রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে ।
কাজরী গাহিয়া চল পুরনারী হরষে ৷৷

কদম-তমাল ডালে দোলনা দোলে,
কুহু-পাপিয়া ময়ূর বোলে,
মনের বনের মুকুল খোলে,
নট-শ্যাম-সুন্দর-মেঘ পরশে ॥

হৃদয়-যমুনা আজ কূল জানে না,
মনের রাধা আজ বাধা মানে না।
ডাকিছে ঘর ছাড়া ঝড়ের (শ্যামের) বাঁশী,
অশনি আঘাত হানে দুয়ারে আসি'।
গরজাক্ গুরুজন ভবন-বাসী
আমরা বাহিরে যাব শ্যাম-মেঘ দরশে ॥






পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে,
বলিও আমার পরদেশীরে॥

সে দেশে যবে বাদল ঝরে
কাঁদে না কি প্রাণ একেলা ঘরে,
বিরহ-ব্যথা নাহি কি সেথা
বাড়ে না বাঁশী নদীর তীরে ॥

বাদল রাতে ডাকিলে—“পিয়া-পিয়া”-পাপিয়া
বেদনায় ভ'রে ওঠে না কি রে কাহারো হিয়া ?
ফোটে যবে ফুল ওঠে যবে চাঁদ
জাগে না সেথা কি প্রাণে কোন সাধ ?
দেয় না কেহ   গুরু গঞ্জনা
সে দেশে বুঝি কুলবতী রে ॥





নিশি নিঝুম ঘুম নাহি আসে ।
হে প্রিয় কোথা তুমি দূর প্রবাসে ॥

বিহগী ঘুমায় বিহগ কোলে,
শুকায়েছে ফুল-মালা শ্ৰাস্ত আঁচলে ।
ঢুলিছে রাতের তারা চাঁদের পাশে ॥

ফুরায় দিনের কাজ ফুরায় না রাতি,
শিয়রের দীপ হায়,   অভিমানে নিভে যায়
নিভিতে চাহে না নয়নের বাতি।
কহিতে নারি কথা তুলিয়া আঁখি
বিষাদ-মাখা মুখ গুণ্ঠনে ঢাকি ।
দিন যায় দিন গুণে নিশি যায় নিরাশে ॥







সন্ধ্যামালতী যবে ফুল বনে ঝুরে,
কে আসি’ বাজালে বাঁশী ভৈরবী সুরে।
সাঁঝের পূর্ণ চাঁদে অরুণ ভাবিয়া,
পাপিয়া প্রভাতী সুরে উঠিল গাহিয়া
ভোরের কমল ভেবে সাঁঝের শাপলা ফুলে
গুঞ্জরে ভ্রমর ঘুরে ঘুরে ॥

বিকালের বিষাদে ঢাকা ছিল বনভূমি,
সকালের মল্লিকা ফুটাইলে তুমি,
রাঙিল ঊষার রঙে গোধূলি লগন,
শোনালে আশার বাণী বিরহ-বিধুরে ॥






ভোরে ঝিলের জলে শালুক পদ্ম তোলে কে
ভ্রমর-কুন্তলা কিশোরী।
ফুল দেখে বেভুল সিনান বিসরি ॥

একি নূতন লীলা আঁখিতে দেখি ভুল
কমল ফুল যেন তোলে কমল ফুল
ভাসায়ে আকাশ-গাঙে অরুণ-গাগরি ॥

ঝিলের নিথর জলে আবেশে ঢল ঢল
গ'লে পড়ে শত সে তরঙ্গে,
শারদ আকাশে   দলে দলে আসে
মেঘ, বলাকার খেলিতে সঙ্গে।
আলোক-মঞ্জুরী প্রভাত বেলা
বিকশি’ জলে কি গো করিছে খেলা
বুকের আঁচলে ফুল উঠিছে শিহরি’ ॥







যখন আমার গান ফুরাবে
তখন এসো ফিরে।
ভাঙবে সভা, বসব একা
রেবা নদীর তীরে ॥

গীত শেষে গগন-তলে
শ্রান্ত তনু পড়বে ঢ'লে
ভালো যখন লাগবে না আর
সুরের সারেঙ্গীরে ॥

মোর কণ্ঠের জয়ের মালা
তোমার গলায় নিও
ক্লান্তি আমার ভুলিয়ে দিও
প্রিয় হে মোর প্রিয়।

ঘুমাই যদি কাছে থেকো
হাতখানি মোর হাতে রেখে।
জেগে যখন খু’জব তোমায়
আকুল অশ্রুনীরে ॥






ওর নিশীথ সমাধি ভাঙিও না ।
মরা-ফুলের সাথে   ঝরিল যে ধূলিপথে
সে আর জাগিবে না
তারে ডাকিও না ॥

তাপসিনী সম তোমারি ধ্যানে
সে চেয়েছিল তব পথের পানে।
জীবনে যাহার   মুছিলে না আঁখিধার
আজি তাহার পাশে কাঁদিও না ॥

মরণের কোলে সে গভীর শান্তিতে
পড়েছে ঘুমায়ে
তোমারি তরে গাঁথা শুকানো মালিকা
বক্ষে জড়ায়ে।
যে, মরিয়া জুড়ায়েছে ঘুমাতে দাও
তারে জাগিও না।






কবি সবার কথা কইলে এবার
নিজের কথা কহ ।
কেন নিখিল ভুবন অভিমানের
আগুন দিয়ে দহ ॥

কে তোমারে হান্‌ল হেলা কবি ?
সুরে সুরে আঁক কি গো
সেই বেদনার ছবি (হায় ) ?
কার বিরহ রক্ত ঝরায় বক্ষে অহরহ ॥

কোন্ ছন্দময়ীর ছন্দ দোলে
তোমার গানে গানে,
তোমার সুরের স্রোত বয়ে যায়
কাহার প্রেমের টানে (গো)
কাহার চরণ পানে ?

কাহার গলায় ঠাঁই পেল না ব'লে
তব কথার মালা ব্যথার মত
প্রতি হিয়ায় দোলে।
তোমার হাসিতে যে বাঁশী বাজে
সে ত তুমি নহ ॥






কোন্ সে সুদূর অশোক-কাননে
বন্দিনী তুমি সীতা।
আর কতকাল জ্বলিবে আমার
বুকে বিরহের চিতা।

বিরহে তোমার অরণ্যচারী,
কাঁদে, রঘুবীর বল্কলধারী ;
ঝরা-চামেলীর অশ্রু ঝরায়ে
ঝুরিছে বন-দুহিতা ॥

তোমার আমার এই অনস্ত-অসীম-
বিরহ নিয়া
কত আদি কবি কত রামায়ণ রচিবে,
কে জানে প্রিয়া !

বেদনার সুর-সাগর তীরে,
দয়িতা আমার এস এস ফিরে,
আবার আধার হৃদি-অযোধ্যা
হইবে দীপান্বিতা ॥






(তুমি) শুনিতে চেওনা আমার মনের কথা ।
দখিনা বাতাস ইঙ্গিতে বোঝে,
কহে যাহা বন-লতা ॥

চুপ ক'রে চাঁদ সুদূর গগনে
মহাসাগরের ক্রন্দন শোনে
ভ্রমর কাঁদিয়া ভাঙিতে পারেনা
কুসুমের নীরবতা ॥

মনের কথা কি মুখে সব বলা যায় ?
রাতের আঁধারে যত তারা ফোটে
আখি কি দেখিতে পায় ?
পাখায় পাথায় বাঁধা যবে রয়
বিহগ-মিথুন কথা নাহি কয়,
মধুকর যবে ফুলে মধু পায়
রহেনা চঞ্চলতা ॥