কুহু কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া
কুহরিল মহুয়া বনে ।
চমকি' জাগিনু নিশীথ শয়নে ॥

শূন্য-ভবনে মৃদুল সমীরে
প্রদীপের শিখা কাঁপে ধীরে ধীরে।
চরণ-চিহ্ন রাখি’ দলিত কুসুমে
চলিয়া গেছ তুমি দূর বিজনে ॥

বাহিরে ঝরে ফুল আমি ঝুরি ঘরে
বেণু-বনে সমীরণ হাহাকার করে,
ব’লে যাও কেন গেলে এমন ক'রে
কিছু নাহি ব’লে সহসা গোপনে ॥





এল ঐ বনান্তে পাগল বসন্ত ।
বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে,
চঞ্চল তরুণ দূরন্ত ॥

বাঁশীতে বাজায় সে বিধুর
পরজ বসন্তের সুর,
পাণ্ডু-কপোলে জাগে
রং নব অনুরাগে
রাঙা হ’ল ধূসর দিগন্ত ॥

কিশলয়ে-পর্ণে অশাস্ত
ওড়ে তা’র অঞ্চল প্রান্ত।
পলাশ-কলিতে তা’র
ফুল-ধনু লঘু-ভার,
ফুলে ফুলে হাসি অফুরন্ত।

এলো মেলো দখিনা মলয় রে
প্রলাপ বকিছে বনময় রে।
অকারণ মন মাঝে
বিরহের বেণু বাজে ।
জেগে ওঠে বেদনা ঘুমন্ত ॥






বসন্ত মুখর আজি
দক্ষিণ সমীরণে   মর্মর গুঞ্জনে
বনে বনে বিহ্বল বাণী ওঠে বাজি’ ॥

অকারণ ভাষা তা’র ঝর ঝর ঝরে
মুহু মুহু “কুহু-কুহু” “পিয়া-পিয়া” স্বরে,
পলাশ বকুলে   অশোক শিমূলে
সাজানো তাহার কল-কথার সাজি ॥

দোয়েল, মধুপ, বন-কপোত-কূজনে
ঘুম ভেঙে দেয় ভোরে বাসর শয়নে!
মৌনী আকাশ সেই বাণী-বিলাসে
অস্ত-চাঁদের মুখে মৃদু মৃদু হাসে।
বিরহ শীর্ণা গিরি-ঝরণার তীরে
পাহাড়ী বেণু হাতে ফেরে সুর ভাঁজি ॥






আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া।
চম্পা কুঞ্জে আজি গুঞ্জে ভ্রমরা—
কুহরিছে পাপিয়া ॥

প্ৰেম-কুসুম শুকাইয়া গেল হায় !
প্রাণ-প্রদীপ মোর হের গো নিভিয়া যায়,
— বিরহী এস ফিরিয়া ॥

তোমারি পথ চাহি হে প্রিয় নিশিদিন
মালার ফুল মোর ধূলায় হ’ল মলিন
——জনম গেল ঝুরিয়া ॥






দক্ষিণ সমীরণ সাথে বাজো বেণুকা।
মধুমাধবী সুরে চৈত্র পূর্ণিমা রাতে-
বাজো বেণুকা, বাজো বেণুকা ॥

বাজো শীর্ণা স্রোত-নদীতীরে,
বাজো ঘুম যবে নামে বন ঘিরে,
যবে, ঝরে এলোমেলো বায়ে ধীরে,
ফুল-রেণুকা।
বাজো বেণুকা, বাজো বেণুকা ॥

মধুমালতী-বেলা-বনে ঘনাও নেশা,
স্বপন আনো জাগরণে মদিরা-মেশা।
মন যবে রহে না ঘরে।
বিরহ লোকে সে বিহরে
যবে নিরাশার বালুচরে  ওড়ে বালুকা-
বাজো বেণুকা, বাজো বেণুকা ॥






ধূলি-পিঙ্গল জটাজুট মেলে--
আমার প্রলয়-সুন্দর এলে ॥

পথে পথে ঝরা-কুসুম ছড়ায়ে,
রিক্ত শাখায় কিশলয় জড়ায়ে,
গৈরিক উত্তরী গগনে উড়ায়ে –
রুদ্ধ-ভবনের দুয়ার ঠেলে ॥

বৈশাখী পূর্ণিমা-চাঁদের তিলক
তোমারে পরাব,
মোর অঞ্চল দিয়া   তব জটা নিঙাড়িয়া
সুরধুনি ঝরাব ।
যে মালা নিলেনা আমার ফাগুনে,
জ্বালাব তারে তব রূপের আগুনে,
মরণ দিয়া তব চরণ জড়াবো-
হে মোর উদাসীন্ যেওনা ফেলে ॥






মেঘ-বিহীন খর বৈশাখে
তৃষায় কাতর চাতকী ডাকে ॥

সমাধি-মগ্না উমা তপতী
রৌদ্র যেন তার তেজোজ্যোতি,
ছায়া মাগে ভীতা ক্লান্ত কপোতী
কপোত-পাখায় শুষ্ক শাখে ॥

শীর্ণা তটিনী বালুচর জড়ায়ে
তীর্থে চলে যেন শ্রান্ত পায়ে ।
দগ্ধ ধরণী যুক্তপাণি
চাহে আষাঢ়ের আশীষ-বাণী,
যাপিয়া নির্জলা একাদশীর তিথি
পিপাসিত আকাশ বাচে কাহাকে ॥






অরুণ-কান্তি কেগো যোগী ভিখারী।
নীরবে হেসে   দাড়াইলে এসে
প্রথর তেজ তব নেহারিতে নারি ॥

রাসবিলাসিনী   আমি আহিরিণী
শ্যামল-কিশোর-রূপ শুধু চিনি
অম্বরে হেরি আজ একি জ্যোতি-পুঞ্জ ?
হে গিরিজাপতি! কোথা গিরিধারী ॥

সম্বর সম্বর মহিমা তব
হে ব্রজেশ ভৈরব ! আমি ব্রজবালা,
হে শিব সুন্দর ! বাঘছাল পরিহর—
ধর নটবর বেশ পর নীপমালা ।
নব-মেঘ-চন্দনে ঢাকি’ অঙ্গ জ্যোতি
প্ৰিয় হ’য়ে দেখা দাও ত্রিভুবন পতি,
পাৰ্ব্বতী নহি আমি, আমি শ্রীমতী,
বিষাণ ফেলিয়া হও বাঁশরী-ধারী ॥







আমি পথ-মঞ্জুরী ফুটেছি আঁধার রাতে ।
গোপন অশ্রু-সম রাতের নয়ন পাতে ॥

দেবতা চাহেনা মোরে
গাঁধে না মালার ডোরে,
অভিমানে তাই ভোরে শুকাই শিশির সাথে ॥

মধুর সুরভি ছিল আমার পরাণ ভরা,
আমার কামনা ছিল মালা হ'য়ে ঝ'রে পড়া।
ভালবাসা পেয়ে যদি
কাঁদিতাম নিরবধি,
সে বেদনা ছিল ভাল সুখ ছিল সে কাঁদাতে ॥






স্নিগ্ধ শ্যামবেণী-বর্ণা এস মালবিকা।
অর্জুন-মঞ্জরী কর্ণে, গলে নীপ-মালিকা ॥

ক্ষীণা তন্বী জলভার নমিতা
শ্যাম জম্বুবনে এস অমিতা
আনো, কুন্দ মালতী-যূই ভরি’ থালিকা
মালবিকা ! এস মালবিকা !!

ঘন নীল বাসে অঙ্গ ঘিরে
এস অঞ্জনা, বেবা নদীর তীরে,
পরি’ হংস-মিথুন-আঁকা শাড়ি ঝিল্‌মিল
এস ডাগর চোখে মাখি’ সাগবের নীল।
ডাকে বিদ্যুৎ ইঙ্গীতে দিগ্‌ বালিকা
মালবিকা ! এস মালবিকা !!