কণ্ঠে নিলেম গান, আমার শেষ পারানির কড়ি--
একলা ঘাটে রইব না গো পড়ি ॥

আমার  সুরের রসিক নেয়ে
তারে  ভোলাব গান গেয়ে,
পারের খেয়ায় সেই ভরসায় চড়ি ॥

পার হব কি নাই হব তার খবর কে রাখে--
দূরের হাওয়ায় ডাক দিল এই সুরের পাগলাকে।
ওগো  তোমরা মিছে ভাব',
আমি  যাবই যাবই যাব--
ভাঙল দুয়ার, কাটল দড়াদড়ি ॥


Song: Konthe Nilem Gaan
Lyrics: Rabindranath Tagore
Singer: Srikanto Acharya






কবে তুমি আসবে ব'লে রইব না বসে

কবে তুমি আসবে ব'লে রইব না বসে,
আমি চলব বাহিরে।
শুকনো ফুলের পাতাগুলি পড়তেছে খসে,
আর সময় নাহি রে॥

বাতাস দিল দোল্‌, দিল দোল্‌;
ও তুই ঘাটের বাঁধন খোল্‌, ও তুই খোল্‌।
মাঝ-নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে তরী বাহি রে॥

আজ শুক্লা একাদশী, হেরো নিদ্রাহারা শশী
ওই স্বপ্নপারাবারের খেয়া একলা চালায় বসি।

তোর পথ জানা নাই, নাইবা জানা নাই--
ও তোর নাই মানা নাই, মনের মানা নাই--
সবার সাথে চলবি রাতে সামনে চাহি রে॥







কাছে ছিলে দূরে গেলে

কাছে ছিলে, দূরে গেলে-- দূর হতে এসো কাছে।
ভুবন ভ্রমিলে তুমি-- সে এখনো বসে আছে॥

ছিল না প্রেমের আলো,
চিনিতে পারো নি ভালো--
এখন বিরহানলে প্রেমানল জ্বলিয়াছে।

জটিল হয়েছে জাল,
প্রতিকূল হল কাল--
উন্মাদ তানে তানে  কেটে গেছে তাল।

কে জানে তোমার বীণা
সুরে ফিরে যাবে কি না--
নিঠুর বিধির টানে  তার ছিঁড়ে যায় পাছে॥







কাছে থেকে দূর রচিল কেন গো আঁধারে

কাছে থেকে দূর রচিল কেন গো আঁধারে।
মিলনের মাঝে বিরহকারায় বাঁধা রে॥

সমুখে রয়েছে সুধাপারাবার,
নাগাল না পায় তবু আঁখি তার--
কেমনে সরাব কুহেলিকার এই বাধা রে॥

আড়ালে আড়ালে শুনি শুধু তারি বাণী যে।
জানি তারে আমি, তবু তারে নাহি জানি যে।
শুধু বেদনায় অন্তরে পাই,
অন্তরে পেয়ে বাহিরে হারাই--
আমার ভুবন রবে কি কেবলই আধা রে॥








কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন

কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন,
ও তার   ঘুম ভাঙাইনু রে।
লক্ষ যুগের অন্ধকারে ছিল সঙ্গোপন,
ওগো,  তায় জাগাইনু রে॥

পোষ মেনেছে হাতের তলে
যা বলাই সে তেমনি বলে--
দীর্ঘ দিনের মৌন তাহার আজ ভাগাইনু রে॥

অচল ছিল, সচল হয়ে
ছুটেছে ওই জগৎ-জয়ে--
নির্ভয়ে আজ দুই হাতে তার রাশ বাগাইনু রে॥





কত কথা তারে ছিল বলিতে
কত  কথা তারে ছিল বলিতে।
চোখে চোখে দেখা হল পথ চলিতে॥

বসে বসে দিবারাতি
বিজনে সে কথা গাঁথি
কত যে পুরবীরাগে কত ললিতে॥

সে কথা ফুটিয়া উঠে কুসুমবনে,
সে কথা ব্যাপিয়া যায় নীল গগনে।

সে কথা লইয়া খেলি
হৃদয়ে বাহিরে মেলি,
মনে মনে গাহি কার মন ছলিতে॥







কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে

কাল  রাতের বেলা গান এল মোর মনে,
তখন তুমি ছিলে না মোর সনে॥

যে কথাটি বলব তোমায় ব'লে
কাটল জীবন নীরব চোখের জলে
সেই কথাটি সুরের হোমানলে
উঠল জ্বলে একটি আঁধার ক্ষণে--
তখন তুমি ছিলে না মোর সনে॥

ভেবেছিলেম আজকে সকাল হলে
সেই কথাটি তোমায় যাব বলে
ফুলের উদাস সুবাস বেড়ায় ঘুরে
পাখির গানে আকাশ গেল পুরে,
সেই কথাটি লাগল না সেই সুরে
যতই প্রয়াস করি পরানপণে--
যখন তুমি আছ আমার সনে॥








কার যেন এই মনের বেদন

কার যেন এই মনের বেদন
চৈত্রমাসের উতল হাওয়ায়,
ঝুমকোলতার চিকন পাতা
কাঁপে রে কার চম্‌কে-চাওয়ায়॥

হারিয়ে-যাওয়া কার সে বাণী
কার সোহাগের স্মরণখানি
আমের বোলের গন্ধে মিশে
কাননকে আজ কান্না পাওয়ায়॥

কাঁকন-দুটির রিনিঝিনি
কার বা এখন মনে আছে।
সেই কাঁকনের ঝিকিমিকি
পিয়ালবনের শাখায় নাচে।

যার চোখের ওই আভাস দোলে
নদী-ঢেউয়ের কোলে কোলে
তার সাথে মোর দেখা ছিল
সেই সেকালের তরী-বাওয়ায়॥








কেন পান্থ এ চঞ্চলতা

কেন  পান্থ, এ চঞ্চলতা।
কোন্‌  শূন্য হতে এল কার বারতা ॥

নয়ন কিসের প্রতীক্ষা-রত
বিদায়বিষাদে উদাসমত--
ঘনকুন্তলভার ললাটে নত,
ক্লান্ত তড়িতবধু তন্দ্রাগতা ॥

কেশরকীর্ণ কদম্ববনে
মর্মরমুখরিত মৃদুপবনে
বর্ষণহর্ষ-ভরা ধরণীর
বিরহবিশঙ্কিত করুণ কথা।

ধৈর্য মানো ওগো, ধৈর্য মানো!
বরমাল্য গলে তব হয় নি ম্লান'
আজও হয় নি ম্লান'--
ফুলগন্ধনিবেদনবেদনসুন্দর
মালতী তব চরণে প্রণতা ॥








কেন বাজাও কাঁকন কনকন

কেন  বাজাও কাঁকন কনকন কত ছলভরে।
ওগো,  ঘরে ফিরে চলো কনককলসে জল ভরে॥

কেন  জলে ঢেউ তুলি ছলকি ছলকি করে খেলা।
কেন  চাহ খনে খনে চকিত নয়নে কার তরে
কত  ছলভরে॥

হেরো  যমুনা-বেলায় আলসে হেলায় গেল বেলা,
যত  হাসিভরা ঢেউ করে কানাকানি কলস্বরে
কত  ছলভরে।

হেরো নদীপরপারে গগনকিনারে মেঘমেলা,
তারা  হাসিয়া হাসিয়া চাহিছে তোমারি মুখ'পরে
কত  ছলভরে॥






কেন বাণী তব নাহি শুনি নাথ হে

কেন বাণী তব নাহি শুনি নাথ হে?
অন্ধজনে নয়ন দিয়ে অন্ধকারে ফেলিলে,
বিরহে তব কাটে দিনরাত হে ॥

স্বপনসম মিলাবে যদি কেন গো দিলে চেতনা--
চকিতে শুধু দেখা দিয়ে চিরমরমবেদনা,
আপনা-পানে চাহি শুধু নয়নজলপাত হে ॥

পরশে তব জীবন নব সহসা যদি জাগিল
কেন জীবন বিফল কর-- মরণশরঘাত হে।
 অহঙ্কার চূর্ণ করো, প্রেমে মন পূর্ণ করো,
হৃদয় মন হরণ করি রাখো তব সাথ হে ॥






কেন সারা দিন ধীরে ধীরে

কেন সারা দিন ধীরে ধীরে
বালু নিয়ে শুধু খেলো তীরে॥

চলে গেল বেলা,  রেখে মিছে খেলা
ঝাঁপ দিয়ে পড়ো কালো নীরে।
অকূল ছানিয়ে যা পাও তা নিয়ে
হেসে কেঁদে চলো ঘরে ফিরে॥

নাহি জানি মনে কী বাসিয়া
পথে বসে আছে কে আসিয়া।
কী কুসুমবাসে  ফাগুনবাতাসে
হৃদয় দিতেছে উদাসিয়া।
চল্‌ ওরে এই  খ্যাপা বাতাসেই
সাথে নিয়ে সেই উদাসীরে॥







কোথা  বাইরে দূরে  যায় রে

কোথা  বাইরে দূরে  যায় রে উড়ে  হায় রে হায়,
তোমার  চপল আঁখি  বনের পাখি  বনে পালায়॥

ওগো,  হৃদয়ে যবে  মোহন রবে  বাজবে বাঁশি
তখন  আপনি সেধে  ফিরবে কেঁদে,  পরবে ফাঁসি--
তখন  ঘুচবে ত্বরা,  ঘুরিয়া মরা  হেথা হোথায়।
আহা,  আজি সে আঁখি  বনের পাখি  বনে পালায়॥

চেয়ে  দেখিস না রে  হৃদয়দ্বারে  কে আসে যায়,
তোরা  শুনিস কানে  বারতা আনে  দখিন বায়।
আজি  ফুলের বাসে  সুখের হাসে  আকুল গানে
চির  বসন্ত যে  তোমারি খোঁজে  এসেছে প্রাণে,
তারে  বাহিরে খুঁজি  ফিরিছ বুঝি  পাগলপ্রায়--
আহা  আজি সে আঁখি  বনের পাখি  বনে পালায়॥






কোলাহল তো বারণ হল

কোলাহল তো বারণ হল,
এবার কথা কানে কানে।
এখন হবে প্রাণের আলাপ
কেবলমাত্র গানে গানে॥

রাজার পথে লোক ছুটেছে,
বেচাকেনার হাঁক উঠেছে,
আমার ছুটি অবেলাতেই
দিনদুপুরে মধ্যখানে--
কাজের মাঝে ডাক পড়েছে
কেন যে তাই কেই বা জানে॥

মোর কাননে অকালে ফুল
উঠুক তবে মুঞ্জরিয়া।
মধ্যদিনে মৌমাছিরা
বেড়াক মৃদু গুঞ্জরিয়া।

মন্দ-ভালোর দ্বন্দ্বে খেটে
গেছে তো দিন অনেক কেটে,
অলস-বেলায় খেলার সাথি
এবার আমার হৃদয় টানে--
বিনা-কাজের ডাক পড়েছে
কেন যে তাই কেই বা জানে॥






খরবায়ু বয় বেগে, চারি দিক ছায় মেঘে,
ওগো নেয়ে, নাওখানি বাইয়ো।
তুমি কষে ধরো হাল, আমি তুলে বাঁধি পাল--
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো ॥

শৃঙ্খলে বারবার ঝন্‌ঝন্‌ ঝঙ্কার,
নয় এ তো তরণীর ক্রন্দন শঙ্কার--
বন্ধন দুর্বার সহ্য না হয় আর,
টলমল করে আজ তাই ও।
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো ॥

গণি গণি দিন খন  চঞ্চল করি মন
বোলো না, 'যাই কি নাহি যাই রে'।
সংশয়পারাবার  অন্তরে হবে পার,
উদ্‌বেগে তাকায়ো না বাইরে।

যদি মাতে মহাকাল, উদ্দাম জটাজাল
ঝড়ে হয় লুণ্ঠিত, ঢেউ উঠে উত্তাল,
হোয়ো নাকো কুণ্ঠিত, তালে তার দিয়ো তাল--
জয়-জয় জয়গান গাইয়ো।
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো ॥







খুলে দে তরণী খুলে দে তোরা

খুলে দে তরণী, খুলে দে তোরা,
স্রোত বহে যায় যে।
মন্দ মন্দ অঙ্গেভঙ্গে  নাচিছে তরঙ্গ রঙ্গে--
এই বেলা খুলে দে॥

ভাঙিয়ে ফেলেছি হাল,  বাতাসে পুরেছে পাল,
স্রোতোমুখে প্রাণ মন  যাক ভেসে যাক--
যে যাবি আমার সাথে  এই বেলা আয় রে॥






গানের ভেলায়  বেলা অবেলায়

গানের ভেলায়  বেলা অবেলায়  প্রাণের আশা
ভোলা মনের স্রোতে ভাসা ॥

কোথায় জানি ধায় সে বাণী,  দিনের শেষে
কোন ঘাটে যে ঠেকে এসে
চিরকালের কাঁদা-হাসা ॥

এমনি খেলার ঢেউয়ের দোলে
খেলার পারে যাবি চলে।
পালের হাওয়ার ভরসা তোমার-- করিস নে ভয়
পথের কড়ি না যদি রয়,
সঙ্গে আছে বাঁধন-নাশা ॥





গানের ভিতর দিয়ে যখন

গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি
তখন তারে চিনি আমি,  তখন তারে জানি।

তখন তারি আলোর ভাষায়
আকাশ ভরে ভালোবাসায়,
তখন তারি ধুলায় ধুলায় জাগে পরম বাণী ॥

তখন সে যে বাহির ছেড়ে অন্তরে মোর আসে,
তখন আমার হৃদয় কাঁপে তারি ঘাসে ঘাসে।

রূপের রেখা রসের ধারায়
আপন সীমা কোথায় হারায়,
তখন দেখি আমার সাথে সবার কানাকানি ॥




গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে,
আর কোলাহল নাই।
রহি রহি শুধু সুদূর সিন্ধুর
ধ্বনি শুনিবারে পাই ॥

সকল বাসনা চিত্তে এল ফিরে,
নিবিড় আঁধার ঘনালো বাহিরে--
প্রদীপ একটি নিভৃত অন্তরে
জ্বলিতেছে এক ঠাঁই ॥

অসীম মঙ্গলে মিলিল মাধুরী,
খেলা হল সমাধান।
চপল চঞ্চল লহরীলীলা
পারাবারে অবসান।

নীরব মন্ত্রে হৃদয়মাঝে
শান্তি শান্তি শান্তি বাজে,
অরূপকান্তি নিরখি অন্তরে
মুদিতলোচনে চাই ॥






ঘরেতে ভ্রমর এল গুন্‌গুনিয়ে

ঘরেতে  ভ্রমর এল গুন্‌গুনিয়ে।
আমারে  কার কথা সে যায় শুনিয়ে॥

আলোতে  কোন্‌ গগনে  মাধবী   জাগল বনে,
এল সেই  ফুল-জাগানোর খবর নিয়ে।
সারাদিন  সেই কথা সে যায় শুনিয়ে।
কেমনে  রহি ঘরে,  মন যে   কেমন করে,
কেমনে  কাটে যে দিন দিন গুনিয়ে।

কী মায়া  দেয় বুলায়ে,
দিল সব  কাজ ভুলায়ে,
বেলা যায় গানের সুরে জাল বুনিয়ে।
আমারে  কার কথা সে যায় শুনিয়ে॥