বেগম শাহরাজাদ তাঁর কিস্সা শুরু করলেন—
‘কোন এক সময়ে এক দেশে এক সওদাগর বাস করত। অগাধ ধন-দৌলতের মালিক। টাকার কুমীর। তামাম দুনিয়ায় তার মত বিত্তবান দ্বিতীয় কেউ ছিল না। এক সময় সেই-সওদাগর দেশ-বিদেশে চক্কর মেরে বেড়াচ্ছিল। ইচ্ছা, ভাল কিছু সমানপত্তর খরিদ করবে।

মাথার ওপরে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মত সূর্যটা হরদম চোখ রাঙিয়ে চলেছে। ক্লান্ত-অবসন্ন সওদাগর এক গাছতলায় ঘোড়া থেকে নামল। রশি দিয়ে ঘোড়াটাকে গাছের সঙ্গে বাঁধল। নদীর পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে নিল। এবার ঝোলা থেকে খানা বের করে যেই না মুখে তুলতে যাবে অমনি চোখের সামনে ভেসে উঠল অতিকায় এক আফ্রিদি দৈত্য। পাহাড়ের মত উঁচালম্বা চেহারা। হাতে তার এক কাটারী।
গর্জে উঠল— ‘ওঠ, আমি তোমাকে হত্যা করব! জলদি কর, আমি তোমার কলিজা চাই।'

— ‘আমার অপরাধ?' সওদাগর করজোড়ে কাঁপা কাঁপা গলায় উচ্চারণ করল।

—‘তুমি খুনী। আমার একমাত্র লেড়কাকে তুমি খুন করেছ। খানাপিনা করার সময় একটা ফল খেয়ে আঁটিটা ছুড়ে ফেলেছিলে, মনে পড়ছে? তারই আঘাতে আমার বাপজান মারা গিয়েছিল। আমি আজ তার বদলা নেব। তোমার জান নিয়ে ছাড়ব। কলিজাটা টেনে বের করব। ওঠ, জলদি উঠে পড়।'

আফ্রিদি দৈত্য কথাটা বলেই রাগে ফুঁসতে লাগল। তার বুকের ভেতরে যেন কামারের হাঁফর চলছে।

সওদাগর চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল— 'তুমি দৈত্যরাজ। বহুত খুব তাকত ধর। তোমার লেড়কাকে যদি মেরেই থাকি তবে জানবে আমি অবশ্যই নিজের অজান্তে তা করেছি। গুণাহ করলেও নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত। তবু তুমি আমাকে যে শাস্তি দেবে আমি তা নির্দ্বিধায় মেনে নেব। তবে মৃত্যুর আগে মেহেরবানি করে আমাকে একবারটি আমার আত্নীয়জনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দিলে তোমার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।'

অতিকায় আফ্রিদি দৈত্য এবার চোখ গোল গোল করে সওদাগরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
সওদাগর আগের মতই কাঁপা কাঁপা গলায় বলে চলল— 'আমার অগাধ ধন-দৌলত রয়েছে। সেসব আমার বিবি আর লেড়কা- লেড়কিদের মধ্যে ভাগ করে দিতে চাই। তারপর আমায় মারো-কাটো
যা খুশি করতে পার বাঁধা দেব না।'

আফ্রিদি দৈত্যটা তেমনি রোষপূর্ণ অথচ কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সওদাগরের দিকে।
সওদাগর বলে চলল— 'তুমি হয়ত জান না যে, আমি সওদাগরী কাজকর্মে লিপ্ত। এসব কাজে প্রচুর ধার বাকি থাকতে বাধ্য। আমারও কিছু পাওনাদার রয়েছে। গোরে যাওয়ার আগে তাদের পাওনা গণ্ডার কানাকড়ি পর্যন্ত আমি মিটিয়ে দিতে চাই। নইলে বেহেস্তে তো দূরের কথা, দোজকেও আমার ঠাঁই হবে না। জান দেওয়ার ব্যাপারে আমার
মোটেই ভয় ডর নেই। আমার কথায় আস্থা রেখে মাত্র কয়েকদিনের জন্য যদি ছেড়ে দাও, তবে আমি সবকিছু মিটিয়ে ফিরে এসে তোমার হাতে নিশ্চিন্তে জান দিতে পারি।
খোদাতাল্লার নামে কসম খেয়ে বলছি, আমি অবশ্যই তোমার কাছে ফিরে আসব।'

আফ্রিদি দৈত্য বল্‌ল— 'তোমার কথা আমি বিশ্বাস করছি। ঠিক আছে, তোমায় ছুটি দিলাম। কাজ সেরেই আমার কাছে ফিরে আসা চাই, খেয়াল থাকে যেন।’

ছুটি পেয়ে সওদাগর দেশে ফিরে গেল। যার, যা পাওনাগণ্ডা ছিল, মিটিয়ে দিল। বিবি আর লেড়কা-লেড়কিদের কাছ থেকে চিরদিনের মত বিদায় নেবার জন্য তৈরি হ’ল। সব কিছু শুনে সবাই তাকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করল। মায়ায় মোহিত হয়ে ঘরের কোণে বসে থাকা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। বিচ্ছেদ-বেদনা যতই কঠিন হোক তাকে সে-আফ্রিদি দৈত্যের খোঁজে বেরোতেই হ’ল।

এপথ-সেপথ হয়ে সওদাগর এক সময় নদীর ধারের সেই- গাছটার তলায় হাজির হ’ল। গাছের তলায় বসে নিজের নসীবের কথা ভেবে আঁখির পানি ফেলতে লাগল।

তখন এক বুনো ছাগলকে দঁড়ি দিয়ে বেঁধে এক জোয়ান মরদ হঠাৎ সওদাগরের সামনে এসে দাঁড়াল। সওদাগরকে কাঁদতে দেখে সে বলল– “কি হে সওদাগর, তোমার আঁখিতে পানি, ব্যাপার কি?
এমন মনমরা হয়ে বসে কেন হে?”

সওদাগর চোখের পানি মুছতে মুছতে নিজের বরাতের কথা তাকে বলল৷

যুবকটা ম্লান হেসে বলল- 'আচ্ছা, এক কিস্সা শোনালে তো ভাইজান! মুখের জবান রাখার জন্য তুমি যে নিজের জান দিতে এসেছ তা কিন্তু তামাম দুনিয়ার কেউ-ই বিশ্বাস করবে না।

এমন সময় আর এক যুবক দুটো শিকারী কুকুর সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গাছের তলায় এল। সওদাগরের নসীবের সে-ও আদ্যোপান্ত শুনল।
কয়েক মুহুর্তের মধ্যে আর এক যুবক সেখানে হাজির হ’ল। তার সঙ্গে দুটো খচ্চর রয়েছে। মাদী খচ্চর। সে-ও সওদাগরের নসীবের কথা শুনে একেবারে হাঁ হয়ে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ ঘূর্ণিঝড় উঠল। বালি আর শুকনো পাতায় চারিদিক ছেয়ে গেল। তার কেন্দ্রস্থলে একটা বালির স্তম্ভ ওপরের দিকে উঠে যেতে লাগল। বালির স্তম্ভটা এবার গাছটার দিকে এগোয়। চোখের পলকে বালির স্তম্ভটা অতিকায় এক আফ্রিদি দৈত্যের আকৃতি ধারণ করল।

আফ্রিদি দৈত্যটা এবার হাতের ঝকঝকে চকচকে তরবারিটা উঁচিয়ে গর্জে উঠল— সওদাগর, এগিয়ে এসো, আমি তোমায় খুন করব। আমার বেটাকে খুন করেছ তুমি। তোমাকে খুন করে আমি বদলা নেব। 'সওদাগর মৃত্যুভয়ে থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল।