই শুরু হয়ে গেল দৈত্যাকৃতি নিগ্রোটির বল্গাহীণ পেষণ। সে সঙ্গে বেগম-সাহেবার কুসুম-কোমল দেহ পল্লবটিকে দলন-পেষণে সে বার বার পিষ্ট করতে লাগল। আবেশে জড়ানো তাঁর আঁখি দুটো পুলকানন্দে বার-বার অর্দ্ধনিমিলিত-নিমিলিত হতে লাগলো। আর মনের মধুর আবেগ আর নিরবিচ্ছিন রোমাঞ্চ বার বার উপচে পড়তে লাগলো। এ যেন এক অনাস্বাদিত আনন্দকে হঠাৎ হাতের মুঠোয় পেয়ে উভয়ে পুরো-পুরি উপভোগ করে নিচ্ছে। সারা রাত্রি ধরে দৈত্যাকৃতি নিগ্রো যুবকটি বেগম সাহেবার কুসুম কোমল দেহটিকে বার বার আলিঙ্গন, চুম্বন, দলন আর পেষণের মাধ্যমে রোমাঞ্চ জাগিয়ে তুললো, নিজের যৌনক্ষুধাকেও পুরোপুরি নিবৃত্ত করে নিল।

বেগম সাহেবা আর নিগ্রো যুবকের ব্যাভিচারের দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করে শাহজামানের মন একটু শান্ত হ'ল। প্রবোধ পেল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনে বলে উঠলেন— ‘হায় খোদা! আমার বড় ভাইয়ার নসীব দেখছি আমার চেয়েও মন্দ !’

বাদশাহ শাহজামান-এর বুকের ওপর থেকে বিশালায়তন পাথরটি সরে যাওয়ায় যেন বেশ হাল্কা মানে হ'ল এবার। সরাবের বোতলটি হাতে তুলে নিলেন। গলায় ঢেলে দিলেন। ঢগঢগ করে
সবটুকু সরাব গিললেন। তাঁর দেহে হৃত বলশক্তি ফিরে এল। ফিরে পেলেন মানসিক স্বস্তি!

শাহজামান ভোর রাতে শয্যা নিলেন। কখন যে জানলা দিয়ে সূর্যের আলো ঘরে ঢুকে মেঝেতে লুটোপুটি খেতে শুরু করেছে, সেদিকে তার বিন্দুমাত্রও হুঁস নেই।

বাদশাহ শাহরিয়ার বেশ বেলায় শিকার সেরে প্রাসাদে ফিরে এলেন। ছোটভাইয়া শাহজামান তখন আরাম-কেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখবুঝে রাত্রির ঘুমের ঘাটতিটুকু পূরণ করছেন। তিনি তাঁকে ডাকলেন। কুশলবার্তাদি নিলেন।

ভাইকে একটু বেশ হাসিখুশি দেখে বাদশাহ শাহরিয়ার বিস্ময় বোধ করলেন। কৌতূহল নিবৃত্ত করতে গিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—
‘ভাইয়া, এক রাত্রির মধ্যে এমন কী তাজ্জব কাণ্ড ঘটে গেল যার ফলে তবিয়ত সুস্থ দেখছি, মেজাজ মর্জিও কেমন বদলে গেছে তোমার, ব্যাপার কি বল তো?’

শাহজামান এবার মুখ খুললেন— বলছি শোন, উজিরের মুখে তোমার আকূল আহবানের কথা শুনে আনন্দে আমার মন-প্রাণ চনমনিয়ে উঠেছিল। একটি দিন দেরী করতেও আমার মন সয়ছিল না। কতোক্ষণে তোমার সঙ্গে মিলিত হ'ব সে ভাবনা আমার মনকে পেয়ে বসল। লোক-লস্করসহ উজিরের সঙ্গেই পথে নামলাম। কিছুটা পথ পেরোতে না পেরোতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল বস্ততার জন্য একটি দরকারী জিনিস আনা হয়ে ওঠেনি। বাধ্য হয়ে আবার প্রাসাদে ফিরে যেতেই হ'ল। কিন্তু প্রাসাদে ঘাস বেগমের দরজায় গিয়েই আমার নসীবের করুণতম পরিণতির মুখোমুখি হলাম। যার ফলে মুহূর্তেই তামাম দুনিয়া আমার কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ল। আমাকে মুহূর্তের জন্যও যে-বেগম চোখের আড়াল করতে পারে না, সে’ই কিনা বিবস্ত্রা অবস্থায় এক ধূমসো নিগ্রো যুবকের আলিঙ্গানাবদ্ধ হয়ে পরম শান্তিতে বিভোর হয়ে ঘুমোচ্ছে। তার চোখে মুখে প্রসন্নতার সুস্পষ্ট ছাপ। এক নজরে দেখেই মনে হল সারা জীবনে আমার বেগম এই বুঝি প্রথম শান্তি ও তৃপ্তির স্বাদ পেল। ব্যাস, আমার শিরায় শিরায় খুন টগবগিয়ে উঠল। শরীরের সবটুকু খুন যেন শিরে চেপে গেল। নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলাম না। ব্যাস্ত-হাতে কোমর থেকে তরবারিটি টেনে নিলাম। দু’টুকরো করে দিলাম আমার শান্তি-সুখ কেড়ে নেওয়া শয়তান দুটোকে।
মুহূর্তকাল নিরবে কাটিয়ে শাহজামান আবার মুখ খুললেন-- 'ভাইজান, কেন আমার শান্তি-সুখ
অন্তর্হিত হয়েছিল, বললাম। কিন্তু কিভাবে আবার হৃত-শান্তি ফিরে পেয়েছি সে কথা জানতে চেয়ে অবার পীড়াপীড়ি করলে আমি কিন্তু বড়ই বিব্রত বোধ করবো।

ছোট ভাইয়ের কথার গুরুত্ব না দিয়ে কৌতূহলী ও উৎকণ্ঠিত বাদশাহ শাহরিয়ার তবুও তাকে বার বার বলতে লাগলেন— 'হায় খোদা! এত করে বলা সত্ত্বেও তুমি আমার অশাস্ত মনকে শান্ত করতে
এতটুকু উৎসাহী হচ্ছো না! কেন তোমার এত দ্বিধা সঙ্কোচ? আমি আর সইতে পারছি না! বল, সবকিছু খুলে বলে আমার উৎকণ্ঠা দুর কর ভাইয়া।’

শাহজামান আর মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে পারলেন না। দ্বিধা-সংস্কাচ কাটিয়ে গতরাত্রে যে-অবিশ্বাস্য নক্কারজনক ঘটনাকে চাক্ষুষ করেছেন, সবই সবিস্তারে তাঁর কাছে ব্যক্ত করলেন।

সবকিছু শুনে বাদশাহ শারিয়ার ইছুমাত্রও বিশ্বাস করতে পারলেন না।

ম্লান হেসে শাহজামান বললেন-- আমি কিছুমাত্রও মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে যা পুরোপুরি সত্য সে-ছবিই তোমার চোখের সামনে তুলে ধরেছি মাত্র। একে তুমি সেই অবিশ্বাস্য জঘন্যতম দৃশ্যটির প্রতিচ্ছবিও মনে করতে পার।
আমি তোমাকে হাতেনাতে প্রমাণ করে দেখাতে পারি। তবে তোমাকে আবার শিকারে যাবার ছলনার আশ্রয় নিতে হবে। ভাইজান, প্রচার করে দাও, তুমি আবার শিকারে যাবে। ব্যাস, সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার আগেই গোপনে আমর ঘরে এসে আত্মগোপন করে থাকবে। তারপর নিজের চোখের সামনেই তাদের খেল দেখতে পাবে। চাক্ষুষ করার এমন অপূর্ব সুযোগ হাতের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও মিছে কেন আমার কথায় আস্থাবান হয়ে নিজেকে কষ্ট দেবে ভাইজান? আজ রাত্রেই তো সে পরিকল্পনা করতে পার।'

ব্যস, বাদশাহ শাহরিয়ার-এর নির্দেশে সর্বত্র প্রচার করে দেওয় হ'ল, তিনি গত রাতের মত আজও শিকারে যাবেন। আবার সাজ সাজ রব উঠল।

যথা সময়ে বাদশাহ শাহরিয়ার উটের পিঠে চেপে তাঁর সাঙ্গো-পাঙ্গোদের নিয়ে মহাধুমধাম করে শিকারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বনের এক চিলতে সমতল প্রান্তরে বাদশাহ শাহরিয়ার-এর তাঁবু পড়ল। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার কিছু পরে তিনি তার বিশ্বস্ত দুই নেকরকে ডেকে বললে— আমি কিছু সময়ের জন্য তাঁবু ছেড়ে অন্যত্র যাব। কেউ, এমন-কি উজির এলেও বলবি, আমার
তবিয়ত বিগড়েছে। কারো সঙ্গেই দেখা করা সম্ভব নয়।'

রাত্রি একটু বাড়তেই বদশাহ শাহরিয়ার কালো বোরখায় নিজেকে ঢেকেঢুকে  তাঁবু থেকে গোপনে বেরিয়ে অতি সন্তর্পণে প্রাসাদে শাহজামানের ঘরে এসে আশ্রয় নিলেন।

প্রাসাদের দক্ষিণ দিকের জানলা খুলে, ফুল-ফলের বাগিচার দিকে মুখ করে দু'ভাই অন্ধকার ঘরে বসে রইলেন। উভয়ের চোখেই অনুসন্ধিৎসার চাপ। কারো মুখেই কোন কথা নেই।

বাদশাহ শাহরিয়ারকে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হ'ল না। এক সময় প্রাসাদের পিছনের দরজা দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এল বিবস্ত্র কুড়িজন ক্রীতদাস আর কুড়িজন ক্রীতদাসী। তারপরই দেখা গেল বাদশাহ
শাহরিয়ার-এর খাস বেগম সম্পূর্ণ বিবস্ত্রা অবস্থায় বাগানে এসে দাঁড়ালেন। অস্বস্থিতে ভরপুর। অনুচ্চ কণ্ঠে ডাকলেম 'মাসুদ! মাসুদ।'
মুহূর্তের মধ্যেই যুবক নিগ্রোটি আড়াল থেকে চোখের সামনে এসে দাঁড়াল। বিবস্ত্রা বেগম সাহেবার কাছে গেল। তারপরই চুম্বন, দলন,
পেষণ আর সম্ভোগের মাধ্যমে পুলকানন্দ লাভ করতে লাগলো সারারাত্রি ধরে। বেগম সাহেবা যেন এই প্রথম পুরুষের মধুর আলিঙ্গনে পরম তৃপ্তি লাভ করলেন। বাদশাহ শাহরিয়ার নিজের চোখ দুটোর ওপরও যেন আস্থা হারিয়ে ফেললেন। লজ্জায়, ঘৃণায় আর আপমানে তার সর্বাঙ্গে বিশ্রি এক অনুভূতি দেখা দিল।

বাদশা শাহরিয়ার এর মন থেকে সংসারের মোহ চিরদিনের মত নিঃশেষে মুছে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাইয়া শাহজামানকে বলল--
‘ভাইয়া, আর নয়। এ পাপের নরক পুরীতে এক মুহূর্তও আর নয়। যেখানে প্রেম মূল্যহীন, মহব্বতের আপমৃত্যু ঘটেছে, পাপাচার ব্যভিচার বিশ্বাসঘাতকতা সবার ঊর্ধ্বে স্থান পেয়েছে সেখানে
থেকে নিজেকে আর বঞ্চিত করতে চাই না। চল, আজই আমরা প্রাসাদ, রাজৈশ্বর্য আর বিবির মায়া কাটিয়ে বেরিয়ে পড়ি। যেটিকে দু’চোখ যায় চলে যাই। খুঁজে দেখি, আমাদের মত নসীব বিড়ম্বিত
তার কেউ আছে কি না।’

ভোরের আলো ফোটার আগেই শাহরিয়ার ছোট ভাইয়া শাহজামান-এর হাত ধরে প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। নসীব সম্বল করে তাঁরা
পথহারা উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলেন। এক সময় সমুদ্রের উপকূলে উপস্থিত হলেন। একটি গাছের ছায়ায় বসে তারা ক্লান্তি অপনোদন করতে লাগলেন।

প্রায় এক ঘণ্টা কাল দু'ভাই গাছে হেলান দিয়ে, পাশাপাশি গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে বিশ্রাম নিলেন। এক সময় তাঁরা দেখলেন, সমুদ্রের মাঝখানে ধোঁয়ার একটি কুগুলি আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। দু'ভাই অতর্কিতে সোজা হয়ে বসে পড়লেন। বিস্ময়, বিস্ফরিত চোখে অলৌকিক দৃশ্যটির ওপর নজর রেখে চলতে লাগলেন। এক সময় দেখলে লাগলেন কুণ্ডলিটি থেকে অতিকায়
একটি অফ্রিদি দৈতের উদ্ভব ঘটেছে। অভাবনীয় দৃশ্য দেখে দু'ভাই যেন কুঁকড়ে যাওয়ার উপক্রম হলেন। তাড়াতাড়ি গাছের ডালে উঠে বসলেন।

কয়েক মুহূর্তের মধেই অতিকায় আফ্রিদি দৈত্যটি উপকূলের দিকে ফিরল। তারপর বাতাসে ভর করে এগিয়ে আসতে লাগল বিশ্রামরত দু’ই ভাইয়ের দিকে। ব্যাপার দেখে তাঁদের তো আত্মারাম
খাঁচা ছাড়া হবার উপক্রম। আফ্রিদি সামান্য এগোতেই আরও অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য তাদের নজরে পড়ল। দেখলেন তার মাথায় রয়েছে পর্বত সমাণ এক বাক্স।

কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই আফ্রিদি গাছটির তলায় হাজির হ'ল। বিশালায়তন বাক্সটিকে নামাল। তার ভেতর থেকে একটি বেশ বড়সড় ও ভারি সিন্দুক বের করল। ব্যস, তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক রূপসী। পরমা সুন্দরী তম্বী যুবতী। বেহেস্তের পরীদের সৃষ্টি করার পর অবশিষ্ট সৌন্দর্যটুকু যুবতীটির গায়ে লেপে দেওয়া হয়েছে। নতুবা বেহেস্তের পরীদেই একজন এই রূপসী তন্বী
যুবতীটি। তার রূপের আভা চোখ দুটো যেন ঝলসে দিচ্ছে। বেহেস্তের পরীটির আলোকচ্ছটায় যেন গাছের তলা ও তাঁর চারদিকের অনেকখানি অংশ উদ্ভাসিত।

আফ্রিদি বিস্ময় মাখানো দৃষ্টিতে রুপসী পরীটির রূপ সৌন্দর্য দেখতে লাগল। তারপর আবেগ-মধুর সম্ভাষণে বলতে লাগল-- মেহবুবা, তোমার সাদি হবার কথা ছিল। আমি পেয়ারের সাহজাদীকে শাদীর আসর থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছি। ব্যস, তারপর থেকেই আমার আঁখির নিদ উবে গেছে। অবসাদে আজ আমার তবিয়ত কাহিল হয়ে পড়েছে। এখন আমি নিদ যাব। তোমার কোলে শির রেখে নিদ যাব।’

রূপসী তন্বী যুবতীতির কোলে মাথা রেখে অতিকায় আফ্রিদি দৈত্যটি ঘুমিয়ে পড়ল। মুহূর্তেই গভীর ঘুমে বেহুঁস হয়ে পড়ল।

রূপসী তম্বী যুবতীটি এদিক-ওদিক দৃষ্টি ফেরাতেই গাছের ডালে অবস্থানরত দু'ই ভাইকে দেখতে পেল। অতি সন্তর্পণে ঘুমন্ত আফ্রিদির মাথাটিকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। দু’ভাইকে ঈশারা করে বুঝিয়ে দিল দৈত্যের ঘুম সহসা ভাঙবে না। তোমরা নির্ভয়ে নেমে এসো।

রূপসী তম্বী যুবতীটির কাছ থেকে অভয় পেয়ে দু'ভাই কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পারলেন বটে। তবু তাদের ফ্যাকাসে মুখ অধিকতর ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চোখের তারায় ভীতিও হতাশাটুকু গাঢ়তর হ’ল।

রূপসী এবার অভয় দিতে গিয়ে বলল– আল্লা তাল্লার নামে হলফ করে বলছি, তোমাদের কোন অনিষ্ট হবে না। আমার কথায় ভরসা রেখে গাছ থেকে নেমে এসো। আর যদি নেহাৎই আমার হকুম
তামিল না কর তবে তোমাদের নসীবে দুঃখ আছে। দৈত্যকে জাগিয়ে দেব। গলাটিপে মেরে ফেলবে তোমাদের। এখনও সময় আছে, নেমে এসো, আমার কলিজাটাকে শান্ত কর। কলিজার আগুনে পানি ঢেলে আমাকে শান্তি দাও, তৃপ্ত কর! তোমরা ভোগ কর আমাকে।

বাদশাহ শাহরিয়ার আর তাঁর ভাই গাছের ডালে বসে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে কয়েক মুহূর্ত কাটিয়ে আল্লা-তায়ালার ওপর নিজেদের নসীবকে অর্পণ করে তারা দুরুদুরু বুকে অপরূপার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।

রুপসী তম্বী যুবতীটি মুহূর্তের মধ্যে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল। আবেশে জড়ানো কামাতুর চোখ দুটো মেলে দু’ ভাইয়ার দিকে তাকাল। ভাবাপ্লুত কণ্ঠে বলল— 'তোমরা এক এক করে আমার কলিজার জ্বালা নেভাও। চুম্বন, দলন, পেষণ আর সম্ভোগে সম্ভোগে আমাকে উত্তলা করে তোল। অন্তর্জ্বালায় দন্ধে মরছি আমি। আমাকে তৃপ্ত কর, শান্তি দাও।

দু'ভাই পরস্পরের চোখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। কে আগে যাবে!

রূপসী তম্বী যুবতী অস্থিরকন্ঠে বলে উঠল-- ‘দেরি কোরো না, চলে এসো। কলিজার জ্বালায় আমি জ্বলেপুড়ে খাঁক হচ্ছি! দেৱী করলে কিন্তু আমি আফ্রিদিকে ডাকতে বাধ্য হ’ব, বলে দিচ্ছি।'

দু’ভাই নিতান্ত অনন্যোপায় হয়ে একের পর এক রুপসী যুবতীকে সম্ভোগের তৃপ্তি দানে লিপ্ত হলেন। তার কলিজা ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা কামাতুর যুবতীকে সঙ্গদান করলেন। নিজেরাও কাম তৃপ্তি পেলেন।

পরিতৃপ্তি লাভ করে রূপসী যুবতীটি ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল– নারীর কামজ্বালা নির্বাপিত করে তৃপ্তিদানের কৌশল তোমাদের দু'জনেরই দেখছি খুব ভাল রপ্ত আছে!'

রূপসী যুবতীটি এবার একটি থলির ভেতর থেকে একগোছা আঙটি বের করে তাঁদের চোখের সামনে মেলে ধরল। মিষ্টি-মধুর স্বরে উচ্চারণ করল– এগুলো কি বলতে পার?

দু’ভাইয়ের চোখের তারায় জিজ্ঞাসার ছাপ এঁকে নীরবে ফ্যালবফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।

রূপসী যুবতীটিই মুশকিল আসান করতে গিয়ে বলল— 'ইতিপূর্বে আফ্রিদির চোখের আড়ালে যাদের দিয়ে আমি সম্ভোগের মাধ্যমে তৃপ্তি লাভ করেছি তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে একটি করে আঙটি নিয়ে এখানে গেঁথে রেখেছি। এ গোছাটিতে একশ' সত্তরটি আঙটি রয়েছে। এগুলো আমার কাছে স্মৃতিস্বরূপ। তোমরা দু'জনেও আমাকে একটি করে আঙটি দাও স্মৃতির গোছায় গেঁথে রাখি। ভবিষ্যতে আঙটি দুটো দেখলেই আজকে তোমাদের দ্বারা যে সম্ভোগের তৃপ্তি পেয়েছি সে কথা আমার মনের কোণে ভেসে উঠবে।’

বিস্ময়ে অভিভূত শাহরিয়ার আর তাঁর ভাই কথা না বাড়িয়ে নিজ নিজ অঙ্গুলি থেকে আঙটি খুলে রূপসী যুবতীটির হাতে তুলে দিলেন।

রূপসী যুবতী ঠোঁটের কোণে পরিতৃপ্তির হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে এবার বলল— 'এ হতচ্ছাড়া দৈত্য আফ্রিদি আমাকে শাদীর আসর থেকে জবরদস্তি ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। তারপরই ওই
লোহার সিন্দুকটায় বন্দী করে দেশ-দেশান্তরে, বন-বনান্তরে আর পাহাড়ে-মরুতে মাথায় করে হরদম ঘুরে বেড়িয়েছে। আমাকে নিয়ে তার হরবকত ডর, যদি হাতছাডড়া হয়ে যাই। তাই সমুদ্রের অতল গহ্বরে রেখেছে আমাকে। কিন্তু হতচ্ছাড়া শয়তান দৈত্যটা তো একটা আস্ত
আহাম্মক। লেড়কিদের চরিত্রের কথা তো তার বিলকুল অজ্ঞাত। আসলে আমরা, লেড়কিরা কলিজার তৃপ্তির জন্য যা চাইব যে করেই হোক- লাভ না করে শান্ত হ'ব না।
লেড়কিদের আটকে রেখে সতর্কতার সঙ্গে চোখে চোখ রেখেও কেউ তাদের লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও কোনদিন সক্ষম হবে না।

বাদশা শাহরিয়ার এবং তার ভাই শাহজামান তার কথায় যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। ভাবলেন, -- বিশালদেহী, অমিত শক্তিধর ও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দৈত্যের এত সতর্কতা সত্ত্বেও রূপসী যুবতীটি কেমন করে তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে চলেছে তা বাস্তবিকই বিস্ময়কর তো বটেই, রীতিমতো অবিশ্বাস্যও। আর তারা দু'ভাই তাঁদের বিবিকে রক্ষা করার জন্য কতটুকুই বা সতর্কতা অবলম্বন করেছেন? কিছুমাত্র না। বিশ্বাস-ঘাতকতা তো তারা করবেই।

রূপসী যুবতী আর দৈত্য আফ্রিদির কিসসা শুনে, সে এবং তার ভাই শাহজামানের কিছুটা অন্ততঃ স্বস্থি পেলেন। তারা এবার নিজ নিজ প্রসাধে ফিরে গেলেন।


বাদশাহ শাহরিয়ার প্রাসাদে ফিরেই উদভ্রান্তের মত তাঁর খাস বেগমের কামরায় হাজির হলেন। তরবারির আঘাতে বেগমের শিরচ্ছেদ করে ফেললেন। আর হারেমের যত ক্রীতদাস আর
ক্রীতদাসী ছিল সবাইকে  খতম করার নির্দেশ দিলেন।

বাদশাহ শাহরিয়ার উদ্ভান্তের মত চেঁচিয়ে উজিরকে তলব করলেন। বৃদ্ধ উজির দুরুদুরু বুকে ছুটে এসে কুর্নিশ করে আদেশের অপেক্ষায় বাদশাহের সামনে দাঁড়ালেন।

বাদশাহ, মুখের গাম্ভীর্যটুকু অক্ষুণ্ণ রেখেই বললে— উজির, আমার হুকুম শোন, আজ থেকে প্রতি রাত্রে একটি করে কুমারী লেড়কি আমার ঘরে হাজির করবে। আমি সারা-রাক্তি তাকে নিয়ে
সম্ভোগে লিপ্ত থাকব। আর পূর্ব-আকাশে রক্তিম ছোপ ফুটে ওঠার আগেই তাকে নিজে হাতে খতম করব। সে যাতে তার কলঙ্কিত দেহ পবিত্র বলে অন্য কোনো পুরুষকে দান করে প্রতারণা করতে না পারে।
মনে রেখো, আমার হুকুম তামিল না করলে তোমার শিরটা গর্দান থেকে নেমে যাবে। যাও, হুকুম তামিলের কথা ভাব-গে।

বৃদ্ধ উজির আর কিছু না হোক অন্ততঃ জানের মায়ায় তিন তিনটি বছর এক নাগাড়ে প্রতিরাত্রে একটি করে কুমারী লেড়কি বাদশাহের শোবার ঘরে হাজির করে চললেন।

ব্যাপার দেখে রাজ্য জুড়ে মানুষের, বিশেষ করে কুমারী লেড়কি এবং তাদের আব্বাদের মনে অন্তহীন হাহাকার আর হাহুতাশ সম্বল হয়ে দাঁড়াল। অনেকে লেড়কিকে নিয়ে রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গেল।

প্রজারা একদিন যে বাদশা শাহরিয়ারকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতো আজ তিনিই তাদের চোখে সাক্ষাৎ শয়তানে পরিণত হয়েছেন। চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে খোঁদার কাছে তাঁরা নালিশই শুধু নয়, প্রতিনিয়ত তাঁর মৃত্যু কামনা করে।

বাদশাহ শাহরিয়ার-এর কোনদিকেই বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। বেহেস্ত বা দোজাকেরও পরোয়া করেন না। কিন্তু এদিকে যে দেশে কুমারী লেড়কির আকাল পড়ে গেছে সে তো উজিরের ভালই জানা
আছে। তিনি পড়লেন মহাফাঁপরে। কোথায় পাবেন নবাবের বাঞ্ছিত কুমারী! আবার সন্ধ্যায় খালি হাতে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে জান নিয়ে ফিরে আসতে হবে না। উজিরের নিজের অবশ্য পরমা সুন্দরী দুটো মেয়ে রয়েছে। উভয়েই কুমারীও বটে। রূপে গুণে একেবারে চৌখস। বড়টির নাম শাহরাজাদ আর ছোটটির নাম দুনিয়াজাদ।
বড়টির ইতিহাসে অগাধ পাণ্ডিত্য। আবার গান বাজনায়ও বিশেষ পারদর্শিনী। সে আব্বাজানের বিষণ্ণতা লক্ষ্য করে তাঁর মনের আকস্মিক ভাবান্তরের কারণ জানতে চাইল।

বৃদ্ধ উজির বেটিকে সব কথা খুলে বল্লেন। আব্বাজানের মুখে সব বৃত্তান্ত শুনে শাহরাজাদ তাকে প্রবোধ দিতে গিয়ে বলল— ‘আব্বাজান, কেন তুমি সামান্য একটি ব্যাপার নিয়ে একেবারে
আসমান-জমিন ভেবে মরছ! আজ রাত্রেই বাদশাহ শাহরিয়ার-এর সঙ্গে আমার শাদী দিয়ে দাও। আমার নসীবের কথা ভেবে উতলা হয়ো না। আমার দেহে যদি সাচ্চা মুসলমানের খুন থেকে থাকে, তবে দেখবে আমি আবার জান নিয়ে তোমার কাছে ফিরে আসবই। আর যদি নেহাৎই বাদশাহের হাতে জান দিতে হয় তবে এমন কোন কাজ করে মরবো- যেন ভবিষ্যতে তামাম দুনিয়ার কোন লেড়কিকে আর শয়তানটার শিকার হতে বা রাজ্য ছেড়ে ভেগে যেতে না হয়। পুরো ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার।